মনে করো আমি নেই
অলোকপর্ণা
রবীন্দ্রনাথ যদি না জন্মাতেন, বাঙালির যা হাল, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতো দেওয়ালের টিকটিকিদের, যারা সারা বছর রবিচ্ছবির পিছনে আত্মগোপন করে এবং ২৪শে বৈশাখের রাতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
এ ছাড়া বিশেষ ক্ষতি কারও হতো না। কারণ রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আর কারও মাথার ছাদ এমন রাতারাতি উধাও হয়ে যেত না। আমরা শুনতাম নজরুল সঙ্গীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (তাঁর মোহর নামটি গায়েব হতো), সুচিত্রা মিত্র এবং লোকসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গান। রামকিঙ্কর বেইজ নামক জনৈক মৃৎশিল্পীর তৈরি দুর্গা ঠাকুর দেখার জন্য বীরভূম, বাঁকুড়ার মানুষ ভিড় জমাত স্থানীয় সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে। নন্দলাল বসু কলকাতায় বসে শহুরে ছবি আঁকতেন। এঁদের কারও অস্তিত্ব বিপন্ন হতো না কখনও।
রান্নাঘরে মা হয়তো বা অতুলপ্রসাদী গুনগুন করতেন। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ নেই, সেহেতু জীবনানন্দই হয়তো লিখে ফেলতেন — আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। নিজস্ব আলপথ খুঁজে বের করার কোনও তাগিদ তাঁর থাকত না। সি ভি রমন প্রথম ভারতীয় হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেতেন। অমর্ত্য সেন (তাঁর নাম বলাবাহুল্য অমর্ত্যর পরিবর্তে অন্যকিছু হতো) নোবেল না পাওয়া পর্যন্ত বাঙালি নোবেল নিয়ে খুব একটা উৎসাহী হতো না। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে বিশ্বভারতীও থাকত না। ‘উঠল বাই শান্তিনিকেতন যাই’ ব্যাপারটাও কম হতো। জায়গায় জায়গায় রবীন্দ্র মঞ্চ, রবীন্দ্র ভবনের পরিবর্তে বিদ্যাসাগর মঞ্চ, বঙ্কিম ভবনের সংখ্যা বাড়ত। রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যের মহড়ায় এসে কোনও রঙ্গনের প্রেমে পড়ত না কোনও নন্দিনী। মধুকবির ছবি বেশি বেশি দেখা যেত সরকারি স্কুল, কলেজ, অফিসের দেওয়ালে। বিবেকানন্দের প্রভাব বেড়ে গিয়ে বাঙালি হিন্দু অপেক্ষাকৃত বেশি ধার্মিক হতো। রবীন্দ্রনাথ না-থাকলে বাংলার রাজনীতি ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দুত্ববাদী হতো। অমলতাসের নাম থেকে যেত বাঁদরলাঠি, আকাশবাণীর নাম হতো অন্য কোনও কিছু। আল্ট্রা ভায়োলেটকে কেউ অতিবেগুনী নামে জানত না, না হতো ইনফ্রারেড-অবলোহিত। আজও অসংখ্য হিন্দু বাঙালি শিশু নাম পেত মোক্ষদা, জ্ঞানদা কিংবা দুর্গাচরণ, নন্দদুলাল। কারণ বাঙালির নাম নিয়ে ছুৎমার্গ কমত যদি রবীন্দ্রনাথ না থাকতেন।
নব্বইয়ের দশকে কেবল ‘জাতীয় কবি’ নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালন হতো পাড়ায় পাড়ায়। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হতো ‘বন্দে মাতরম’। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত সম্ভবত ‘ধনধান্যপুষ্প ভরা’। অথবা হয়তো বাংলাদেশই জন্মাত না। কারণ রবীন্দ্রনাথের তুমুল প্রভাব না থাকলে যদি ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বিফল হতো, কলকাতা গিয়ে পড়ত খুলনা, যশোরের সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে। ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হতো না। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমরা দেশের রাজধানী হিসেবে কলকাতা শহরকে চিনতাম। কলকাতার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেত। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ সফল হলে ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের সময় হয়তো বাংলাকে পুনরায় টুকরো করা হতো না। ফলত পূর্ব পাকিস্তান এবং কালক্রমে বাংলাদেশ গঠন হতো না। অসংখ্যা বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম পরিবার উদ্বাস্তু হতো না। ১৯৫০ এর দাঙ্গা অথবা ১৯৭১ এর ভাষা আন্দোলনের প্রসঙ্গও আসত না। অগুনতি বাঙালি প্রাণ বাঁচত। এমনকী হয়তো ধানমন্ডি-৩২ এর হত্যাকাণ্ডটিও ঘটত না।
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়েরা নাটকের মঞ্চে উঠতেন দেরিতে। হারমোনিয়ামের বিক্রি কম হতো। সন্ধের নিঝুম অন্ধকারে পাড়ার রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কারও অপটু গলায় শোনা যেত না, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’। বাঙালির কোনও ২৫শে বৈশাখ হতো না, না হতো কোনও ২২শে শ্রাবণ। বাঙালি আর একটু উদাসীন হয়ে পড়ত ভাষার প্রতি। প্রেমে পড়লেই বাঙালির কবিতা লেখার বাতিক কমত। আবার সেই প্রেম ভেঙে গেলে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত সে খুঁজে পেত না। গীতবিতানের অস্তিত্ব না থাকলে, আরও ব্যাপক ভাবে বললে রবীন্দ্রসাহিত্যের অস্তিত্ব না থাকলে রবীন্দ্রসাহিত্য পরিপন্থী ধারাগুলোও থাকত না।
আগেই বলেছি, রবীন্দ্রসাহিত্য না থাকলে জীবনানন্দ হয়তো ‘বনলতা সেন’, ‘আট বছর আগের একদিন’ অথবা ‘হাওয়ার রাত’ কখনও লিখতেন না। না লিখলে বাংলা সাহিত্যের সমান্তরাল ধারাটির গতিপথ প্রবল ভাবে বদলে যেত।
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে ভারতীয় রাজনীতিতে সাদা দাড়ির ব্যবহার দেখা যেত না, রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ভুল কবিতাপাঠও শুনতে হতো না। ট্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে মানুষ নজরুলগীতি শুনত। অসংখ্য বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালককে অন্যত্র যেতে হত গল্পের সন্ধানে। সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ তৈরি করতেন না, ‘চারুলতা’ তৈরি হতো না। ‘যুক্তি তক্কো গপ্প’-তে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ শুনতাম না কেউ।
পরিশেষে বলি, যেহেতু আমরা সর্বতো ভাবে অস্তিত্ববাদী, কারও না থাকা আমাদের ধারণার বাইরে।
বাংলায় “বি ভার্ব” এর ব্যবহার নেই এবং তা অযৌক্তিকও। কারণ আমি বা আমরা সবসময় আছি। কাজেই রবীন্দ্রনাথ না থাকলে কী হতো, তা আন্দাজ মাত্র করা চলে, তার বেশি ভাবা- সাহসে কুলোয় না। তবু একটি প্রজাপতির পাখা নড়ে উঠে যদি তুফান তুলতে পারে, তবে চুপিচুপি বলি, দেশভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান না জন্মালে আমার মা এবং বাবার পরিবারদুটি কাঁটাতার পার করে পশ্চিমবঙ্গে আসতেন না, তাঁরা একে অন্যকে চিনতেনও না। অতএব তাঁদের বিবাহ এবং আমার জন্ম- প্রশ্নাতীত। কাজেই, রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আর কিছু হোক না হোক, আমি হয়তো হতাম না – এটুকু ভেবে ফেলে শিউড়ে উঠি এবং যেহেতু প্রবল আত্মকেন্দ্রিক,- এর চেয়ে বেশি ভাবার স্পর্ধা দেখাতে পারি না।