সুমন চট্টোপাধ্যায়
খবরটা কানে এসেছিল আগেই। ঘোড়ার মুখ থেকে শুনিনি বলে বিশেষ একটা উৎসাহ দেখাইনি। অবশেষে দেখলাম ঘোড়া আমাকে ল্যাজের ঝাপটা মেরেছে, খবরটি সঠিক। গৌতম ভট্টাচার্য ২৪ ঘণ্টা নিউজ চ্যানেলের নতুন সম্পাদক।
মিথ্যে বলা হবে যদি বলি গৌতমের উপর আমার একেবারেই অভিমান হয়নি।
ওকে চিনি ইস্কুলের দিনগুলো থেকে, সঠিক করে বললে আমাদের সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীও অতিক্রান্ত। তারপর একসঙ্গে আনন্দবাজারে কাজ করেছি টানা ২৩ বছর। আমি ছেড়ে আসার পরে সরকার-বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমাকে দেখলে যে ভাবে মুখ লুকোনোর চেষ্টা করত, গৌতম কোনও দিন সে পথে হাঁটেনি। ও সোজা অভীক সরকারকে গিয়ে বলেছিল, ‘সেই ছেলেবেলা থেকে যে লোকটাকে চিনি তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমি নষ্ট করতে পারব না।’
অভীকবাবু সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ক্রান্তিকালে একটা লোক যখন গোটা প্রতিষ্ঠানের কাছে অস্পৃশ্য হয়ে গিয়েছে তখনও ক্রিজের বাইরে এসে এ ভাবে বাপি বাড়ি যা করে তার সঙ্গেই নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার সাহস আর কেউ দেখায়নি। অথচ আমার কাছে গৌতমের ফুটো পয়সার ঋণ ছিল না, তখনও ছিল না, আজও নেই।
কারুর বদান্যতায় ও গৌতম ভট্টাচার্য হয়নি, হয়েছে, ষোলো আনা নিজের মুরোদে। পেশাদারিত্বের বাঁধা দাস হিসেবে কী ভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয় সেটা গৌতমের কাছে শিক্ষণীয়। ভালো-মন্দের তর্কে প্রবেশ না করেও বলতে পারি গৌতম ভট্টাচার্যের মতো পেশাদার, অধ্যবসায়ী আর একজন সাংবাদিককেও আমি দেখিনি। ইস্ট অর ওয়েস্ট, গৌতম ইজ দ্য বেস্ট।
সাড়ে তিন বছর আগে অকস্মাৎ আমি বন্দি হওয়ার পরে হাতে গোনা যে দু’চারজন বন্ধু অন্তরাল থেকে আমার মুক্তির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল তাদের মধ্যে একজন গৌতম ভট্টাচার্য অন্যজন প্রীতিময় চক্রবর্তী। গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে এরা দু’জনে একসঙ্গে ভুবনেশ্বরে এসেছিল, আমি তখন হাসপাতালে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার গ্রেফতারের পরে কলকাতার মিডিয়া যে মৌনাবলম্বন করেছিল তার অন্যতম কারিগরও ছিল গৌতম। আমার স্ত্রীকে ও বলেছিল, ‘রিঙ্কুদি এটাই হচ্ছে আমাদের নীরব প্রতিবাদ।’
কৌশল হিসেবে নৈঃশব্দের কার্যকারিতা ছিল না সে কথা বলতে পারব না। আমাকে নিয়ে কোনও খবর না হওয়াটা কোতোয়ালদের বিহ্বল করে তুলেছিল। তাদের একজন ভুবনেশ্বরে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘দাদা ইসকা মতলব কেয়া মুঝে থোরা সমঝা দিজিয়ে। হামারা বস লোগকো ভি ইয়ে সমঝমে নেহি আ রহা হ্যায়।’ আমি খোঁচা দিয়ে জবাব দিয়েছিলাম, ‘ইউ মে সি ইট অ্যাজ এ টোটাল ডিজঅ্যাপ্রুভাল অফ মাই ফ্রাটার্নিটি অফ ইওর অ্যাকশন। দে নো মি, দে অলসো নো ইউ। দে নো হু ইজ রাইট অ্যান্ড হু ইজ রং।’
অত্যন্ত অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে আনন্দবাজার থেকে গৌতম ইস্তফা দিয়েছিল। জমা দেওয়ার আগে আমাকে ও ইস্তফাপত্রটি পড়তে দিয়েছিল। এত লম্বা, সুরচিত, অকাট্য যুক্তি নির্ভর ইস্তফাপত্র আমি তার আগে বা পরে কখনও দেখিনি। আর পাঁচজন লিখলে তাতে ক্রোধ আর অপমানবোধ ছড়িয়ে থাকত ছত্রে ছত্রে। কিন্তু গৌতম ইস্তফাপত্রকে গায়ের জ্বালা মেটানোর অস্ত্র হিসেবে দেখেনি। কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একজন প্রথম সারির কর্মচারীর যে রকম সংযত অথচ দৃঢ়চেতা হওয়া উচিত গৌতম নিজেকে ঠিক সেই ভাবে দেখেছে। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষের উচিত গৌতমের লেখা ইতিহাসের এই দলিলটি অফিসের মহাফেজখানায় সযত্নে রক্ষা করা।
এ বার মাইনফিল্ডে প্রবেশ করেছে গৌতম, সম্ভবত ওর জীবনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে ২৪ ঘণ্টার সম্পাদনা। বাংলা নিউজ চ্যানেলে আমিও কিছুদিন ঘাম ঝরিয়েছি, তাই যৎকিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আমারও আছে যার নিরিখে কয়েকটি সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে চাই, গৌতমকে ঘাবড়ে দিতে নয়, ওকে সতর্ক করতেও নয়, নিজেই নিজেকে শোনাতে।
প্রথমত, খবরের কাগজের মতো নিউজ চ্যানেলে সম্পাদকের পদটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্ব নেহাতই প্রতীকী। চ্যানেলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে তিনটি চরিত্রের উপর, ইনপুট এডিটর, আউটপুট এডিটর আর অ্যাঙ্কর।
দ্বিতীয়ত, উৎকর্ষের সাধনার জায়গা নিউজ চ্যানেল নয়। বাংলা চ্যানেলগুলি তো নয়ই। এখানকার মাটি লতা-গুল্ম আর আগাছায় ভরা। হাজার চেষ্টা করেও এই মাটিতে চন্দ্রমল্লিকা বা ডালিয়া ফোটানো যাবে না।
তৃতীয়ত হিন্দি বা ইংরেজি চ্যানেলের মতো বাংলা চ্যানেলে পাতে দেওয়ার মতো একজন অ্যাঙ্কারও নেই যার কথা শ্রোতা শুনবে, বিশ্বাস করবে। এই মুহূর্তে যারা বাজারে করে খাচ্ছে তারা কানার মধ্যে ঝাপসা। কেউ মনে করে সুন্দর সাজগোজ অ্যাঙ্কারিংয়ের সৌন্দর্য বাড়ায় আবার কেউ মনে করে গলা সপ্তমে না তুললে শ্রোতার মনই জয় করা যাবে না। শেষ কথা, চ্যানেলের মালিক শেষ বিচারে ব্যবসা বোঝে আর বোঝে শাসককে তেলানো। ফলে পান থেকে চুন খসলেও মহাপ্রলয় শুরু হতে পারে। জলে কুমীর আর ডাঙায় বাঘ এর মাঝখানে বসে থাকা কতটা মর্মান্তিক, বাবু গৌতম এবার তা টের পাবেন।