কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
স্পষ্ট করে সম্ভবত কোথাও বলা নেই। বলার প্রয়োজনও নেই, কেননা এ কেবল আর বিভ্রান্তিকর ধারণা নয় প্রায় ঈশ্বরে বিশ্বাসের মতো সর্বজনীন।পুরুষ যা পারে নারী তা পারেনা, ব্যতিক্রম কেবলমাত্র সন্তান ধারণের ক্ষমতা। পুরুষ সর্ব-শক্তিধর, সর্ব-প্রতিভাধর, মনুষ্য প্রজাতিতে যে কোনও ক্ষেত্রে যে কোনও মানদন্ডে নারীর চেয়ে প্রাগ্রসর। এ নিয়ে আবার তর্কের কী আছে? সূয্যিমামা রোজ পূব দিক দিয়ে ঘুম থেকে ওঠে , এ নিয়ে কি বিতর্ক হয়? সত্য বলেইনা কোনও কিছু স্বতঃসিদ্ধ হয়?
যদিও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা হোল, আদম-ইভের আবির্ভাব লগ্ন থেকে যা সত্য বলে স্বীকৃত তাতে কি ছিটেফোঁটা বদলও ঘটলনা? অবশ্যই ঘটেছে। সময় বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ময়দানে মেয়েরাও নেমে পড়েছে ‘ হাম ভি কুছ কম নেহি’ একথা প্রমাণের চেষ্টায়। কেউ কেউ অনেকাংশে সফলও হয়েছেন। অদম্য ইচ্ছেশক্তি, জেদ, দৃঢ়তা, বিরুদ্ধস্রোতে লড়াই, প্রবল চেষ্টা এবং নিষ্ঠা, শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা আর সাহিত্য ও সাহিত্যচর্চার প্রতি নিরলস অ-বাধ্য, অদমনীয় ভালোবাসায় অবশ্যই ফল মিলেছে, এখনও মিলছে, ভবিষ্যতে অনিবার্যভাবে আরও আরও মিলবে। হাতে ফিতে নিয়ে মাপা যায়না বলে দূরত্ব ঠিক কতটা কমল, বলা কঠিন।
এতো সহজে দুর্গম দূরত্বটি কমা সম্ভবও নয়। পুরুষ-শাসিত সমাজের তৈরি করে দেওয়া দৃশ্যমান চিনের প্রাচীর টপকে এগোনোর লড়াইটাও অনেক পুরোনো।বড়ো কঠিন অসম এক যুদ্ধ। সময় লেগেছে যুগ যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে প্রতিবাদের, অধিকারের এবং মুক্ত চিন্তার ক্ষমতার কলমটি আসলে মেয়েরা পেয়েছে অনেক পরে।
সাহিত্যে নারী পুরুষের অবস্থানের এই ব্যবধানের ছবিটির উৎস কিন্তু অনেক গভীরে। শিকড়টি খুঁজতে গেলে আমাদের অনেকটা পিছিয়ে সেই উৎসমুখে যেতে হবে। দৌড়ে কেউ যদি প্রথমে ল্যাপেই ৫০০ মিটার পিছিয়ে যায় তাহলে সমতাটা হবে কোথায়, কীভাবে? জীবনে এই পিছিয়ে পড়ার দুরূহ দূরত্বটি মেরামত করা যায় কখনও? এটা অসাধ্য শুধু নয় অসম্ভব, অবাস্তব। তবুও মেয়েরা সমস্ত মেয়েলিপনা কাটিয়ে সমস্ত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বাধা পেরিয়ে লেখকদের গন্ডীতে, লেখার মুক্ত আকাশে শক্ত, মজবুত, জোরালো, ধারালো, অকপট প্ল্যাটফর্মটি পেয়েছে। এতোটা ভঙ্গুর পথ অতিক্রম করে পুরুষের কলমের সঙ্গে মেয়েদের লেখনীর দূরত্বটি, অসাম্যটি কম করা বড়ো সহজ নয়। রুক্ষ অমসৃণ পথ ধরে মেয়েদের হাঁটা চলছে এখনও। প্রমাণ করতে হচ্ছে নিজেকে প্রতি পদক্ষেপে, কাঁটাছেঁড়া পরীক্ষা নিরীক্ষা আলো অন্ধকারের খেলা চলছে মেয়েদের কলমের, অস্তিত্বের লড়াই এখনও জারি। মেয়েদের আত্মানুসন্ধান চলছে, চলছে আত্ম উপলব্ধিও। তবে এখন আর পথ ততটা দুর্লঙ্ঘ নয়। কন্টকিত নয়। আবছা নয়। মেয়েদের কলমে এভাবে আলো আসুক বন্যার মতো।
মানতে কোনও দ্বিধা নেই শুধু সাহিত্য কেন, পৃথিবীর যে কোন বিষয়েই মেয়েরা পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, প্রযুক্তি, রাজনীত, অর্থনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা, যন্ত্রবিজ্ঞান, খেলাধুলো সব বিষয়েই। কিন্তু এর কারণ কী? মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব? অপারগতা? অক্ষমতা? দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক?
নাকি মেয়েদের অবদমন?
নাকি সমাজের মানসিক প্রতিবন্ধকতা?
নাকি নারীশিক্ষার প্রতি সমাজের উদাসীনতা এবং অবহেলা?
এই যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরুষ এবং মহিলাদের লেখা নিয়ে বারবার তুলনামূলকভাবে যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হলো সংখ্যায় মহিলা লেখক এতো কম কেন? এই প্রশ্নটির মধ্যে কোনও ভুল নেই। ছোট বড়ো নামী অনামী যে কোনও পত্রিকার সূচিতে চোখ বোলালেই সার সত্যটি আরও ভালো করে বোঝা যায়। কিন্তু কেন?
প্রথমে এর কারণগুলি অনুসন্ধান করা দরকার। সাহিত্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যা কেন এতো কম এবার সে বিষয়টি দেখা যাক। নারী শিক্ষার কথা বলতে গেলে শুরু করে শুরু করা যাক। শিক্ষা কী?
- শিক্ষা হলো শেখার একটি প্রক্রিয়া
- জ্ঞান অর্জন
- দক্ষতা
- মূল্যবোধ
- বিশ্বাস
- অভ্যাসের একটি প্রক্রিয়া
- অভ্যাসের একটি প্রক্রিয়া
মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারে জ্ঞান অর্জন এবং দক্ষতা দেখানোর অধিকার বা ক্ষমতাই ছিলনা একসময়। মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস সেই যুগে জন্ম থেকেই মেয়েদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো, তোমার জন্মই হয়েছে সংসারকর্মের জন্য এবং সন্তান প্রতিপালনে, তোমার জায়গা অন্তঃপুরে সংসারকর্মে তার বাইরে তুমি কিছু নও, কেউ নও। আজকের আফগানিস্থানে তালিবানি ব্যবস্থাটি যে রকম। সেকালে পুরুষসমাজ নারীদের অনেক প্রতিভাকেই অবদমিত করে রাখার ফলে সংসারের ঘেরাটোপে এরকম অনেক ইচ্ছে বা সৃষ্টির অপমৃত্যু ঘটতো। তবুও সন্তানদের প্রতিপালন করবার সময়, ঘুম পাড়ানোর সময় বা সংসারের নানাবিধ কাজের ভিতর অনেক মেয়েদের দুঃখের নিজস্ব স্বর গুনগুনিয়ে উঠতো কখনও কখনও। উচ্চবিত্ত এবং রাজ পরিবারের মেয়েদের কথা এইখানে বলছিনা কারণ শিক্ষালাভের অধিকার এবং স্বাধীনতা তাদের কিছুটা ছিল। নারীশিক্ষার কিছুটা চল তখন থাকলেও বাড়িতে শিক্ষক রেখে তাঁদের শিক্ষাদান করা হতো অন্তঃপুরে।
বিশেষ করে ভারতবর্ষে পুরুষদের অনেক অনেক পরে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার এবং স্বাধীনতা পেয়েছে। প্রায় ৫০০ বছর পর। তাঁদের প্রতিভার প্রসার এবং বিকাশ হয় অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে, অনেক যুদ্ধ করে।
এই প্রতিকূলতাগুলো কী কী?
- সামাজিক প্রতিকূলতা
- ধর্মীয় সংস্কারের বেড়া
- বর্ণ ও জাতপাতের প্রতিবন্ধকতা এবং
- দরিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই
আসলে নারী শিক্ষা অনেক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। নারীদের যুদ্ধটা আসলে ছিল নিজেদের সঙ্গে। শিক্ষা সহ সমস্ত ক্ষেত্রে। অন্তত আমাদের দেশে নারীশিক্ষার এই প্রতিকূল অবস্থা বহু বছরের সমাজের বেঁধে দেওয়া কিছু প্রবল অনিয়ম বা বেনিয়ম। বৈষম্যটি তাই আজকের নয়।(চলবে)
অপূর্ব, অপূর্ব 🙏🙏🙏🙏
‘ মসির অসম দ্বৈরথ ‘( ১) –শিরোনামে লেখাটি সুন্দর , ভাবনা উদ্রেককারী ও বিশ্লেষণধর্মী ।
বলা হয়ে থাকে — লিঙ্গবৈষম্য জৈবিক বা স্বাভাবিক নয় তা সামাজিক। অর্থাৎ তা মনুষ্যসৃষ্ট বা কৃত্রিম। তাই -‘মসি’ থেকে অসি হয়ে সমাজের সব ক্ষেত্রে পুরুষ বনাম নারীর লড়াই । লড়াই সমানে সমানে যাতে না হয় তাই অচলায়তন বজায় রাখার নানা ফন্দিফিকির ! শিক্ষা থেকে তাদের বঞ্চিত করে রাখো এই বলে — বেশি পড়লে মেয়েরা বিধবা হয়। ‘ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, ‘পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য ‘ইত্যাদি সুবচনে তাদের ভুলিয়ে রাখো। আর সন্তানপালন, ঘরগেরস্থালির কাজ, রূপচর্চাই নারীকে -” শ্রেষ্ঠ নারী ” করে গড়ে তোলে– সমানে এই পুলটিস মেয়েদের গেলানো হয়। তবে এই ভাবনায় মেয়েরাও সঙ্গত দেয় ( ব্যতিক্রমি বাদে )। এটিকে – ‘পুরুষবাদী দৃষ্টিভঙ্গী ” বলা হয় , যেখানে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু বলে বিবেচিত হয়।
পরিশেষে কবির কথানুসারে বলা যায় ‘….এমন কী লাঞ্ছনা আর নিগ্রহের ফলে মানুষের ( পড়তে হবে মেয়েদের ) দীপ্তি ও মহিমা আরও বেড়ে যায়. ..’।
বাঃ, চমৎকার লেখা। কস্তুরী অসম্ভব ভালো লিখেছেন। ওনাকে টুপি খোলা অভিনন্দন। একটা অনুরোধ আছে এই লেখাটি কি আমি কপি করে অন্য জায়গায় পেস্ট করতে পারি ? অনুমতির অপেক্ষায় রইলাম।
নিশ্চয়ই পোস্ট করবেন, মোট পাঁচটি পর্বতে লেখা এই বিষয়টি নিয়ে…
নিশ্চয়ই পোস্টটি শেয়ার করতে পারেন