নিজস্ব প্রতিবেদন: ব্যতিক্রমের ওপর ব্যতিক্রম। একে হিন্দু নারী তায় পৌরোহিত্য করেন, তার ওপর আবার আমেরিকায় হিন্দুদের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গ ও সমকামী বিবাহের একমাত্র নারী পুরোহিত। আমেরিকার পরিণয়- শিল্পে এক বিরল ও ব্যতিক্রমী চরিত্র, সুষমা দ্বিবেদী।
২০১৬-তে ‘পার্পল পণ্ডিত প্রোজেক্ট’ নামে এক অভিনব প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন সুষমা। উদার, আন্তরিক, এলজিবিটিকিউ+- বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্নরকম ধর্মীয় পরিষেবা দেয় এই প্রতিষ্ঠান। সমকামী, বিষমকামী বা আন্তর্গোষ্ঠী বিবাহ? কিম্বা গৃহপ্রবেশ, নামকরণ উৎসব, ভূমিপূজা? নারীকে চাই ঋত্বিক-রূপে? এই সমস্ত প্রয়োজনে পাশে থাকে ‘পার্পল পণ্ডিত প্রোজেক্ট’। এখন অবধি ৩৩টি বিবাহ-অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছেন সুষমা, যার অর্ধেকের বেশি সমলিঙ্গ বিবাহ।
৪০ বছরের সুষমা পেশাগত ভাবে ‘ডেইলি হারভেস্ট’ নামে একটি জৈব-খাদ্য প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ এবং বিপণন বিভাগের সহ-সভানেত্রী। সুষমার বেড়ে ওঠার দিনগুলো কেটেছে কানাডাতে। বর্তমানে স্বামী বিবেক জিন্দাল ও দুই পুত্র, পাঁচ বছরের অশ্বিন ও তিন বছরের নয়নকে নিয়ে তিনি হার্লেমে থাকেন। ৩৭ বছরের বিবেক নিউইয়র্কের সম্পদ পরিচালন মাধ্যম ‘কোর’-এর প্রধান বিনিয়োগ অধিকর্তার পদে আসীন।
আসুন, সুষমার কাছ থেকে চিনে নিই তাঁর পুরোহিত হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটিকে। ২০১৩ সালে মন্ট্রিলে দু-দু’খানি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিয়ে হয় সুষমার। ওল্ড পোর্টের মধ্যিখানে হোটেল নেলিগানে একটি, দ্বিতীয়টি লফটে। আড়াইশো অতিথির সমাগমে সাবেকী ভারতীয় বিয়ে যাকে বলে! এর ঠিক বিপ্রতীপ একটা দৃশ্য জন্ম নিচ্ছিল সুষমার মাথার ভিতর। শ্বশুরবাড়ির এক ঘনিষ্ঠ পরিজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, তিনি তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করতে চাইলে সে বিবাহের জন্য পুরোহিতও খুঁজে পাওয়া যাবে না, জানতেন সুষমা। বিষমকামী সম্পর্ক ব্যতিরেকে কোনও সম্পর্কই তো মান্যতা পায় না আমাদের সমাজে কিম্বা সংস্কৃতিতে। নিজের বিয়ের ধূমধামের প্রতিতুলনায় এই রূঢ় সত্য সুষমাকে ভিতরে ভিতরে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
যৌনতা-নির্বিশেষে সব মানুষের ভালোবাসার অধিকারকে অগ্রাহ্য করে যে প্রতিষ্ঠান, তার অংশ হয়ে থাকতে থাকতে অনর্গল রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সুষমার হৃদয়ে। বিয়ের দু’মাসের মধ্যে তিনি অনলাইনে ইউনিভার্সাল লাইফ চার্চের সঙ্গে যুক্ত হন। পাল্টে দেওয়ার, অচলায়তন ভাঙার তীব্র ইচ্ছে মনে, কী ভাবে তা সম্ভব হবে সে পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কোনও এক ক্ষীণ বার্তা শোনা যাচ্ছে মাথার ভিতর, তা নিজের কাছে কবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, অপেক্ষা করছেন সুষমা।
২০১৬-র মে মাস। সুষমা তখন প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে ওয়েইল কর্নেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অজ্ঞান করার জন্য মেরুদণ্ডে ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছিল তাঁর, তীব্র ব্যথার মুহূর্তে তাঁকে অন্যমনস্ক করার জন্য চিকিৎসক বলতে থাকেন যে হাসপাতালে ভর্তি এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জল ভাঙতে শুরু করেছিল, অবিলম্বে প্রসব করানো প্রয়োজন, তাঁরা হন্যে হয়ে চার্চের সঙ্গে যুক্ত এমন কারোকে খুঁজছিলেন যিনি অবিবাহিত সেই দম্পতির বিবাহ করিয়ে শংসাপত্র দিতে পারবেন তৎক্ষনাৎ। সন্তানপ্রসবের আগেই সরকারি ভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছিলেন সেই যুগল।
মাথার ভিতরকার সেই অশ্রুত বার্তা স্পষ্ট হল এতদিনে। সুষমা চিকিৎসককে জানালেন, কারোকে পাওয়া না গেলে, তিনি নিজেই পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হতে পারেন। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও মিনিট দশেক পরে একজন এসে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন সুষমা সত্যি সত্যিই পৌরোহিত্য করতে পারবেন কি না। দুর্বলতাবশত নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার মত পরিস্থিতি ছিল না তখন সুষমার। সেই যুগল এলেন তাঁর হাসপাতালের কামরায়, একজন নার্স কবিতা লিখে ফেললেন, অন্য একজন নববধূর জন্য তৈরি করে দিলেন ফুলের মুকুট, বাকিরা সারি দিয়ে দাঁড়ালেন তাঁদের ঘিরে। অসাধারণ সুন্দর একটা বিবাহ অনুষ্ঠান সংঘটিত হল হাসপাতালের ভিতর।
আন্তরিকতা, সহমর্মিতা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে কারও প্রেমকে পূর্ণতায় পৌঁছে দেওয়ার গল্পে সহায়ক চরিত্র হয়ে ওঠার মধ্যে যে কী অপরিসীম তৃপ্তি, তা সেদিন উপলব্ধি করেন সুষমা। তাঁর নিজের জীবনও এক নতুন দিশা খুঁজে পায়। গোটা অনুষ্ঠানটা নিজের আইফোনে রেকর্ড করেন সুষমার স্বামী। রূপকথার গল্পের মত সেই পরিণয় অনুষ্ঠানের ভিডিও ভাইরাল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৬ ছিল আমেরিকায় নির্বাচনের বছর। এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সুষমার প্রথম সন্তান সবে জন্ম নিয়েছে তখন, মাতৃত্ব তাঁর ভিতরে এক আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, নিজের ক্ষমতাকে সেই আলোয় চিনতে পারলেন তিনি। তাঁর ভেতরে যে সমাজকর্মী সত্ত্বা, তার যাত্রা শুরু হল এক বন্ধুর পথ ধরে সেই আলোরই মশাল হাতে নিয়ে। সদ্যোজাত সন্তানকে পাশে নিয়ে সোফায় বসে বসেই একটা ওয়েবসাইট তৈরি করে ফেললেন সুষমা। নাম দিলেন গো ড্যাডি। একটা জোরালো রং খুঁজছিলেন তিনি, যে রং হয়ে উঠবে এক প্রান্তিক, সংখ্যালঘু অথচ সাহসী সম্প্রদায়ের প্রতীক। দক্ষিণ এশীয় সমকামী সম্প্রদায়। পার্পল বা ময়ুরপঙ্খী রংটিকে মনে ধরলো সুষমার। তৈরি হল পার্পল পণ্ডিত প্রোজেক্ট।
দু-তিন ঘণ্টার সাবেকী হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানকে নতুন রূপ দিলেন সুষমা দ্বিবেদী। সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো দিয়ে শুরু করেন তিনি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে নব-পরিণীত দম্পতির চলার পথের সমস্ত বিঘ্ন নাশ হয়। এরপর পবিত্র হোমাগ্নিকে ঘিরে সাত পাকে ঘোরেন বর-বধূ, তার মধ্য দিয়ে অব্যক্ত প্রতিশ্রুতির আদান-প্রদান হয়। হিন্দু-বিবাহ আজো ঐতিহ্যগত ভাবে একান্তই পিতৃতান্ত্রিক এক পদ্ধতি, যেখানে কন্যাটিকে সম্প্রদান করা হয় স্বামীর হাতে, অন্য নিষ্প্রাণ দানসামগ্রীর মত। এই অংশটিকে সযত্নে পরিহার করেছেন সুষমা। পরিবর্তে, তাঁর একান্ত নিজস্ব সংযোজন পঞ্চতন্ত্রের একটি গল্প পাঠ, যে গল্প নববিবাহিত দম্পতিকে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, জীবনের পথ চলতে, সম-অংশীদারিত্বের জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। গোটা অনুষ্ঠানটায় সময় লাগে মাত্র ৩৫ মিনিট।
এ কাজ করতে গিয়ে তিক্ত-মধুর নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন সুষমা। কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের একটি ঘটনা। এক বিষমকামী যুগলের বিয়ে দিচ্ছিলেন হিন্দুরীতি অনুযায়ী। হঠাৎ এক অতিথি ভদ্রলোক এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন সুষমাকে উদ্দেশ্য করে। ‘আপনি এখানে কী করছেন? নারী আবার পুরোহিত হতে পারে নাকি!’ এই বৈষম্যমূলক প্রতিক্রিয়া থেকে একটা উপলব্ধি হয় সুষমার। পরিবর্তন আনা কঠিন, কঠিনতর তাকে খোলা মনে মেনে নেওয়া। অনেক সময় লাগে, তাই ধৈর্য ধরে, ক্ষমা দিয়ে, আচরণের মাধুর্য দিয়ে অপেক্ষা করা শিখেছেন তিনি। পৌরোহিত্য নিছক শখ নয় সুষমার, এই কাজের মধ্যে দিয়ে তাঁর মুক্তি ও ক্ষমতায়ন দুই-ই ঘটেছে। পৌরোহিত্যের মধ্য দিয়ে এক অমূল্য আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছেন তিনি।
সুষমার পিতামহী তাঁকে একটা সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন। ৮৮ বছরের সেই বৃদ্ধা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের রীতি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর দেওয়া আংটিটি পরেই সুষমা পৌরোহিত্য করেন। শিকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও কী ভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা যায়, সুষমার কাছে এই আংটিটা তারই প্রতীক। তাছাড়াও সাবেকী ভারতীয় রুচির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বহুবিধ অলঙ্কারে ভূষিতা হয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন তিনি। শুধু আভরণ নয়, আবরণেও পুরোদস্তুর ভারতীয় ঐতিহ্য বজায় থাকে তাঁর। ময়ূরকণ্ঠী রঙের ওপর জরির কাজ-করা রত্নখচিত লেহেঙ্গা-চোলি কিম্বা সালওয়ার কামিজে সাজেন সুষমা, পা থাকে খালি।
বর-বধূ যুগলে তাঁর কাছে এসে যখন কৃতজ্ঞ কণ্ঠে জানান যে এমনই এক অনুষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা, কিন্তু সত্যি হবে ভাবেননি কোনওদিন, সেই মুহূর্তটিতে সুষমার এত দিনের লড়াই, অপমান, উপেক্ষা মুছে যায়। আগামীর রসদ খুঁজে পান পার্পল পণ্ডিত প্রোজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা পুরোহিত সুষমা দ্বিবেদী।