27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

দর্শন নেমে আসুক জনতার সরণিতে

Must read

বিশেষ সংবাদদাতা: ক্যামেরা চলছে। সামনে, টেবিলের এপারে আমেরিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার বিল ময়ার্স, ওপারে বিশ-শতকের বিশ্ব-সংস্কৃতির তাবড়-তাবড় ব্যক্তিত্ব, এক একদিন এক একজন। কে নেই সেই তালিকায়? আইজাক অ্যাসিমভ থেকে নোয়াম চমস্কি, মার্থা নাসবম থেকে চিনুয়া অ্যাচিবে। দিকপাল বোদ্ধা, দার্শনিক, তাত্ত্বিক, লেখকদের  সঙ্গে আলাপচারিতা। ১৯৮৮ সালে মার্কিন টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিকটি প্রযোজনা করেছিলেন ময়ার্স। এমন দৃপ্ত প্রাণিত শাণিত কথোপকথন সম্বলিত অনুষ্ঠান আমেরিকার দূরদর্শনে সেই প্রথম। পরের বছর সাক্ষাৎকারগুলিকে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশিত হয় সংকলন ‘বিল ময়ার্স আ ওয়ার্ল্ড অফ আইডিয়াজ’।

বৈদগ্ধে, উজ্জ্বলতায় প্রতিটি কথোপকথনই এক সে বড়কর এক। তবু আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে মার্থা নাসবমের সাক্ষাৎকারটি। গভীরতা, তীক্ষ্ণতায় সেরা, সমকালকে অতিক্রম করে সর্বকালের ব্যাপ্তিকে ছুঁয়ে যাওয়া হীরকখণ্ড এক। মার্থা নাসবম স্বনামধন্য দার্শনিক, এ সময়ের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।

সাক্ষাৎকারটির ঠিক আগে আগেই প্রকাশিত হয় তাঁর আলোড়ন-ফেলা স্পর্ধিত রচনা ‘দ্য ফ্র‍্যাজিলিটি অফ গুডনেসঃ লাক অ্যান্ড এথিকস ইন গ্রিক ট্র‍্যাজেডি অ্যান্ড ফিলজফি।’

নাসবমের অনন্য দর্শন এবং অসামান্য জীবনবোধটি তুলে ধরেন ময়ার্স তাঁর প্রারম্ভিক বক্তব্যে। আলাপচারিতা এগোয় স্বচ্ছতোয়া নদীর ছন্দে।

ময়ার্সঃ গড়পড়তা মানুষ দার্শনিক বলতে যা বোঝে তা আপনার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। আপনি নিছক বিমূর্ত ভাবজগতের বাসিন্দা নন, পুরাণ, লোককথা, উপকথাও আপনার চেতনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে রয়েছে।

নাসবমঃ শুধু গুরুত্বপূর্ণ বললে উনকথন হবে। দর্শনশাস্ত্রের ভাষাকে দুর্বোধ্যতার গজদন্তমিনার-চূড়া থেকে দৈনন্দিন ভাষা ও জীবনচর্চার গভীর, বৈচিত্র‍্যময় সাধারণত্বে নামিয়ে আনার পক্ষপাতী আমি। মানুষের কথা বলার ভাষা, তার চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা গল্প উপন্যাস লোকগাথায় যেমন ভাবে ফুটে ওঠে, তেমনটি আর কোত্থাও নয়।

ময়ার্সকে তিনি বলেন, এ মরজগতে ভালো থাকার অর্থ অনিশ্চয়তাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকা, প্রতি মুহূর্তে। শঙ্খ ঘোষ বোধহয় একেই বলেছিলেন, ‘ছিল, নেই/ মাত্র এই।’ শুধু শারীরিক ভাবে নয়, নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য কোনও শক্তি আমাদের আত্মাকে দুমড়েমুচড়ে দিতে পারে  যে কোনও মুহূর্তে, ধ্বংস করে দিতে পারে আমার নৈতিক স্থিতিকেও। এই সম্ভাবনাকে জীবনে আত্মস্থ করে নেওয়ার নামই ভালো থাকা।

ভালো মানুষ হওয়ার জন্যও চারপাশের পৃথিবীকে গ্রহণ করতে হবে উদারতার সঙ্গে। মেনে নিতে হবে যে সব কিছু নিজের ইচ্ছেমতো হবে না, কড়ে আঙুলের ডগায় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এত ক্ষমতা মানুষের নেই। বিনা দোষেও ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সুস্থিত জীবন কখনও কখনও। সত্যকে  নিতে হবে সহজতার সঙ্গে, ভালো-মন্দ যাই আসুক না কেন!

অনিশ্চয়তাকে ভুরু কুঁচকে মেনে নেওয়া নয়, প্রসন্নচিত্তে আলিঙ্গন করার কথা বলেছেন মার্থা নাসবম। ঠিক যেমনটি আমরা দেখি গ্রিক ট্র‍্যাজেডি ও পুরাণের চিরন্তন আবহমানতায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে ইউরিপিডিস-এর হেকুবা-র কথা বলেন মার্থা। অজানার প্রতি প্রত্যয়ে স্থির থেকে, ‘টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি’ বলতে পারাই মার্থা-র কাছে নীতিনিষ্ঠ জীবনবোধের সংজ্ঞা। ভঙ্গুরতার মধ্যেই মানবজীবনের সৌন্দর্যকে অনুভব করেছেন তিনি।

এক ধরনের আপাত-বৈপরীত্যই মানবজীবনের চালিকাশক্তি। ভিতরে ভিতরে একা এবং অসহায় বলেই মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গ চায়, বিশ্বাস করে,  আঁকড়ে বাঁচতে চায়। অন্ধ বিশ্বাস ডেকে আনে বিশ্বাসঘাতকতা, আনে দুঃখ। অন্যদিকে নিজেকে সবরকম শোক-আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে মানুষ যখন বিশ্বাসহীনতায় আস্থা রাখা শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় তার সুকুমার বৃত্তিসকল, কালি জমে আত্মায়। শোক থেকে বাঁচতে পরাজয় ঘটে মানবতার।

মানুষের জীবনে বিশ্বাসের কোনও বিকল্প নেই। সে নিজে কথা দিয়ে কথা রাখবে, আস্থা রাখবে সহ-মানুষের প্রতিশ্রুতিতেও। জীবন যখন নাকানি- চোবানি খাওয়ায় এতখানি ইতিবাচক থাকা সম্ভব হয় না সর্বদা। তখন মনে হয় শুধু নিজের জন্য বাঁচি, নিজের বিলাস-প্রতিহিংসা-ক্রোধ ঘিরেই আবর্তিত হোক আমার জীবন। ক্রমাগত কোণঠাসা হতে হতে দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায়, যেনতেন প্রকারেণ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবৃত্তিটুকু জেগে থাকে কেবল। চুলোয় যায় সমাজ, উচ্ছন্নে যায় মানবিকতা। এই আত্মকেন্দ্রিক যাপনে সুখ থাকতে পারে, তবু এ মানুষের জীবন নয় কিছুতেই।

মাঝে মাঝে একাধিক প্রিয় জিনিসের মধ্য থেকে কোনও একটাকে বেছে নিতে বলে জীবন। মহাকাব্যের ভাষায় এই অসম্ভাব্যতার দোলাচলই ট্র‍্যাজেডি নামে অভিহিত হয়, মানুষকে পৌঁছে দেয় অতলস্পর্শী খাদের কিনারে। উদাহরণস্বরূপ অ্যাসকাইলাস-এর অ্যাগামেমননকে তুলে ধরেন নাসবম। কাকে বাঁচাবেন তিনি, আত্মজাকে না  কুশলী সৈন্যদলকে, সে দোলাচলে উথাল-পাথাল  হয়েছিল তাঁর হৃদয়। বেছে তিনি নিয়েছিলেন, বলি দিয়েছিলেন কন্যাকে, জয় হয়েছিল বটে যুদ্ধে কিন্তু ছারখার হয়েছিল জীবন।

এ আত্মিক সঙ্কট শুধু কি মহাকাব্যে? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা বাঁকেও কি সামনাসামনি হতে হয় না তার? ভালো মা হব নাকি সফল বৈজ্ঞানিক, দায়িত্ববান পুত্র হব না পাহাড়ের রহস্যময় হাতছানিতে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ব বারবার, এই সব টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হই তো আমাদের মতো অতিসাধারণ মানুষরাও, প্রত্যহ। অনেক সময়ে দুটো বিকল্পের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যায় মানুষ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুটো দিকই ঋদ্ধ হয় তাতে। কিন্তু ব্যতিক্রমও কি নেই? কন্যার ইস্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে স্নেহের পুত্তলীটি নাচ করবে অথচ ঠিক সময়টাতেই একটা অত্যন্ত জরুরি মিটিং পড়ে গেছে আপনার। এখানে  মিটিং-এর সময় বা ইস্কুলের অনুষ্ঠান-সূচি কোনওটাই নিয়ন্ত্রণে নেই আপনার। স্নেহশীল পিতা আর দায়িত্ববান আধিকারিকের মধ্যে যে কোনও এক জনকে পিছু হঠতেই হয় অতএব। যত উন্নতি, যত বেশি সুখের পিছনে দৌড়নো, ততোই দীর্ণ হই আশাভঙ্গে। তবু, এগিয়ে যাওয়াই জীবনের আরএক নাম। থেমে থাকায় সমাধান নেই, চরিতার্থতা তো নেই-ই।

একই সঙ্গে সংঘাতের মধ্যে বীরত্ব আরোপ করা কিম্বা দুঃখের ভিতর দিয়ে মহত্বকে ছুঁতে চাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছেন নাসবম। স্রোতে গা-ভাসানোর জীবন নয়, দায়িত্ব- কর্তব্য-অঙ্গীকারের জীবনই কাম্য। যা ভালোবাসি তার জন্য লড়াই করতে হতে পারে, ছিনিয়ে আনতে হতে পারে, বিপুল ত্যাগস্বীকার করতে হতে পারে। তবু, হাল ছেড়ো না বন্ধু। এখানে এসেই মার্থা নাসবমের চিন্তা স্থান-কাল পেরিয়ে এক হয়ে যায় আমাদের একমাত্র ঠাকুরের সঙ্গে।

‘তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না॥
আসবে পথে আঁধার নেমে,
তাই ব’লেই কি রইবি থেমে—
ও তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি,
হয়তো বাতি জ্বলবে না॥
তা ব’লে ভাবনা করা চলবে না।’

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article