কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
আগেও বলেছি, অন্তঃপুরের সংসারকর্ম, দায়িত্ব কর্তব্য সেরে নিয়ম কানুন, সামাজিক সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা আর গোঁড়ামির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে অনেক প্রথা ভেঙে, প্রতিকূল সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করে তারপর মেয়েরা কলমটি পেয়েছে। শুধুমাত্র শিক্ষার অধিকারের জন্য, স্বাধীন চিন্তা ভাবনার জন্যও তাদের লড়াই ছিল। তার জন্য অনেক সময় লেগেছিল। বহু বছর লেগেছিল। মেয়েদের লড়াইটা আসলে ছিল নিজেদের সঙ্গে, পুরুষতান্ত্রিক পরিবার এবং সমাজের সঙ্গে, সর্বোপরি দারিদ্রের সঙ্গে, জাতপাতের সঙ্গে। বর্ণ বিভাজনের সঙ্গে। এই লড়াইটা ছিল মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের। রাজ পরিবার, জমিদার বা উচ্চবিত্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে এতোটা বিধিনিষেধ ছিলনা আগেই উল্লেখ করেছি।
বহু বছরের আড় ভাঙতে হয়েছে, বেড়া ভাঙতে হয়েছে, নিজেকে ভাঙতে হয়েছে, শতবার ভাবতে হয়েছে উচিত অনুচিতের কথা, সামাজিক সংকট ছিল, দ্বিধা ছিল। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ ( ১৩০০ থেকে ১৮০০ শতক পর্যন্ত) যাকে বলা হয় তার কথা ছেড়েই দিলাম, আধুনিক যুগ যেটা ১৮ শতক থেকে ধরা হয়, নারীরা শিক্ষার আলো সামান্য পান। যদিও প্রাচীন যুগেও, বৈদিক যুগের আগেও নারীশিক্ষা ছিল। গুরুগৃহে গিয়ে শিক্ষা নেবার অধিকার মেয়েদেরও ছিল।
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে স্বর্ণকুমারীকে শিক্ষিত নারীসমাজের অন্যতম প্রথম প্রতিনিধি বা প্রথম শিক্ষিত মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে ধরা হয়। তাঁর জন্মই হয়েছে ১৮৫৫ তে। দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতনী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো ছিলেন। ১৮৭৬ এ তাঁর প্রথম উপন্যাস দীপনির্মাণ প্রকাশিত হয়। তিনি মোট তেরোটি উপন্যাস ও আটটি নাটক লিখেছেন। এছাড়াও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতেও পারদর্শী ছিলেন, গানও লিখেছেন। অন্যদিকে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম মহিলা বাঙালি কবি হিসেবে ধরা হয় চন্দ্রাবতীদেবীকে। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় তিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। পিতা বংশীদাসের সঙ্গে মিলে তিনি মনসামঙ্গল কাব্যের অনেকটা লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞানী। কৈশোর পেরোলে বাল্যকালের প্রেমিক জয়চন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ ঠিক হয়। কিন্তু তার মাত্র কিছুকাল আগেই জয়চন্দ্র অন্য একটি সুন্দরী মুসলিম মেয়ের প্রেমে পড়েন। ধর্মান্তরিত হয়ে জয়চন্দ্র তাঁদের সেই বিবাহের রাতেই চন্দ্রাবতীকে বিবাহ না করে সেই মেয়েটিকে বিবাহ করেন। অভিমানে,অপমানে, মনে অনেক ব্যাথা নিয়ে চন্দ্রাবতী পিতার অনুমতি নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। ফুলেশ্বরী নদীর ধারে তাঁর পিতা তাঁকে একটি শিবের মন্দির গড়ে দেন। সেই মন্দিরে গিয়ে নির্জনে শুধুমাত্র সাহিত্যচর্চা এবং লেখায় মন দেন চন্দ্রাবতী।কিছুদিনের মধ্যেই জয়চন্দ্রের মোহ কাটে, তিনি ফিরে আসতে চান চন্দ্রাবতীর কাছে। কিন্তু চন্দ্রাবতী সাহিত্যচর্চাকেই জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে, একমাত্র সঙ্গী করে বাকি জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলেন। জয়চন্দ্র মন্দিরে এলে তিনি দ্বার খোলেননি। সেইদিনই ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন জয়চন্দ্র। জয়চন্দ্রের দেহ জলে ভাসতে দেখে চন্দ্রাবতীও জলে নিজেকে বিসর্জন দেন। অতি অল্প বয়সেই তাঁর এভাবে চলে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের অনেকটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল একথা অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন সাহিত্যের ঘোর অনুরাগী এবং শাস্ত্রজ্ঞানী। এই লেখায় চন্দ্রাবতীদেবীর জীবন কাহিনী বলবার কারণ একটাই, অল্প বয়সে আত্মহত্যা না করে তিনি যদি আরও সাহিত্য রচনা করতেন নারী শিক্ষার ইতিহাস তাহলে হয়তো একটু অন্যরকমভাবে লেখা হতো। যদিও তারও আগে রজকিনী রামীকে প্রথম কবি হিসেবে ধরা হয়। তিনি ছিলেন নিরক্ষর দরিদ্র এক রজককন্যা। তাঁর কোন অক্ষরজ্ঞান ছিলনা। বর্ণমালা জানতেননা। তবুও মুখে মুখে লোককবিতা বানিয়ে সেইযুগে যা বলে গেছেন তাতে নারী স্বাধীনতা ও সমাজ সমালোচনার স্বর শুনতে পাওয়া যায়। দ্বিজ চন্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর প্রেমের কাহিনী এখন প্রায় সবাই জানেন। তাঁর অনেক লোককবিতা সংরক্ষণের অভাবে এবং অবহেলায় আজ হারিয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় মেয়েদের শিক্ষার আলো এভাবেই একটু একটু পা ফেলে উজ্জ্বল হয়েছিল।
ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৮ শতকে প্রথম নারীশিক্ষার গুরুত্ব দেন। মিশনারীদের তাই মেয়েদের শিক্ষায় অনেকটা অবদান আছে। ১৭৬০ সালে মিশনারীরা প্রথম মেয়েদের জন্য একটি স্কুল স্থাপন করে যদিও সেটি স্থায়ী হয়নি। তারপর ১৮১৮ সালে চুঁচুড়াতে প্রথম মেয়েদের স্কুল স্থাপন হয়। তারপর পর পর শ্রীরামপুর এবং কলকাতা সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের জন্য বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে। নবজাগরণের সময় নারীশিক্ষার আরও একধাপ প্রসার হয় সমাজের অনেক গোঁড়ামি ভেঙে। (রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র, ডিরোজিও)
১) বলা হয় ইতিহাস মূলত লেখা হয়েছে পুরুষদের হাতে
২) যুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি, প্রশাসননীতিতেও পুরুষদের সক্রিয়তার কথাই
বলা হয়।
মেয়েরা তাহলে কোথাও নেই।
বৈদিকযুগে নারীদের স্থান কিন্তু সমাজে বেশ সম্মানের এবং উপরের দিকেই ছিল। কেননা বৈদিক যুগে পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে নারীদেরও শিক্ষার অবকাশ ও স্বাধীনতা ছিল তবে তা কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত নারীদের ক্ষেত্রে। গুরুগৃহে মেয়েরাও যেত বিদ্যাচর্চা করতে।
সিন্ধু সভ্যতা (বা হড়প্পা সভ্যতা) ধ্বংসের পর বৈদিক যুগের শুরু ১৫০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে আর্যদের আগমনের সঙ্গে। তখনও যে নারীশিক্ষা ছিল তার কারণ, সেইসময় অনেক বিদুষী নারীর কথা জানা যায়। প্রাচীনযুগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যেও নারী শিক্ষার কথা শোনা যায়। বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে ( ১০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত)। নারীদের মর্যাদা ও প্রতিভা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল, নারীকে পন্য ও ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো, শিক্ষা তো দূরের কথা। (বহুবিবাহ, বহুপতিত্ব, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা প্রচলন হয়)। তারপর থেকেই ক্রমশ নারীদের অবস্থান ও স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হতে আরম্ভ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। মনুর যুগ থেকেই মেয়েদের শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়
Onek na-jana kahini jante parlam. Valo ago
এত্তো তথ্যসমৃদ্ধ লেখা পড়ে, শুধু মুগ্ধ হতে হয়। 🙏✒️