উহারা ইনসোমনিয়াক
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
‘এ সব ক্ষেত্রে এমনই হইয়া থাকে। মনটা আনচান করিয়া ওঠে। কু ডাকে। বলে নিশুতি রাতে পাড়ায় বেড়াইতে নাই। আমাদের পাড়াটা বীরভূম লাগোয়া বোলপুর শহরে। অচেনা ঠেকিতে পারে। অবশ্য এমনটি হওয়াও বিরল নহে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ঠাকুর পরিবারের এক প্রজ্ঞা এখানে একটি জমি পত্তন করেন। একটি বাড়িও করেন। সঙ্গে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র ক্বচিৎ আসতেন। নিভৃতাবাস। আবার চলিয়াও যাইতেন। স্থানীয় তিনপাহাড় সংলগ্ন একটি বাগিচায় ধ্যানমগ্ন হইতেন। ব্যাপারটির এইখানেই ইতি। ইহার পর আর বিস্তার লাভ করে নাই। আমাদের ভাষার মতো। বঙ্কিমবাবুর পর এক আকাশ হইয়া, অভিভাবক হইয়া তেমন কেহই আর আসিল না। বাংলা ভাষার ঝুঁটি ধরিয়া কহিল না, ইহা লেখ, ইহাকেই বলে ভাষা, ভাব, কলম, জোর, লিখিবার জোর …
জোর নিয়া কথা হইতেছিল। উহারা বলে আমি নাকি একটি সমান্তরাল পৃথিবীতে চক্কর করিতে করিতে এইসব আওড়াই। এই সব মানে কোন সব? আচ্ছা, ধরুন, ঠিক পঞ্চাশ, আহা, কিঞ্চিত বাড়াইয়া শ’খানেক বৎসর পর আমার এই লেখাখানি কেহ পড়িবেন? ‘কৌতূহল ভরে?’ আহ, মনটা আবারও কেমন যেন কাঁদিয়া উঠিল। কহিল, কোথায় যেন শুনিয়াছি, কাহারও যেন বলার কথা ছিল এই সব … নাহ। তালগোল পাকাইতেছে। তিনপাহাড়ের নিকটে একটি তালগাছ দেখিয়া দাঁড়াইয়া পড়ি। মনে হয়, বৃক্ষ যেন প্রেত হইয়া আছে। মনে হয়, কোনও এক বাটিকার সুডৌল আচ্ছাদন বৃক্ষটিকে অমর করিয়া রাখিতে পারিত। হইল না। বুকটা হুহু করিয়া ওঠে। নিকটে একটি শালিখ ডাকিয়া ওঠে। মনে হয় আমি বড় একাকী। যাহারা নিকটে যাইতেছে, পাশ দিয়া ফিরিয়া তাকাইতেছে না, তাহাদের ভালো হউক। আমি কাটাইয়া আসি। প্রসঙ্গ হইতে প্রসঙ্গান্তর। রাজনীতি। সম্মুখ দিয়া ঢক্কানিনাদ করতে করিতে একটি দল প্রচার চালাইতেছে। কারা জিতিয়াছে, কারা পরাজিত বোঝার উপায় নাই। সে পথ বন্ধ। দক্ষিণের দিকে কিছু আমগাছ রহিয়াছে। একা হাঁটি। মুকুল ফুটিয়াছে। শোনা যাইতেছে, আম হইলে ভাগাভাগি হইবে দুইটি দলের মধ্যে। যাহারা পৃথক বলিয়া মনে করা হইলেও পরে জানা যায় উহারা এক। সে যাহাই হউক, আমার এই কতিপয় দু’একটি বৃক্ষের সামনে নিজেকে আবারও একাকী মনে হয়। দূরে একটি যুবক একা বসিয়া আছে। মুখে নিমের ডাল, অঙ্গুলির সহিত একটি ফোন আটকাইয়া ধরিয়া আছে। পাশ দিয়া এক তরুণী সাইকেল চালাইতে চালাইতে হিন্দি গান শুনিতেছে। আবারও কাতর হইয়া উঠি। মনে হয় কিছু কি বিস্মরণ করিয়া গিয়াছি? মনে হয়, এই নিভৃত কুঞ্জে শান্তি, একটু শান্তি বড় বেশি লোভনীয় ছিল না? মেয়েটি ছেলেটির পাশে মাথা রাখিয়া কহিতে পারিত না, বিবাহের কথা? ছেলেটির প্রত্যুত্তর হইত না, বাসর রাত্রি রচিব না মোরা প্রিয়ে …? আহ। আবারও সেই বৈদ্যুতিক তরঙ্গ। যেন কথাগুলি বলা হইয়াছে। আমি সময়জ্ঞানে ভুল স্থানে নিক্ষিপ্ত হইয়াছি। বারংবার কেন এমন হয়? কেন, কেন হয়?
ঠিক করিয়াছি, এ সব ডিলিউশন হইতে বাহির হইয়া যাইব। বোলপুর হইতে নিকটবর্তী একটি স্টেশনের সন্নিকটে একটি ক্যানেল পড়ে। সেটিকে ঘিরিয়া তিন চারটি রাস্তা তিন চারদিকে বাঁকিয়া গিয়াছে। উহাদেরই একটির শেষ প্রান্তে নদীবক্ষ ভাঙ্গিয়া অদ্ভুত এক আকার ধারণ করিয়াছে। শীত পড়িলে, ঘোর সকালেও যাইতে ভয় হয়। কান চাপাইয়া থাকি। বলা হয়, কলকাতা হইতে শুধু ওই নদীবক্ষের ভাঙ্গন দেখিবার নিমিত্ত এখানে লোকসমাগম হয়। হিড়িক পড়িয়া থাকে প্রায়ই। হোটেল ব্যবসা যাহা হইয়াছে, সবকটিই ওই প্রকৃতি আর নিকটবর্তী কিছু আদিবাসী গ্রাম সংলগ্ন মানুষকে ঘিরিয়া উৎসাহের নিমিত্ত। তাহাদের দিয়া নাচানো হয়, ছবি তোলা হয়, মিশিয়া দু’একটি কথাও বিনিময় হয়, জীবন বিনিময় হয় না – ‘যেন তাহাদের সহিত কাহারও যোগ ছিল না’। আমার মনে হয়, এত সব বাহুল্যের বাহিরে যাইয়া সারা রাত্রি ওই নদীবক্ষে বসিয়া থাকি। শাল, পলাশ, মহুয়ায় মাতাল হইয়া থাকি। শৃগাল, যদি আদৌ বাঁচিয়া থাকে কোথাও না কোথাও, যেন ডাক শুনিতে পাই। যেন মাদল বাজে দূরের কোনও রুক্ষ গ্রামে। রাত্রি সাঙ্গ হয়। আলো আসে। সূর্যোদয়। ‘তুমি কোন দেশ অন্ধকার করিয়া এখানে উদিত হইলে? কোনখানে সন্ধ্যা হইল …?’
মনে মনে ফিরিয়া আসি এ সময়ে। কিয়ৎকাল পূর্বেই দোল উৎসব হইয়া গেল। বড় বেদনার এইসব। বর্ধিষ্ণু এসব মফঃস্বলে বড়ই বাঁদুরে রঙের হিড়িক। বাঁচিবার, বাঁচাইবার, জো নাই। মনে হয়, অন্য কিছু হইলে ভালো হইত। অন্য কিছু। খোলা কোনও প্রাঙ্গণে হইহই দোল। ‘পরানে ছড়ায়ে আবীর গুলাল …’। অসভ্যতা নাই, অশ্লীল উদ্দামতা নাই, শুধুই প্রাণের দোল। রঙ মিলিয়া যাইত রঙে। প্রাণ মিশত প্রাণে। এমন কোনও উৎসব, আহা, কাহারও মাথায় আসিল না? শীত পড়িলে তেমন একটি উৎসব এখনও হয় যদিও। তবে লোক হয় না বিশেষ। ওই যে ব্রাহ্ম উৎসব বলিয়া কী যেন শুরু হইল তেতাল্লিশ, অর্থাৎ, আঠারোশ’ তেতাল্লিশে, সেই বৎসর হইতে সেই দিবসকে ঘিরিয়া একটি হাট এখনও বসে বটে বোলপুরে, তবে জমে না। মিসিং লিঙ্ক, কেবলই মনে হয়, একটি মিসিং লিঙ্ক রহিয়া গেছে। এ শহরের, এ জাতির প্রাণে, মনে, আত্মায়। উহারা আরাম পাইতেছে না। কাহারও ছবির পাশে, নামের পাশে, বিলীন হইয়া যাওয়া আত্মার পাশে উহাদের শান্তিতে ঘুম আসিছে না। উহারা ইনসোমনিয়াক …
তিনপাহাড়ের সন্নিকটে কিছু ইস্কুলঘর। ইংরাজি কিছু বিদ্যালয় দেখিয়া চোখ ঝলসাইয়া যায়। শিশুরা বেড়াইতে পারে না, আকাশের সহিত, মাটির সহিত, বৃক্ষের সহিত তাহাদের কোনও সম্পর্ক নাই। তাহারা বড় হইবে খুব, বিদ্বান হইবে ঢের, মানুষ হইবে তো? সন্দেহ হয়। রুক্ষ মাটির চারপাশে কংক্রিট গজিয়াছে। ফাংশন হইতেছে। বাড়িতে থাকিতে পারি না। ইদানীং অতিমারী আসিয়াছে। শ্বাস লইতে পারি না। বুকের কাছে হাপরের ন্যায় ওঠানামা করে। কীসের ব্যাধি? কীসের রোগ? রাজনীতি বলিয়া কিছু নাই, আদর্শ বলিয়া কিছু নাই, বিবেক বলিয়া কিছু নাই, এরা মুখ ঢাকিয়া কোন পরজীবীকে প্রতিহত করিবে? ‘মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে’। আবারও শক মারিল। মনে হইল, কেহ কথা বলিতেছে ভিতরে, যেন মিডিয়ার ন্যায়। প্ল্যানচেটের কথা শুনিয়াছি বটে, দেখি নাই। নিজেকে মিডিয়া মনে হইতেছে। মাধ্যম। কীসের মাধ্যম? পাশ দিয়া বৃক্ষের আর্তনাদ। বোলপুর-বীরভূমের অসংখ্য বৃক্ষ কাটা হইতেছে। উন্নয়ন হবে। খেলা হইবে। কেহ বাধা দিবার নাই। জড়াইয়া ধরিয়া বলার নাই – ‘তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ’। মনশ্চক্ষু মুদিয়া দেখিতে পাই ছোট ছোট শিশু, পরনে পাঞ্জাবি, মস্তকে মুকুটের নকশা, ললাটে টিপ। অপরূপ সুশ্রী একদল কন্যার হস্তে জলের পাত্র, ধূপদানী, মাটির তাল, মৃত্তিকা। মনে হয় উহাদের কথাই ঠিক। আমি যেন বাস্তবিকই অন্য এক সমান্তরাল পৃথিবী থেকে পড়িয়া গিয়াছি। কোথাও আসি নাই। যেন ঝুলিয়া আছি। কিছু যেন মনে করিতে পারিতেছি না। এই কংক্রিট, এই কুৎসিত শব্দ, এই নিরানন্দময় বর্ষা, প্রাণের স্পর্শ না থাকা অবান্তর উৎসব এইসব থাকিবার কথা ছিল না। অন্তত স্মৃতির জন্য, সান্ত্বনার জন্য কিছু যেন, কেহ যেন, খুব বড়সড় কেহ যেন বাদ পড়িয়া গিয়াছে সিলেবাসে। যেন এই অতিমারী, এই অসুখ বহুদিনের। কিছুর ভয়ে শিক্ষা বন্ধ, ক্লাস বন্ধ। জাতির শিক্ষক বলিয়া কেহ নাই। জাতি ফেল করিয়া চলিয়াছে বৎসরের পর বৎসর …’
লেখাটি এখানেই শেষ। একটি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে প্রকাশ – শান্তিনিকেতনের পাঁচিল তোলার কাজে কিছু পুরনো খননকাজ হচ্ছিল, পুরনো বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল। সেইসব ধংসস্তূপ থেকেই পাওয়া গেছে। প্রথমদিকে কর্তৃপক্ষ থেকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল ঘটনাটি। একটি সাজানো-গোছানো রুপোলি খাতা। পৃষ্ঠাটি অবিকৃত। লেখকের নাম নেই।
তবে ফেসবুকে সংগৃহীত বলে ভাইরাল হয়েছে খুব …