সুমন চট্টোপাধ্যায়
লন্ডন ছিল জ্যোতি বসুর ‘সেকেন্ড হোম’, ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে সেখানে তিনি অনেকগুলো বছর কাটিয়েছিলেন, হ্যারি পলিট বা রজনী পাম দত্তর মতো গুরু-দর্শনও হয়েছিল সেখানেই। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে দেখে জ্যোতিবাবু কমিউনিস্ট হননি, হয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেনের সংস্পর্শে এসে। সেখানেই তিনি লন্ডন মজলিসের সদস্য হন, বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ইন্দিরা গান্ধী, ফিরোজ গান্ধী, ভূপেশ গুপ্ত, মোহন কুমারমঙ্গলম, নিখিল চক্রবর্তীদের সঙ্গে। ফলে কলকাতায় প্যাচপেচে গরমটা অসহ্য হয়ে উঠলেই লন্ডন জ্যোতি বসুকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। আসুন, আসুন, আসুন।
‘পুঁজির সন্ধানে জ্যোতি বসু বিলেত যাচ্ছেন’। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এই খবরটি চরম উপহাসের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বরুণ সেনগুপ্ত তাঁর নিজের লেখায় জনগণের টাকায় বিলেতে ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে চাঁছাছোলা ভাষায় আক্রমণ করতেন, বিরোধী নেতারাও এ নিয়ে কম কটাক্ষ করেননি। জ্যোতিবাবুর সফরে শিল্পের ছোঁয়া একেবারেই থাকত না তা নয়। দু-একটা মিটিং- সেমিনার অবশ্যই থাকত, তাতে কাজের কাজ কিছুই হতো না। টানা বেশ কিছুদিন তিনি লন্ডনে কাটাতেন স্রেফ আয়েশ করার জন্যই। তাঁর আরাম-সফর নিয়ে কে কী বলল, কোথায় কী লেখা হল কিংবা এর ফলে দল অস্বস্তিতে পড়ল কি না, জ্যোতিবাবু এহেন প্রশ্নাবলীকে অবান্তর মনে করতেন। তাঁর অবজ্ঞা করার অভ্যাসটি ছিল একেবারে সম্রাট-সুলভ।
উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অবস্থান ছিল একেবারে বিপ্রতীপে। তিনি জানতেন বাংলায় অর্থবহ শিল্পায়ন করতে হলে বিদেশি পুঁজি আনতে হবে, তার জন্য যেতে হবে বিদেশেই। এর কোনও শর্ট কাট রুট নেই। কিন্তু ভাবতে গেলেই তাঁর পূর্বসূরির কথা মনে পড়ে যেত, মনে পড়ত জ্যোতিবাবুর বিদেশ সফর নিয়ে চারদিকের বিদ্রুপ আর সমালোচনা। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’, এই ভীতি বুদ্ধবাবুকে তাড়া করে বেড়াত অষ্টপ্রহর। এইখানেই বড় একটা পার্থক্য ছিল দুই মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে। পাবলিক কী বলল তা নিয়ে জ্যোতিবাবু যতটা নির্লিপ্ত, বুদ্ধবাবু ঠিক ততটাই স্পর্শকাতর। ১০ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে বুদ্ধবাবু মাত্র পাঁচটি দেশে গিয়েছিলেন। জাপান, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনাম। তার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া আর সিঙ্গাপুর একই সফরে, সম্ভবত ভিয়েতনাম সফরের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সব সফরের মেয়াদই যারপরনাই সংক্ষিপ্ত, ‘হুইশল স্টপ ট্যুর’ বলতে যা বোঝায় তাই আরকি। নামো, কাজ সারো, ফের বিমানে উঠে পড়ো। নো সাইট সিয়িং, নো আমোদ-প্রমোদ, নো সময় নষ্ট। কেন? না পাছে লোকে কিছু বলে!
আমি দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই বিদেশ সফর করেছি। তাই সাযুজ্য কোথায়, কোথায় বা বৈপরীত্য আমার ঝুলিতে তার আঁখো দেখা হাল রয়ে গিয়েছে। প্রথমে মিলের কথা বলি। চার দিনের ইতালি সফরে বুদ্ধবাবু একটি অতি আটপৌরে হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া কিচ্ছুটি নেননি। তুলনায় জ্যোতিবাবু নিতেন স্যুটকেস, সেটাও মামুলি। কোনও অনুষ্ঠান থাকলে তাঁকে গলাবন্ধ স্যুট পরতেই হতো, তবু এক জোড়ার বেশি নয়। ওয়াশিংটনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আগে লিফট ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ বিজন নাগের ডাক, ‘যেও না, একটু দাঁড়াও।’ আইএফবি গোষ্ঠীর কর্ণধার বিজনবাবু সম্পর্কে জ্যোতিবাবুর ভাগ্নি-জামাই, অতি সজ্জন, আমুদে মানুষ। মিনিট খানেকের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে তিনি লিফটের সামনে এলেন, হাতের হ্যাঙারে ঝুলছে দোমড়ানো-মোচড়ানো দুটো গলাবন্ধ স্যুট। এ দু’টি কার আমাকে বুঝিয়ে বলতে হল না। বিজনদাই দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসলে মানুষটার দেখভালের জন্য কেউ নেই। নইলে কেউ এ ভাবে দলা পাকানো স্যুট স্যুটকেসে ভরে দেয়? বিজনদা’র অনুরোধে আমি তাঁকে সঙ্গ দিলাম মুখ্যমন্ত্রীর স্যুট ইস্ত্রি করার দোকান অন্বেষণে। আমরা ছিলাম ওয়াটারগেট হোটেলে, বরাত জোরে খুব কাছেই ইস্ত্রি করার দোকান খুঁজে পেলাম। বিজনদাকে দণ্ড দিতে হল ১২০ ডলার। ইস্ত্রি হওয়া স্যুট ঘরে পৌঁছলে তবে বের হতে পারলেন বঙ্গেশ্বর।
আর ইতালিতে গিয়ে দু’দিন পরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট আর খদ্দরের হাফ শার্ট পরতে শুরু করলেন। ওইটুকু হ্যান্ডব্যাগে আর কয় সেট ধুতি-পাঞ্জাবি আঁটে। এর মধ্যে আমি কোনও অস্বাভাবিকতা দেখিনি, কিন্তু পরের দিন কাগজে প্যান্ট-শার্ট পরা মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেখে খুবই উত্তেজিত হয়ে অভীক সরকার বারবার আমাকে ফোন করতে লাগলেন। বললেন, ‘শোনো আজ এটাই হবে তোমার মূল স্টোরি।’
কোনটা?
প্রচণ্ড রেগে গেলেন সম্পাদকমশাই। ‘কোনটা আবার, এই যে বুদ্ধবাবু বাঙালি জাতির সঙ্গে বেইমানি করলেন সেটা।’
বেইমানি? আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
মুখ্যমন্ত্রী ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে হঠাৎ প্যান্ট-শার্ট পড়তে গেলেন কেন? এত বড় একটা গর্হিত কাজ উনি করলেন কী করে? বাঙালির মান-সম্মান সব তো ধুলোয় লুটিয়ে গেল।
সম্পাদকের গোঁসার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে এ বার কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে আমি জানতে চাই, তাহলে আমায় কী করতে হবে?
স্টোরি। টক টু দ্য চিফ মিনিস্টার, আস্ক হিম হার্ড কোয়েশ্চেনস, আস্ক হিম হোয়াই হি চোজ টু অ্যাবান্ডন হিজ বেঙ্গলি আইডেনটিটি।
বোঝো ঠ্যালা। হাতের কাছে বিষ থাকলে তখনই হয়তো আমি আত্মহত্যা করতাম। জীবনে কত বিষয় নিয়েই তো স্টোরি করেছি, না জানা বিষয় জেনে নিয়ে করেছি, তাই বলে মুখ্যমন্ত্রীর ধুতি বর্জন? কোন পাগলা দাশুর পাল্লায় পড়লাম রে বাবা!
এক ফাঁকে বুদ্ধবাবুকে একা পেয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললাম, আমি একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করব, আপনি কিছু মনে করবেন না। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ইতালিতে নামলেন, বাঙালি হিসেবে বেশ গর্ব হল, দু’দিনের মাথায় তা পরিত্যাগ করলেন কেন? বাঙালির বাঙালিত্ব কি এর ফলে ধুলোয় লুটিয়ে গেল না?
অভীকবাবুর কথা শুনে আমি যতটা তাজ্জব হয়েছিলাম, আমার কথা শুনে মুখ্যমন্ত্রীও তেমনি। ‘দুটো ধুতি-পাঞ্জাবি এনেছিলাম, পরা হয়ে গেছে, তাই প্যান্ট-শার্ট পরেছি।’ উত্তরটি দিয়েই বুদ্ধবাবু বুঝতে পারলেন এটা আমার প্রশ্ন নয়, অন্য কেউ আমাকে দিয়ে জানতে চাইছে। ‘এমন সব আজগুবি ভাবনা কার মাথায় এসেছে বলুন তো?’
শ্রীযুক্ত অভীক কুমার সরকার, মুখ্য সম্পাদক, আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী।
মুচকি হেসে চলে গেলেন বুদ্ধদেব। হোটেলের ঘরে গিয়ে আমি লিখতে বসলাম জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কপি। পরে শুনলাম বিষয়টি নিয়ে আনন্দবাজারে নাকি সম্পাদকীয় পর্যন্ত লেখা হয়েছে। ছাপাখানার মালিক হলে কত কিছুই না করা যায়! (চলবে)