সুমন চট্টোপাধ্যায়
তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জ্যোতি বসু কেবল একবারই আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন। রশিদ খানের পয়সায় তিনি বিলেত গিয়েছেন, প্রথম পাতায় এই মর্মে একটি খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে। মাফ-টাফ চেয়ে সে যাত্রায় ক্রোধে অগ্নিশর্মা মুখ্যমন্ত্রীর রাগভঞ্জন করতে হয়েছিল।
একে খবরটা ছিল ডাঁহা মিথ্যে, হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো গুজব-সমগ্র থেকে সংগ্রহ করা। তদোপরি বৌবাজার বিস্ফোরণের এক নম্বর খলনায়ক রশিদ খান তখন রাজ্যবাসীর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত নাম। বিস্ফোরণে অর্ধ-শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাও ভাগ্যিস রাতে হয়েছিল, দিনের বেলা কাজের সময়ে হলে আরও কত প্রাণ যে বেঘোরে ঝরে পড়ত, তার ইয়ত্তা নেই। এমন এক পাষণ্ডের পয়সায় জ্যোতিবাবু বিলেত গিয়েছিলেন রাজ্যের সর্বাধিক বিক্রিত কাগজে এমন একটা বিকৃত খবর ছাপা যায় নাকি? ফাজলামিরও তো একটা সীমা থাকা উচিত!
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যুদ্ধ, দাঙ্গা অথবা বড় কোনও অপরাধমূলক ঘটনার অব্যবহিত পরে সত্য চাপা পড়ে যায় গুজবের পাহাড়ের তলায়। সাহেবরা বলেন, ‘ফার্স্ট ক্যাজুয়্যালটি ইজ ট্রুথ।’ তখন ভারি মুশকিল হয় কর্তব্যরত রিপোর্টারের। কোনটা দুধ আর কোনটা জল, কোনটা সম্ভব আর কোনটা অসম্ভব, বুঝতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে। সরকারি বয়ান, সেও অসত্য আর অর্ধসত্যে ভরা, নিজেদের গাফিলতি চেপে যাওয়ার ইস্তেহার। ১৯৮৪ সালে বিনোদ মেহতার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে নেমে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পরে ১৯৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণ, কলকাতায় বৌবাজার বিস্ফোরণ এবং সবশেষে খাদিম কর্তার অপহরণের পরেও তারই পুনরাবৃত্তি হতে দেখেছি। যে পরিস্থিতিতে সত্যান্বেষণ কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, তখন গুজবকেই চালিয়ে দেওয়া হয় খবর হিসেবে। ডামাডোলের মধ্যে পাকড়াও হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, লোকে যখন ঘটনাটা চেটেপুটে খাচ্ছে তখন গুজবই সই। গল্পের গোরুকে গাছে তুলতে গিয়ে পচা শামুকে পা কেটে গিয়েছিল আনন্দবাজারের, অন্যথায় তখন কে কত মাখোমাখো করে গুজবকে খবর বানাতে পারে, তাই নিয়েই চলে ভারপ্রাপ্ত রিপোর্টারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
১৯৯৩-র ১৬ মার্চ বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে আমার ডাক পড়ল কলকাতায়। বৌবাজারের কাণ্ড নিয়ে আনন্দবাজারি তদন্ত দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। নয় বছর আগে বিনোদ মেহতা হত্যাকাণ্ডের পরে যে দায়িত্বটা অরুণ বাগচিকে দেওয়া হয়েছিল, এ বার তা আমি পেলাম। নিউ কেনিলওয়ার্থ হোটেলের ঘরে অস্থায়ী তদন্ত-শিবির গড়ে আমরা প্রাণপাত পরিশ্রম করলাম সপ্তাহ খানেক। কয়েক কিস্তির দীর্ঘ প্রতিবেদনটি আমাকেই লিখতে হয়েছিল, সঙ্গী সহকর্মীদের নামও ছাপা হয়েছিল প্রতিবেদনে। নয় বছর আগে আমার বঞ্চনাবোধের জ্বালা আমি সহকর্মীদের পেতে দিইনি।
চেহারা দেখে বড় জোর ধর্মতলার রাস্তার হকার মনে হতে পারে, রশিদ খানকে সন্ত্রাসবাদী বলে কিছুতেই মনে হয় না। বৌবাজার পাড়ায় তার পরিচিতি ছিল সাট্টা ডনের, ভোটের সময় যে কি না লোক-লস্কর দিয়ে শাসকদলের প্রার্থীকে সাহায্য করত। সাট্টার কারবারিকে ‘ডন’ বললে আসল ‘ডন’-দের অবমাননা করা হয়। মনে প্রশ্ন জাগে রশিদ খান যদি ডন হয়, তাহলে দাউদ ইব্রাহিমকে কী বলব? লালবাজারের নাকের ডগায় অবৈধ কারবার করত রশিদ অথচ পুলিশ তার খবর রাখত না, এটা ছেলে ভোলানো গল্প। বিস্ফোরণের ঘটনার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে আমরা ওই এলাকায় পুলিশ-অপরাধ জগতের সম্পর্ক নিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পেরেছিলাম।
প্রতিবেদনে তার সবিস্তার বর্ণনা ছিল। পুলিশের সদর কার্যালয়ের দোরগোড়ায় কোনও বাড়িতে যদি বিস্ফোরক মজুত হতে থাকে, তার দায়িত্ব আইনের রক্ষকেরা অস্বীকার করবেন কী করে? নিয়ম করে ‘হপ্তা’ নিতে যাঁদের ভুল হয় না, এত বড় একটা ঘটনার আঁচও তাঁরা পেলেন না? কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে যা সচরাচর হয়ে থাকে, এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। মিডিয়ায় দিনকতক হল্লা হওয়ার পরে সম্পূর্ণ ধামাচাপা পড়ে গেল পুলিশের যোগসাজশ বা অপদার্থতার দিকটা। ঠিক যেমন এই নির্মম শহর সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছে জনা ষাটেক নিরপরাধ নিহতকে, অন্তত জনা পঁচিশ আজীবন পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষকেও। কয়েদখানায় রশিদ খান সুবোধ বালকের মতো আচরণ করলে খবর হয়, তুলি হাতে ক্যানভাসে ছবি আঁকলে তো কথাই নেই, অথচ আহত-নিহত উলুখাগড়ারা তলিয়ে গেল বিস্মৃতির অতলে।
বিস্ফোরণ কাণ্ডের রহস্যভেদের চেষ্টায় এর বাইরে যে সব কথা বারেবারে কানে আসছিল, তা প্রমাণ করার কোনও উপায় ছিল না। একটি তত্ত্ব অনুসারে রশিদ খান নাকি ‘ডি’ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিল, যদিও এমন এক খ্যাংড়াকাঠিকে দাউদ শাগরেদ বানাতে যাবে কেন, তার কোনও সদুত্তর পাইনি। আর যে ভয়ঙ্কর তত্ত্বটি সে সময় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল তা হল, বাবরি পতনের বদলা নিতে ওই বিস্ফোরক জমানো হচ্ছিল যা পরে হিন্দু পাড়ায় ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করা হতো। বিশুদ্ধ গুজব, গুলতানির কারখানায় তৈরি।
রশিদের গায়ে সন্ত্রাসবাদীর তকমা লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত জ্যোতি বসুর সরকার তার বিরুদ্ধে সেই বহু সমালোচিত ‘টাডা’ আইনই প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিল। পুলিশ প্রশাসন বুঝেছিল আইপিসি, সিআরপিসি দিয়ে রশিদকে বেশি দিন জেলবন্দি করে রাখা যাবে না, চাই ‘টাডার’ মতো দানবীয় আইনের সাহায্য। কাজটি ঠিক হয়েছিল না ভুল সেটা অপ্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক সত্যটি হল রশিদ খান যে প্রায় তিন দশক ধরে একটানা জেলের ঘানি টেনে চলেছে তা এই কেন্দ্রীয় আইনের সৌজন্যে।
বেচারা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! একই ধরনের অপরাধের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় আইনের ওপর নির্ভর না করে তিনি যখন রাজ্যস্তরে সন্ত্রাস বিরোধী আইন আনতে গেলেন, সেই সব লোকেরাই উদ্বাহু হয়ে তার বিরোধিতা করলেন। যাঁরা কি না রশিদের ক্ষেত্রে ‘টাডা’ আইন প্রয়োগ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। প্রয়োজন যখন, তখন কেন্দ্রীয় আইন লাগু করব। প্রয়োজন ফুরোলে শুরু করব সেই আইনের বিরোধিতা। এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি আর কী-ই বা হতে পারে? (চলবে)
ছবি- বিস্ফোরণের পরে বৌবাজার (টুইটার থেকে সংগৃহীত)