জাফনা এখন শুধুই স্মৃতি
(সুজিত সরকারের মাদ্রাজ কাফে সিনেমাটা মুক্তির পর এই লেখাটা লিখেছিলাম। আজও প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় ব্লগে শেয়ার করলাম)
আগাগোড়া বেশ ভালই এগোচ্ছিল৷ টানটান, কখনও-সখনও রুদ্ধশ্বাস৷ ভাল থ্রিলার যেমনটা হওয়া উচিত, আর কী৷ একশো সাতাশ মিনিটের শেষে, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে রক্ষা করার ব্যর্থতা ও স্ত্রী হারানোর দুঃখে শোকাতুর নায়ক যখন বিহ্বল পাদ্রিকে পুরো গপ্পোটা শুনিয়ে ফের হুইস্কির পাঁইটে চুমুক দেবেন বলে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ফিরছেন, দুগ্ধ-পাত্রে একটি ফোঁটা গো-চোনা পড়ে গেল তখনই৷ কথা নেই, বার্তা নেই, মাথা নেই, মুন্ডু নেই, অগ্র নেই, পশ্চাৎ নেই, হঠাৎ তিনি বিড়বিড় করে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’, ইংরেজিতে মুখস্থ বলতে শুরু করে দিলেন৷
বাঙালির কারবার৷ রবি ঠাকুরকে টেনে না আনলে তিনি রাগ করবেন না?
সুজিত সরকার আবার যে সে বাঙালি নন৷ ইংরেজিতে নিজের নামটা তিনি লেখেন “Shoojit”৷ চিত্রনাট্য দুই বঙ্গ-সন্তানের৷ আবার যে বিষয়টিতে যুগ যুগান্ত ধরে বাঙালির দুর্দমনীয় কৌতূহল ও বিশ্বাস, কাহিনির উপজীব্যও সেটাই৷ ষড়যন্ত্র৷ তাও যে সে ষড়যন্ত্র নয়৷ এক্কেবারে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে নিকেশ করার ষড়যন্ত্র৷ শেষ পাতেও তাই টিপিকাল বঙ্গজ মধুরেণ সমাপয়েৎ৷ ‘ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত৷’
ইন্টারনেটে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সব মার-কাটারি রিভিউ পাচ্ছে ‘মাদ্রাজ কাফে’, গপ্পো অনুসারে যেখানে নাকি রাজীব গান্ধিকে হত্যা করার ছক কষা হয়েছিল৷ এমন কোনও ফিল্মি-বোঝনদার নেই যিনি পঞ্চ-তারকার মধ্যে ছবিটিকে চার-তারকা দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেছেন৷ পরিচালক-প্রযোজক-সমালোচক সব কিছুকে মিলিয়ে হালফিলের ফিল্মি দুনিয়াটা এতটাই ঘোলাটে এবং টু-জি স্ক্যাম মার্কা যে, কে, কাকে, কেন, কী ভাবে তোল্লা দিচ্ছে বা দিচ্ছে না, তা ভালো করে বোঝার জন্যই গোয়েন্দা নিয়োগ করা প্রয়োজন৷ এই মরা কলকাতাতেও শুনতে পাই, ভালো রিভিউ পাওয়ার জন্য নাকি প্রভাবশালী কলমচিদের চামচাগিরি করাটা ‘মাস্ট৷’ ফলে যে ভাল লিখছে সেটা তার মনের কথা না পেটের ব্যথা, বোঝার কোনও উপায় নেই৷ সবটাই মায়া, প্রমোদার ছায়া৷
আমার ভালো লাগার কারণটি একেবারেই ব্যক্তিগত৷ ছবিটি দেখে দীর্ঘদিন পরে হলে বসেই বেশ স্মৃতির সরণি বেয়ে তরতর করে ফিরে যাওয়া গেল সিকি শতক আগে৷ ছবির শুরুতে যে সাদা-কালো স্টিলগুলি স্নায়ুতে ধাক্কা দিয়ে গেল সেগুলি আমার বড় পরিচিত৷ যেমন পরিচিত পালালি থেকে জাফনা যাওয়ার ওই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা, চলমান অ্যাম্বুলেন্স আর লড়ঝড়ে মিনিবাসগুলো৷ ওই রকমই একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে ভারতীয় রেড ক্রসের সদস্যদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমি জাফনা গিয়েছিলাম, যার সামনে ছিল টাইগারদের বিশাল বাইক বাহিনী৷ প্রত্যেকে তরতাজা যুবক, কারুরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়, কাঁধে অ্যাসল্ট রাইফেল, গলার মাদুলিতে সায়ানাইড ক্যাপসুল৷
এক রাতের জন্য উঠেছিলাম জাফনা শহরের সুনসান, প্রায় ভূত-উপদ্রুত জ্ঞানম হোটেলে৷ চোখের নিমেষে খবর পেয়ে তিন চার জন নেতা গোছের টাইগার সদস্য হোটেলে পৌঁছে গিয়েছিলেন৷ জনশূন্য রেস্তাঁরায় তারপরে আমাকে যে রকম হাড় হিম করা জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল, সিটি স্ক্যান যন্ত্রের তলায় শরীর গলিয়ে দিলেও ততটা তত্ত্ব-তালাশ হয় না৷ আমি সিংহলি খোচর নই, ‘র’-এর এজেন্টও নই, শুধু এইটুকু প্রমাণ করতে গিয়েই গায়ের গেঞ্জি আর অর্ন্তবাস ভিজে চপচপে হয়ে গিয়েছিল৷ কথা বলছিলেন প্রধানত একজন৷ চোখে চশমা, অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা৷ নির্ভুল ইংরেজি৷ প্রতিটি শব্দ মাপা৷ প্রশ্ন করছেন আর পাঁচ মিনিট পরে পরেই আমার স্মায়ুর মহড়া নিতে চাপা গলায় বলছেন, ‘‘উই ডোন্ট ট্রিট এনিমি এজেন্টস ভেরি ওয়েল ইউ নো৷ হোপ ইউ নো দ্য কনসিকোয়েন্সেস অফ ইওর অ্যাকশনস…….৷’’ অনেক পরে বরফ গললে, অবিশ্বাসের পালা চুকোলে জেনেছিলাম ছেলেটির নাম যোগী৷ টাইগারদের প্রচার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত৷ আর তাঁর পাশের হুকোমুখো মদ্দ ছেলেটির নাম মাহাতিয়া৷ বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার৷ ‘‘মাদ্রাজ কাফে’-তেও তাদের মতোই দু’জনকে দেখা গেল ব্যাঘ্রাধিনায়কের পাশে৷ গদ্দারির জন্য একজনকে বেঘোরে প্রাণটাও দিতে হল৷
সিনেমার বিদেশিনী সংবাদজীবী জয়াকে যেমন চোখ বন্ধ করে ‘আন্না’ সমীপে নিয়ে যাওয়া হল, আমার ক্ষেত্রেও হুবহু হয়েছিল তাই৷ তবে জয়ার মতো আমাকে অত জল-জঙ্গল ভাঙতে হয়নি, যোগীর মোটর সাইকেলের পিছনে চেপে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি পোঁছে গিয়েছিলাম প্রভাকরণের ডেরায়৷ তখন তিনি জাফনা শহরেরই একটি আটপৌরে বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন৷ সাক্ষাৎকারের অনুমতি ছিল না৷ দেখব আর সৌজন্য বিনিময় করে চলে আসব, এটাই ছিল ‘ বিশ্বনাথ দর্শনের’ অমোঘ শর্ত৷ সিনেমার জয়াকে দেখে যেমন আমার ভাল লাগেনি তেমনি ‘আন্না’-র মধ্যেও খুঁজে পেলাম না, রক্ত-মাংসের প্রভাকরণকে৷ স্বভাবের হিংস্রতা ফুটে উঠত না ব্যাঘ্রাধিনায়কের চোখে মুখে৷ বরং এমন একটি শান্ত, ধীরস্থির, নিরপরাধ ড্যাবাড্যাবা চোখের এক যুবক কী ভাবে এতটা নৃশংস হতে পারে সেটা ভেবেই বিভ্রম হত৷ অথচ ছবির আন্নাকে দেখে মনে হল যেন স্বাস্থ্যবান বীরাপ্পন৷ অবশ্য ভেলুপিল্লাইয়ের একটি ক্লোন খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?
আর জয়া? সংবাদজগতের সাক্ষাৎ কলঙ্কিনী পাতকী৷ সাংবাদিকতার মূলমন্ত্রে যিনি সত্যিই দীক্ষিত, গোয়েন্দাকে তথ্য দিয়ে, সোর্স দিয়ে সাহায্য করাটা তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে না৷ পেশাদার সাংবাদিক নিজের সূত্রকে রক্ষা করেন, কোনও প্রলোভন, কোনও চোখ-রাঙানিকে তিনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না৷ অথচ বিলিতি কাগজের সাংবাদিক তিনি, ‘র’-এর গোয়েন্দাকে সাহায্য করতে একটি টেলিফোন পেয়েই পরের বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি চলে এলেন, গোপন বৈঠক করলেন, এমনকী গোয়েন্দা সংস্থার মীরজাফরের ক্রিয়া কলাপের রহস্য ভেদে ব্যাঙ্ককের ঘিঞ্জি বাজারে কোথায় যেতে হবে, কোন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, কোন সোর্সের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তার সব হদিসই তিনি দিয়ে দিলেন৷ এই ছবি দেখে ভারতীয় তামিলদের একাংশ কেন বিক্ষুব্ধ হয়েছেন বুঝতে পারিনি৷ কিন্ত্ত সাংবাদিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে জন আব্রাহাম বা Shoojit সরকারের কাছে কেন একটিও প্রতিবাদ-পত্র জমা পড়ল না সে কথা ভেবে অবাক লাগছে বিস্তর৷
অবিশ্বাসের লৌহ-পর্দা একবার ভেদ করতে পারলে টাইগাররা কতটা বন্ধু হয়ে ওঠেন, ৮৭ সালে রাজীব গান্ধির দাদাগিরির অব্যবহিত পরে ভাগ্যক্রমে জাফনায় ঢুকে এবং বেরিয়ে এসে তার পরিচয় পেয়েছিলাম প্রতি পদে পদে৷ ফেরার সময় যে বাসটিতে বসে ইষ্ট নাম জপ করছিলাম তার ড্রাইভারকে যোগী বলে দিয়েছিলেন আমার কোনও অসুবিধে হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে যেন খবর দেওয়া হয়৷ দেখেছিলাম টাইগারদের নিয়ন্ত্রণাধীন সীমানা পেরোনোর পরেই কী রকম হেনস্থা আর অপমান হত সাধারণ তামিল যাত্রীদের৷ প্রতি কিলোমিটারে থামছে বাস, গরু-ছাগলের পালের মতো এক দিক দিয়ে সবাইকে নামিয়ে, বডি-সার্চ করে, চারটে গালাগালি দিয়ে ফের অন্য দরজা দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ পালালি বিমানবন্দর পৌঁছনো পর্যন্ত বারংবার এই দৃশ্য দেখার পরে বুঝতে পেরেছিলাম কেন এখানকার যুবকেরা লেখাপড়া ছেড়ে বন্দুক ধরে, আর কেনই বা এত হিংস্র হয়েও এলটিটিই এত জনপ্রিয়৷ কেনই বা থাম্বি (প্রভাকরণকে এই নামেই ডাকত জাফনা) তাঁদের নয়নের মণি৷
শিল্পকে জীবনের প্রতিচ্ছবি হতে হবে এমন কোনও কথা নেই৷ ফলে Shoojit সরকারের কাছ থেকে সেই কৈফিয়ৎ চাওয়াটাও অর্থহীন৷ তাছাড়া আত্মপক্ষ সমর্থনে পরিচালক সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়ে দিয়েছেন এটি রাজীব গান্ধির বায়ো-পিক নয়৷ ছবির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজীবের চেহারার আদলে কেউ যদি মিল খুঁজে পান, সেটা নেহাতই কাকতালীয়৷ এ তো অনেকটা ঠাকুর ঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি গোছের ব্যাপার৷ শ্রীলঙ্কায় তামিল জাতি-দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবি৷ এই দাঙ্গায় হস্তক্ষেপ করার ফল স্বরূপ অন্য কারও নয়, একমাত্র রাজীব গান্ধিকেই হত্যা করা হয়েছিল৷ এবং এমন একটা সময়ে যখন তিনি সত্যিই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী৷ ঘটনাস্থল এক, উপলক্ষ এক, মানবী-বোমার চেহারা এক এমনকী সময়টিও এক৷ বাস্তবের ঘটনাবলির সঙ্গে ছবির ঘটনাবলির সাদৃশ্যগুলি অতএব কাল্পনিক হতে পারে না। দিন-ক্ষণ, নাম-ধাম সামান্য বদল করলেই সত্য উত্তীর্ণ হয় না কল্পনার স্তরে৷ ‘মাদ্রাজ কাফে’ অবশ্যই তথ্য-চিত্র নয়, রাজীবের বায়ো-পিকও নয়, তবে তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনের অন্তিম পর্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই তৈরি৷
বাস্তবকে চলচ্চিত্রকার কী ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা একান্ত ভাবেই তাঁর ব্যাপার৷ স্বীকার করতেই হবে Shoojit এ কাজটি একেবারে টাইগারদের মতোই করেছেন৷ সু-পরিকল্পিত, সুগ্রথিত, আঁটোসাঁটো, সংযম ও মাত্রাজ্ঞানের লক্ষণরেখার এপারে সীমাবদ্ধ৷ সবার উপরে এমন একটি ছবি তৈরি করেছেন, যা দেখতে থাকলে ব্লাডারের টনটনানিও উপেক্ষা করে দিব্যি বসে থাকা যায়৷ সব কিছুর ওপরে ‘মাদ্রাজ কাফে’-র বড় সাফল্যটা এখানেই৷
তবে ইতিহাসে আরও এমন কিছু বাকি থাকে যা ছবিতে ধরা পড়ে না, হয়তো তার প্রয়োজনও নেই৷ তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে রাজীব গান্ধি ভুল করেছিলেন অজস্র, শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সংসদের গরিষ্ঠতা ব্যবহার করে উল্টে দেওয়া, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের তালা খোলা, বফর্স কেলেঙ্কারি নিয়ে অনর্গল পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা, নেপালকে অবরোধের মধ্যে ফেলে দেওয়া…..৷ এ সবের চেয়েও তাঁর মারাত্মক এবং আত্মঘাতী ভুলটি ছিল শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযথা নাক গলিয়ে প্রথমে দেশকে বিড়ম্বনায় ফেলা এবং সবশেষে বেঘোরে নিজের প্রাণটি দিয়ে সেই ভুলের মূল্য চোকানো৷ ১৯৮৪ সালে স্বর্ণ-মন্দিরে সেনা অভিযানের আদেশ দিয়ে যে ভুলটি করেছিলেন তাঁর মা, ইন্দিরা৷
দ্বীপভূমির রক্তস্নাত গৃহযুদ্ধের একটি বড় কারণ যদি হয়ে থাকে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে তামিলদের বঞ্চনাবোধ, তাহলে দ্বিতীয় কারণটি ছিল দিল্লির হস্তক্ষেপ, যার সূচনা করেছিলেন ইন্দিরা আর অবিশ্বাস্য বিন্দুতে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজীব৷ সে সময় চেন্নাইয়ে গিয়ে দেখেছি এলটিটিই সহ জাফনা তামিলদের প্রায় সব কয়টি সংগঠন বহাল তবিয়তে সেখানে যে যার মতো করে অফিস খুলে বসে পক প্রণালীর ওপারে লঙ্কা ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে৷ তাদের টাকা পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র সবই দিচ্ছে ভারত সরকার৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাকি সব কয়টি নিশ্চিহ্ণ করে দিয়ে জাফনায় নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কায়েম করেছিল টাইগাররা৷ সে কাজেও ভারত কখনও তাদের বাধা দেয়নি৷ পঞ্জাবে ভিন্দ্রানওয়ালের মতো ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণও ছিলেন নয়াদিল্লির ফ্রাঙ্কেনস্টিন৷
রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসিদের ওপর যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী বা প্রদেশ সভাপতি চাপিয়ে দেওয়া হত, এক্কেবারে সেই স্টাইলে ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রভাকরণের ওপর৷ চুক্তির অব্যবহিত পরেই জাফনায় এক জনসভায় দাঁড়িয়ে তার বিরোধিতা করতে শুনেছিলাম প্রভাকরণেকে৷ স্বচক্ষে দেখেছি অস্ত্র-সমর্পণের প্রশ্নে টাইগাররা কার্যত কোনও সহযোগিতাই করেনি শান্তি ফৌজের সঙ্গে৷ বিভিন্ন ছাউনিতে ফৌজিরা সারা দিন বসে মশার কামড় খেতেন আর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতেন কখন একজন এসে তাঁর সাধের অস্ত্রটি তাঁদের হাতে তুলে দেবেন৷ কেউ আসত না৷ ক্কচিৎ-কদাচিৎ দু’একটি বালক এসে জং ধরা পিস্তল-টিস্তল জমা দিয়ে দিত৷ এই রকম একটা পরিস্থিতিতেও যদি রাজীব সেনা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন হয়তো কিছুটা মুখ রক্ষা হত৷ কিন্ত্ত তিনি আগ বাড়িয়ে টাইগারদের বিরুদ্ধে কলম্বোর যুদ্ধটাকে টেনে নিলেন নিজের কাঁধে৷ জনবসতি আর জলে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা প্রতিজ্ঞাব্ধ গেরিলাদের সঙ্গে যুঝতে ল্যাজে গোবরে হল ভারতীয় ফৌজ, কয়েকশো জওয়ান বেঘোরে মারা গেলেন, অনেক দূরে কলম্বোয় বসে তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করল সিংহলি সরকার৷ সবক শেখানো গেল না টাইগারদের, শান্তি ফিরল না দ্বীপভূমিতে, এপারে তামিলনাড়ুতে দিল্লি বিরোধী ক্ষোভ ক্রমশই দানা বাঁধতে থাকল৷ শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় এসে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং জওয়ানদের ফিরিয়ে আনলেন দেশে৷
রাজীব হত্যার ষড়যন্ত্রের কাজে এ দেশে টাইগাররা যদি অনায়াসে ‘মীরজাফর’ খুঁজে বের করে থাকতে পারে তাহলে সেটা এ জন্যই৷ যদিও এত তদন্ত, এত বিচারের পরেও ষড়যন্ত্রের সব কয়টি রহস্য ভেদ করা যায়নি এখনও৷ রাজীব হত্যার অব্যবহিত পরে বিভিন্ন মহল থেকে নাম উঠেছিল গডম্যান চন্দ্রস্বামীর৷ যে ‘মাদ্রাজ কাফে’-তে বসে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছিল সেখানে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি এই বিতর্কিত সাধুবাবাকেই মনে করিয়ে দেন৷ কিন্ত্ত ষড়যন্ত্রী সাহেবটি কে, কোন দেশের, কেনই বা সে রাজীবকে মারতে টাকা-পয়সা দেবে, অস্ত্রশস্ত্র পাঠাবে কিছুতেই বোঝা গেল না৷ গোয়েন্দা নায়কের একটি অস্পষ্ট সংলাপে প্রচ্ছন্ন ভাবে বোঝা গেল ভারতের বাজার ধরতে চাওয়া বহুজাতিকদের যোগসাজশ আছে এই সংলাপে৷
তার মানে একটাই৷ যেখানেই কেন নোংরা কর না, বাতাস তবুও ডাকবে৷ স্বর্গে যাও বা নরকে, ঢেঁকিও ধান ভাঙবেই৷ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত খুঁজে না পেলে কি কোনও বাঙালি বাবুর রসনা তৃপ্ত হয়? হতে পারে?