সুমন চট্টোপাধ্যায়
গতকাল আমার ফোনে একটি ভিডিয়ো এলো, যা দেখলে গা সত্যিই শিউরে ওঠে। পিছমোড়া করে নিলডাউন হয়ে কয়েক জনকে সার দিয়ে পাশাপাশি বসানো হয়েছে, প্রত্যেকের পিছনে একজন করে বন্দুকবাজ, কারও হাতে ঝকঝকে রিভলভার, কারও হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। খানিক দূরে একদল মানুষের জটলা, তারা উল্লসিত না আতঙ্কিত বোঝার উপায় নেই। ক্যামেরাম্যান ইশারা করতেই শুরু হল নিধনযজ্ঞ, পিছনে দাঁড়ানো বন্দুকবাজেরা একেবারে সামরিক শৃঙ্খলায় গুলি চালাতে শুরু করল। অসহায় বন্দির মাথার পিছনে গুলি লাগছে, প্রয়োজনে বারংবার, তার নিথর দেহ ভূমিশয্যা নেওয়ার পরে পাশের জনের পালা। বীভৎসার মেয়াদ দু-আড়াই মিনিট।
ভিডিয়োটি তোলা আফগানিস্তানের পঞ্জশিরের কোনও একটি জায়গায়। মারছে তালিবান, মরছে মাসুদ বাহিনী। সিরিয়ায় এর চেয়েও রক্ত হিম করা হত্যালীলার দৃশ্য আমরা দেখেছি, ইসলামিক স্টেটের বর্বর জঙ্গিরা হাঁটু মুড়ে বসে থাকা নিরস্ত্র বন্দিদের শিরচ্ছেদ করছে একের পর এক। কিন্তু আফগানিস্তানে গত ৩০ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসে এমন দৃশ্য কেউ কখনও দেখেনি। দেখার কথা ভাবেওনি। সিংহের গুহায় এ যেন সত্যিই এক উলট পুরান।
পঞ্জশিরের অর্থ পাঁচটি সিংহ। সেই প্রতীকী সিংহেরা নয়, কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া এক মনুষ্য-সিংহের জন্যই দুনিয়াজোড়া পরিচিতি এই পাহাড় ঘেরা দুর্গম উপত্যকার। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন পঞ্জশিরে ট্যাঁ ফুঁ করতে পারেনি কোনও শত্রুপক্ষ। দশ বছর ধরে সোভিয়েত সেনা চেষ্টা করেছিল, পারেনি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করেছিল তালিবানরাও, ব্যর্থ হয়েছিল। একা কুম্ভ হয়ে বছরের পর বছর নিজের দুর্গ আগলে রেখেছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ, গোটা বিশ্ব তাঁকে এক ডাকে চেনে ‘পঞ্জশিরের সিংহ’ নামে। চে গেভারার মতোই মাসুদ আফগানিস্তানের ‘আইকন’, মারা গিয়েছেন দু’দশক হয়ে গেল, তবু তাঁর বীরগাথায় আজও অনুপ্রাণিত পঞ্জশির, তিনিই তাদের বিদ্রোহী সত্ত্বার সঞ্জীবনী।
আফগানিস্তানে থাকাকালীন ওসামা বিন লাদেন ভয় পেতেন একমাত্র মাসুদকে। কেন না তালিবানদের মতো মাসুদ কোনও দিন লাদেনের চামচাগিরি করেননি, সোচ্চারে আল কায়দার বিরোধিতা করেছিলেন। আল কায়দা যে এক ভয়াবহ আক্রমণের ছক কষছে, মাসুদই প্রথম পশ্চিমি দুনিয়াকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কেউ তখন তাঁর কথায় কর্ণপাতই করেনি। লাদেন ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন মাসুদের এই সতর্কবার্তার বিপদ। দু’জন আত্মঘাতী মানব বোমাকে সাংবাদিকের ছদ্মবেশে তিনিই পাঠিয়েছিলেন মাসুদের কাছে। মাসুদ নিহত হওয়ার ঠিক দু’দিন পরে ধ্বংস হয় নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার, সূচনা হয় আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক অভিযানের। তারপর বিশ বছর আমেরিকার উপস্থিতির কারণে পঞ্জশির শান্ত ছিল, তালিবানদের সঙ্গে ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধের আঁচ সেখানে তেমন একটা পৌঁছয়নি।
যুদ্ধে মরে মানুষ, অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়, সবার আগে বলি হয় ‘সত্য’। যে যার মতো করে সাফল্যের আস্ফালন করে, তিলকে তাল করে দেখায়, কোনটা সত্য, কোনটা অর্ধসত্য আর কোনটা ডাহা অসত্য বুঝতে ভিরমি খেতে হয়। তালিবানের পঞ্জশির দখলের গপ্পোটাও এমন আলো-আঁধারিতে ভরা। তালিবরা দাবি করছে, গোটা পঞ্জশির তাদের পদানত, মাসুদের পুত্র বলছেন তা মোটেই নয়। এই দাবি পাল্টা দাবির মধ্যে সত্যটা হল, পঞ্জশিরের অনেকখানি জায়গা এখন সত্যিই তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে। এমন অভূতপূর্ব সাফল্যে তাই তারা আত্মহারা, প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ, অত্যাচারে বেপরোয়া। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিগুলির মতো আহমেদ শাহ মাসুদের সুরম্য স্মৃতিসৌধটি পর্যন্ত তালিবান-লাঞ্ছিত।
পঞ্জশিরের এই পরিণতি প্রত্যাশিতই ছিল। আহমেদ শাহ মাসুদের মতো স্বপ্নের নায়ক দূরস্থান, নর্দার্ন রেজিস্ট্যান্স ফোর্সে এখন পাতে দেওয়ার মতো সেনাপতিই নেই। মাসুদ-পুত্র নাদান, বয়স মাত্র ৩২, গেরিলা যুদ্ধ না করে সে বিলেতে লেখাপড়া করেছে। এমন তীব্র সঙ্কটে তালিবানদের মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা কোনওটাই তাঁর নেই। আহমেদ শাহ মাসুদের পিছনে আমেরিকা সহ ন্যাটো দেশগুলির সক্রিয় সমর্থন ছিল, অস্ত্রশস্ত্র, টাকা পয়সা, গোয়েন্দা সাহায্য, সব কিছু দিয়ে তারা মাসুদকে মদত করেছিল। সেই বলে বলীয়ান হয়েই মাসুদ প্রথমে সোভিয়েত ফৌজ তারপরে তালিবানদের রুখে দিয়েছিলেন। আজ রণাঙ্গনে মাসুদ-পুত্র দাঁড়িয়ে আছেন একা, ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, এক্কেবারে নিধিরাম সর্দার। বেচারা কাতর কণ্ঠে বারেবারে পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছে, কেউ সাড়া দেয়নি। অতএব পঞ্জশিরের আজকের পরিস্থিতির জন্য কাউকে যদি কাঠগড়ায় তুলতে হয় তার নাম আমেরিকা। সাধের প্রাণটি বাঁচানোর জন্য তালিবানদের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে মার্কিন সেনা যে ভাবে লেজ গুটিয়ে বিমান ধরার জন্য হুড়োহুড়ি করেছে, আমেরিকার সামরিক অভিযানের ইতিহাসে তা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে, চলে আসবে ভিয়েতনামের সঙ্গে একই বন্ধনীতে।
আমি আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম ১৯৮৯ সালের বসন্তে সোভিয়েত ফৌজ আমু দরিয়া পেরিয়ে ঘরে ফেরার অব্যবহিত পরে। কাবুলে তখন সোভিয়েতের হাতের পুতুল নাজিবউল্লার শাসন, চারদিক থেকে মুজাহিদরা ক্ষেপনাস্ত্র ছুড়ছে রাজধানী লক্ষ করে। আহমেদ শাহ মাসুদ তখন নাজিবউল্লার পয়লা নম্বর দুশমন। অনেক চেষ্টা, অনেক কাকুতি মিনতি করেও সে যাত্রায় আমরা পঞ্জশির পৌঁছতে পারিনি। সেই দুঃখ এখনও আমার বুকে বাজে।
তবে এটুকু বলতে পারি, গল্পের সবে শুরু, এখানেই শেষ নয়। আফগানিস্তানে এমনিতেই পাঠানদের সঙ্গে তাজিকদের সম্পর্ক খুব স্বস্তিদায়ক নয়, তালিবানে যেমন পাঠানদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য পঞ্জশিরে তেমনি তাজিকদের। সিংহকে পাঁকে পড়ে যেতে দেখে তালিবানরা সেখানে যেমন চেঙ্গিজ খানের সেনাদলের মতো আচরণ করছে তার বদলা হবেই, সম্মুখ সমর ছেড়ে মাসুদ বাহিনী ফিরে যাবে গেরিলা যুদ্ধে। যাবেই।