কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
বেদের পরে মনু সংহিতা বলে যে ধর্মশাস্ত্রর সৃষ্টি হয়েছিল (ঋষি মনু প্রণীত) তাকেই হিন্দু সমাজ প্রধান ধর্মশাস্ত্র বলে মেনে থাকে। সায়ম্ভব মনু নাকি আদি মানব তাঁর সৃষ্টি হয় নাকি ব্রহ্মার শরীরের অংশ থেকে। তাঁর শোনা ব্রহ্মার শ্রুতবাণী নিয়ে রচিত হয় মনু সংহিতাকে হিন্দু আইনের আদি ভিত্তি বলে ধরা হয়ে থাকে। মনু সংহিতায় কিন্তু ছত্রে ছত্রে মেয়েদের প্রতি ঘৃণার কথা, মেয়েদের অপমান আর অবমাননা জড়িত কথা, বিধি নিষেধের কথা অত্যন্ত অশ্রাব্য এবং অকথ্য ভাষায় বলা হয়েছে। যা অত্যন্ত অসঙ্গত, ঘৃণ্য, অশ্লীল এবং অনুচিত বলে বহু জায়গায় লেখা হয়েছে। জাতিভেদের কথাও বলা হয়েছে। নারীশিক্ষা বর্জনের একটি জ্বলন্ত দলিল এই মনু সংহিতা। নারী শিক্ষার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হলে তাই মনুসংহিতায় নারীদের চরিত্র যেভাবে কলুষিত করা হয়েছে তার উল্লেখও করা প্রয়োজন।
মনুই নারীদের অন্তঃপুরে পরাধীন এবং নির্বাসিত জীবনযাত্রার পথিকৃত ছিলেন। বৈদিক রীতি অনুযায়ী গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষা থেকে মেয়েদের বঞ্চিত হতে হয় এই সময়েই। মনু এরকম অনেক অনাসৃষ্টি কান্ড মেয়েদের উপর, সমাজের উপর চাপিয়ে সর্বনাশটি করে গিয়েছেন। সমাজের সব স্তরের মেয়েদের কিন্তু শিক্ষা সহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে অবদমিত করে রাখা হতো।
সেই যুগেই বর্ণ ও জাতিভেদের কাল এলো। নারীদের শিক্ষা আরও বহুলাংশে নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। মহাকাব্যের যুগেও কিন্তু নারী বিদ্যাচর্চা করতেন। ২০০০ বছর আগে লেখা মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পন্ডিতা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তারপরেও বিভিন্ন যুগে , মৌর্যযুগ, গুপ্তযুগে নারীরা বেদ অধ্যয়ন করতেন, বৈদিক স্তোত্র, সংস্কৃত কাব্য, নাটক রচনা করতেন। কিন্তু সেসবই উচ্চবংশের বা রাজবংশের নারীরা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য নয়। দরিদ্র ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মেয়েদের কিন্তু বাইরের জীবন অনেকটা উন্মুক্ত ছিল। কথকতার আসর, কবিগান, পাঁচালি পাঠ এসব তারা শুনতো, অনেকে মুখে মুখে লোককবিতা লিখতও। যদিও শিক্ষার আলো তারা পায়নি সেযুগে। অক্ষর জ্ঞান এতটুকু ছিলনা তাদের। মুখে মুখে বলা তাদের সেইসব রচনা কেউ কোথাও লিখে রাখেনি বলে কালের স্রোতে সেসব হারিয়ে গেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে কিন্তু এমন বহু নারী ছিলেন যাঁরা লিখতে পড়তে এবং সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। আর পতিতাদের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ছিল শিক্ষার স্বাধীনতা ছিল।। সে যুগে এবং তার পরবর্তী বহু বছর ধরে দরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত নারীদের কিন্তু সেই সামাজিক স্বাধীনতা বা শিক্ষালাভের ক্ষমতাও ছিলনা। কাজেই পুরুষ এবং নারী লেখকের সংখ্যায় বিশাল ফারাকের সূত্রপাত তখন থেকেই।
সেই বৈষম্যের গভীরতা ধীরে ধীরে একটু একটু করে কমলেও আজও উল্লেখযোগ্যভাবে ভরাট হয়নি। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় বাধা, বর্ণভেদ, দারিদ্র্য ইত্যাদি বহু কারণের জন্য অবদমিত করে রাখা হতো তাঁদের প্রতিভা। এমনও বলা হতো, যে মেয়েরা লেখাপড়া করে তারা বিধবা হয়। প্রথম বালিকা বিদ্যালয় তৈরি হয় ১৭৬০ এর পর, ১৮১৮ সালে প্রধানত নিম্নবর্গের মেয়েদের জন্য। ১৮৪৯ সালে প্রথম স্ত্রীশিক্ষা প্রসারলাভ করে বেথুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর। সাহিত্য ক্ষেত্রে তখনই প্রথম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মেয়েরাও উচ্চবিত্তদের সঙ্গে অন্তরাল থেকে বাইরে আসেন। ঊনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ও স্ত্রীশিক্ষার সত্যিকারের প্রসার হয়।
এই মেল ডমিনেটেড সমাজে, বিশেষ করে আমাদের দেশে আরও একটি সুপ্রাচীন ভ্রান্ত সংস্কার অনেকের মনে বদ্ধমূল হয়ে বসে আছে। তা হোল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান কেবল সংখ্যাগত নয় গুণগতও বটে।অন্যভাবে বলতে গেলে পুরুষের হাতে কলম যেভাবে ডানা মেলে নারীর কাছে তা অসাধ্য। এই যে সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের সম্পর্কে ভাবনায় এহেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যবোধ তা এমনি এমনি হয়নি। এর উৎসে আছে আমাদের সমাজে মেয়েদের অবদমিত, অতি-প্রান্তিক অবস্থান। এমনকী শেক্সপীয়ার, কিটস, বায়রণদের দেশেও এই সেদিন পর্যন্ত কিছু কিছু অভিজাত ক্লাবের বাইরে লেখা থাকত— women and dogs are not allowed inside! (চলবে)