হাফসোল – হাওয়াই চটি ও স্টিলেটো
অরুণাচল দত্তচৌধুরী
হাফসোল কথাটার মানে ওদের দু’’জনের কেউই জানত না। তমাল পরত হাওয়াই চটি। রণে বনে জঙ্গলে। সর্বত্র।
অম্বার পায়ে? স্টিলেটো, কিম্বা পেন্সিল হিল নানা রকম। সোল বস্তুটাই চিনত না ওরা।
বারাসতের উপকণ্ঠে স্টেট ইউনিভার্সিটি। সেখানেই পড়ত ফার্স্ট ইয়ারে। ফিজিক্সের তমাল বরুয়া। আর অম্বা বসুর ডিপার্টমেন্ট ছিল ইংরেজি।
তমাল আসত সাইকেলে। অম্বাকে নামিয়ে দিত বাড়ির গাড়ি। এই দু’জনের দেখা হওয়ারই কথা না। কিন্তু হয়েছিল। পাথরের সঙ্গে যেমন দেখা হয় বৃষ্টিফোঁটার। কিন্তু জীবন তো আর কাব্যিক নয় ততটা। অবিশ্যি সেদিন বৃষ্টিরই দিন ছিল। বলতে কী আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর মুখটায় যে চায়ের দোকানটা, বৃষ্টির তোড়ে সাইকেল নিয়ে বেরোতে না পেরে, বাধ্য হয়ে সেখানে বসেছিল তমাল।
অম্বার সেখানে ঢোকার কথাই না। বাড়ির গাড়ি এসে তাকে তুলবে। মায়ের সঙ্গে তার আজ শপিংয়ে যাওয়ার কথা। গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। যতটা সময় কমানো যায়।
এমন সময়ে বৃষ্টিটা নামল। ও দৌড়ে গিয়ে দোকানে ঢুকবে। ফোন ঢুকল। গাড়ির টায়ার পাংচার। বড় রাস্তায়। বৃষ্টি থামলে টায়ার চেঞ্জ।
হঠাৎ নামা বৃষ্টির মধ্যে দৌড়তে গিয়ে, ওই পেন্সিল হিল ঢুকে গেল অসমান রাস্তার সরু ফাটলে। পা মচকাল। সাধের পেনসিল হিল জুতো থেকে বিযুক্ত। প্রবল ব্যথা সামলে কোনওক্রমে উঠে দাঁড়ালেও কন্যা চলতে পারছে না। দু’পায়ের দু’রকম উচ্চতা। বিরক্তির একশেষ। বিরক্তি আরও বাড়ল দোকানের মালিক ইয়াকুবের অযাচিত মন্তব্যে,
– ভাগ্যি ভালো, জুতা ভাঙিসে! এই রকমের কেসে, পায়ের হাড় ভেঙি দুই টুকরা হতি দেখিসি!
কন্যা রাগ সামলে জিজ্ঞেস করে,
– এখানে মুচি পাওয়া যায়?
– হ্যাঁ, তবে এই বিলিতি জুতো সারাতি বড় ডাক্তার লাগবে বোধ হচ্চে। কিন্তুক পোশ্নো, আপনি যাবেন কেমনে?
তমাল নাটকের এই খণ্ড দৃশ্যে বিপত্তারণ।
– ও কোনও ব্যাপার না। আপনি আমার হাওয়াই চটিটা পড়ে যাবেন। আমি তো সাইকেল। ম্যানেজ করে নেব!
ও আপনি করে বললেও আধুনিকা অম্বা সরাসরি তুই করেই বলে একই ইয়ারের তমালকে,
– তারপর তোকে ফেরত দেব কী করে?
তমাল তো-তো করে বলে,
– অসুবিধে হলে দরকার নেই। ভাববেন ইউজ অ্যান্ড থ্রো!
সেই শুরু।
এরপরে নিয়ম মেনেই তাদের দেখা হতে থাকে। দেখা হবার জায়গা অম্বাই ঠিক করে। জানিয়ে দেয় ফোনে বা হোয়াটস্যাপে। কোনওদিনই বাড়ির গাড়িতে আসে না সেই সব অ্যাপোর জায়গায়। আসে অটোয় নইলে টোটোয় নইলে অন্য কোনও ভাবে। তমালকে ওর আবদার মেনে পরে আসতে হয় সাদা ট্রাউজার।
– তোমাকে পেয়ে জানো তো, আমি যেন নতুন একটা পৃথিবী পেয়ে গেছি। এর পরে যখন ফিজিক্সের ইকুয়েশনগুলো লিখব, প্রত্যেকটায় ধ্রুবক হয়ে থাকবে তুমি।
তমাল বলত।
অম্বা ওকে বলত…।
কী বলত? থাক সে সব কথা। এই একই কথা যুগযুগান্ত ধরে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা হয়ে চলেছে।
একটু আগে বললাম বটে গাড়িতে আসত না।
এসেছিল। একদিন।
তমাল অম্বার বলে দেওয়া জায়গায় এসে দেখে, আরও গোটা চারেক মক্কেল ওরই মত সাদা ট্রাউজার, দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবাকই হল।
অম্বা এল কিছুক্ষণ বাদে। গাড়ি করে। সঙ্গে আরও একজন। ক্লিন শেভড। টল, হ্যান্ডসাম।
অম্বা সাদা ট্রাউজার সব ক’জনকে বলল,
– হাই এভরিবডি, এ হচ্ছে অনুভব মিত্র। গ্রিন কার্ড হোল্ডার। দেশে ফিরতে দেরি করছিল বলে, তোমাদের সবার সঙ্গে ডেটিং করে ডিপ্রেশন কাটাচ্ছিলাম। ওরই অ্যাডভাইসে। অনুভব ওখানে মস্ত সাইকিয়াট্রিস্ট। নেক্সট উইকে আমাদের বিয়ে।
অন্যদের কথা জানি না। তমালের কিন্তু লাভ হয়েছিল। ইকুয়েশনে ধ্রুবক বসায় লেখাপড়ার কার্ভ নীচের দিকে গেছিল। ধ্রুবক সরে যেতেই আবার ঊর্ধ্বমুখী। উপরন্তু লাভ, ওই দিনই সুদৃশ্য প্যাকেটে ফেরত পেল হাওয়াই চপ্পলটি।
আজও প্রফেসর টি বরুয়ার সম্মাননার নানান স্মারকের মাঝে যত্নে সাজিয়ে রাখা।