প্রথম হাফসোল
পূজা মুখার্জি মিত্র
প্রেম ব্যাপারটা বাজার করার মতো দেখে বেছে হয় না, এই ভয়ঙ্কর উপলব্ধি ক্লাস ইলেভেনে বৈষ্ণব পদাবলী পড়াকালীন করা গেল এবং অতশত না ভেবে সর্বপ্রথম প্রেমিকের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাস টুয়েলভেই ধাঁ করে হ্যাঁ বলে দেওয়াও গেল। অতঃপর বোঝা গেল, আগে গেলে বাঘে খায়। তড়িঘড়ি প্রথমটাতই মাথা নেড়ে দেওয়ায় অন্য বন্ধুরা যখন নানারকম প্রেমিকের থেকে পাওয়া দিস্তা দিস্তা প্রেমপত্র জমানোর আলাদা ব্যাগ কিনছে, নাক উঁচু করে না বলে দিয়ে প্রেমিকপুঙ্গবদের কাতর চোখের সামনে প্রজাপতির মতো নেচে বেড়াচ্ছে, এর সাথে হাসছে, ওর সাথে ঘুরছে, তার দিকে তাকাচ্ছে, আমি বেবাক ফাঁকা। কারণ শুধু বাবা-মা ছাড়া পৃথিবীর সবাই জানে আমার একটি প্রেমিক আছে। বিবাহিত হলে যমন কপালে সিঁদুর থাকে, সিরিয়াস প্রেমিক থাকলে সেই খবরটা আরও বিরক্তিকর ভাবে অস্তিত্বের সঙ্গে লেপ্টে থাকে, বিশেষত ওই বয়সে! তাই কেউ আশপাশে ঘেঁষতেই পারছে না, চাইছেও না।
এমতাবস্থাতেও একটা চিঠি উড়ে এল আমার লেডিবার্ড সাইকেলের বাস্কেটে। বাইক চালিয়ে ওভারটেক করতে করতে সে ছুড়ে দিল। পাড়ার বিখ্যাত ছেলে, বাবার পয়সাকড়ি বেশ কিছু আছে। তাকে তার তাবৎ জীবনে দিনকয়ক মানুষজন স্কুলে যেতে দেখেছিল বটে, চিঠিতে তার প্রমাণ ছত্রে ছত্রে। নিজের নামের বানানটা বাদে প্রায় সব বানান ভল, এমনকী আমার নামের বানান অবধি। তা যাক গে, শেষমেশ প্রেমপত্র তো বটে, তাও আমাকে, সব জেনেশুনে।
প্রথমে উত্তর দিলাম না কিছু; আবারও চিঠি, না পেলে বাঁচবে না সেই মর্মে! এ বার তো কিছু করতেই হয়। হ্যাঁ বলার তো প্রশ্ন নেই, অতএব ‘না’-ই করতে হবে। তার মানে প্রেম প্রত্যাখ্যান করার সেই বহু প্রতীক্ষিত সুযোগ আমারও এসেছে। কিন্তু একেবারে পাড়ার মধ্যে বলে বেশি এগিয়ে খেলা ঠিক হবে না মনে হল। তখনও মফস্সলে পাড়াঘরের কেচ্ছা বেশ মুখরোচক। ভাবনাচিন্তা করে চিঠিদুটো বাবার হাতে ধরিয়ে দিলাম, কারণ এলাকায় ছেলেটির খুব সুনাম নেই, একা কিছু করতে গেলে অনভিজ্ঞতাবশত ছড়িয়ে ফেলার প্রবল সম্ভাবনা, আর আমার তৎকালীন প্রেমিকটি আবার ‘হাত থাকতে মুখে কেন’ পন্থী। বরং বাবাই ধমক-ধামকে বুঝিয়ে দেবেন, এতে সবারই মঙ্গল।
এক সপ্তাহ চুপচাপ। বাবাকে আর এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি, বাবাও বলেননি। হঠাৎ এক সন্ধেতে নিরিবিলি রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে একাই ফিরছি, বাইক চালিয়ে সে আবারও আমার পাশে। এ বার মুখে কথা, ‘একটু দাঁড়াবে?’ সাইকেল থামালাম। সরাসরি আমার চোখে তার বিরক্ত চোখ রেখে প্রশ্ন- ‘বিংশ শতাব্দীর একটা মেয়ে হয়ে লাভলেটার বাবাকে দেখিয়ে দিলে? তোমার লজ্জা করল না?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইক স্টার্ট করে দিল। সেদিনকার হাফ-সোল যে কে কাকে মেরেছিল, সে বিষয়ে আমি আজও দ্বিধায়!