27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

উত্তুরে হাওয়া দক্ষিণে

Must read

বিশেষ প্রতিবেদন: নতুন এক প্রবণতা শুরু হয়েছে ইদানীং দ্রাবিড় ভারতের বিবাহোন্মুখ ছেলেমেয়েদের মধ্যে। বিয়ে ব্যাপারটাকে নিছক পারিবারিক বা সামাজিক লোকাচার কিম্বা আইনি সই-সাবুদ হিসেবে না দেখে, চোখ-ধাঁধিয়ে দেওয়া প্রায় কর্পোরেট এক ইভেন্টের রূপ দিচ্ছে তারা। সমাজমাধ্যমের চলতি কায়দাকানুন রংঢং অনুসরণ করে, স্থানীয় আচার-অনুষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে হরেক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও প্রাদেশিক রীতি-রেওয়াজের মিশেলে বিপুল জাঁকজমকের সঙ্গে দ্বৈতজীবনে পা রাখছে দক্ষিণের নব্য যুবক-যুবতীরা।

যেমন, এই সেদিন, কেরালায় ডঃ শেহা ফাইজারের বিয়ের কথাই ধরুন। নাচে-গানে, রঙের ছটায়, দেশি-বিদেশি বিনোদনে, সে এক ধুন্ধুমার উদযাপন। সুফি, পাঞ্জাবি, হিপ-হপ, ফ্ল্যামেঙ্কো কী ছিল না দক্ষিণ ভারতীয় সেই বিবাহ সমারোহে!উল্লেখ্য, এই ধরনের বিবাহ অনুষ্ঠান আজকাল আকচারই হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে, উপকূলবর্তী কেরালায় তো বিশেষ করে।

মহড়ার চূড়ান্ত পর্যায়, ভাবী কনে মঞ্চে ঢুকছেন মধ্যমণি হয়ে, তাঁর হাবভাব যে কোনও ঝানু তারকার মতোই আড়ষ্টতাহীন, প্রত্যয়ী। তাঁকে ঘিরে আছেন সহযোগী নৃত্যশিল্পীরা, তাঁরা কেউ আত্মীয়, কেউ বাল্যবন্ধু আবার কেউ বা পেশাদার শিল্পী। আর লম্বাচুলের ওই যে ছোট্টখাট্টো ভদ্রলোকটি, শান্ত দৃঢ় পদচারণায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, উনিই কোরিয়োগ্রাফার। মাস্কের আড়াল থেকে অস্ফুট স্বরে ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে চলেছেন শিল্পীদের, আরএকটু ছন্দিত হতে হবে পদচারণা, আরও কমনীয়, আরও খানিক শিল্পিত হতে হবে অঙ্গচালনা।

ছোট্ট স্পিকারে তারস্বরে বেজে চলা বলিউডি সিনেমার সুপারহিট পাঞ্জাবি গান, ‘থোড়ি তে কালা তিল কুড়িয়ে/ জিউ দাগ এ চান দে টুকড়ে তে/ তেনু কালা চশমা জাসদা অ্যয়/ জাসদা অ্যয় গোড়ে মুখড়ে তে’-র তালে তালে নাচের মহড়া চলছে। পরিবারের সদস্যরা কেউ নারকেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে, কেউ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখছেন।কাকু বা জেঠু গোছের এক বয়স্ক ফূর্তিবাজ ভদ্রলোক আপনমনে সোফার হাতল বাজাচ্ছেন তালে তালে।

সাবেক দক্ষিণী বিবাহের বৈশিষ্ট্যই ছিল তার আড়ম্বরহীনতা। ঢিমেতাল মন্দ্রস্বরে বাঁধা আনুষ্ঠানিকতার অন্তর্গত ছিল খাওয়াদাওয়া, সঙ্গে বড়জোর সমবেত গান, এইটুকুই। অথচ আজকে তা হয়ে উঠেছে সারাদেশের সাম্প্রতিকতম সব বিনোদন-সম্বলিত এক কার্নিভালের মতো, যেখানে তামিল-তেলেগু ভাষার ঝিনচ্যাক সঙ্গীতের সঙ্গে পাঞ্জাবী ঢোল-নাকাড়া, ঘাগড়া-চোলি মিলে-মিশে একাকার।

ডঃ শেহা ফাইজারের বিয়েতে অবশ্য আরও বেশি কিছু ছিল। কনে যখন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী, ছেলেবেলা থেকেই দর্শক সমাবেশে অভ্যস্ত, ক্যামেরার সামনে স্বচ্ছন্দ, তখন প্রত্যাশা তো থাকবেই অতিরিক্ত চমকের। এই ভাবনা প্রতিধ্বনিত হয়েছে শেহার মা শ্রীমতী নিশি ফাইজারের বক্তব্যের মধ্যেও। তাছাড়াও বর-কনে উভয়েই মুসলমান, অতিথি শিল্পীরা কেউ হিন্দু কেউ খ্রিষ্টান। মহড়ার শেষ দিনটি পড়েছিল ক্রিসমাসের দিন, কনের বাল্যবন্ধু, পেশাদার নৃত্যশিল্পী জবিন জনসন তাঁর বিবাহোত্তর প্রথম ক্রিসমাসের মধ্যাহ্নভোজটিতে অনুপস্থিত থাকেন শুধু মহড়াটিতে অংশগ্রহণ করবেন বলে। আরএক বহু পুরোনো বান্ধবী ঐশ্বর্য রাগেশ মহড়া শেষ হতেই রওনা দেন বাড়ির পুজোয় উপস্থিত থাকার জন্য। পুরো ক্যানভাস জুড়ে যে ছবিটা ফুটে ওঠে তা কেরালার অবিরল বৈচিত্র‍্য ও অকপট ঐক্যের। বর্তমান ভারতবর্ষের হিংস্র হিন্দুত্ববাদী আবহের বিপ্রতীপে এক গভীর স্বস্তিবোধ নিয়ে আসে সে ছবি।

কেরালার এই বর্ণিল বিবাহ অনুষ্ঠানগুলো শুধু যে স্থানীয় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে তা নয়, ভাইরাল হচ্ছে আন্তর্জালেও। হবে নাই বা কেন! পাঞ্জাবি ঢোলবাদ্যের ঝমরঝম, অত্যুজ্জ্বল বসনভূষণে সজ্জিত হয়ে মিশরীয়, মেক্সিকান বা সুফি নৃত্য, ভাড়া-করা পোল ডান্সারদের লাস্যময় উপস্থাপনা, মল্লবিদদের কেরামতি… কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন!

গত এক দশক ধরে মেলডিয়া নামে একটি বিবাহ ব্যবস্থাপক সংস্থা চালান মেইজন পি.জে. নামে এক ভদ্রলোক। বিয়েবাড়িতে গান গাওয়াই ছিল একসময়ে যাঁর পেশা। তাঁর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে কেরালার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বিবাহ অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিচালনা করেন ভাড়া করা কোরিয়োগ্রাফার। এই ভোলবদলের কারণ হিসেবে তিনি সোশ্যাল মিডিয়াকে চিহ্নিত করেছেন সংশয়হীন ভাবে। ইউটিউব, পিন্টারেস্ট,  ইন্সটাগ্রামের কেতাদুরস্ত স্থির ও চলমান সব ছবির সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে তো!

বিবাহানুষ্ঠান পরিকল্পনা আজকের ভারতবর্ষে রমরমিয়ে চলা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা বিশেষ। কয়েক লক্ষ টাকার প্যাকেজের বিনিময়ে টিজার ট্রেলার-সহ নাচ গান বিনোদনে টইটম্বুর একদম নিজস্ব একটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, বিয়ের দলিলও হল, দেখনদারিও হল, আবার বর-কনের নায়ক- নায়িকা হওয়ার ইচ্ছেও পূরণ হল একই সঙ্গে। সুযোগ যেহেতু বারবার আসে না, তাই শখ মিটিয়ে নিতে হবে একবারেই। টিভি সিরিয়ালের বিস্ফোরক আবেগ থেকে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তি, ড্রোনের ব্যবহার থেকে সুরমুর্ছনা সব কিছু পুরে ফেলতে হবে এক মলাটের ভিতর।

অতিমারীর এই বিরামহীন আবহে বাধ্যতামূলক কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে আনুষ্ঠানিকতায় । স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমন্ত্রিতের সংখ্যা বেঁধে ফেলতে হচ্ছে শ’দুয়েকের মধ্যে, করোনা-পূর্ব স্বাভাবিক সময়ে যা ছিল প্রায় এর পাঁচগুণ। অতএব, একদিনের গোটা অনুষ্ঠানটাকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে একাধিক দিনের ছোট ছোট অনুষ্ঠানে, অতিথি নির্বাচনও করা হচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, কেউ যাতে বাদ না যান।

বিয়ের মরসুমে এখানকার ব্যস্ততম মানুষটির নাম মানস প্রেম। পেশায় তিনি নৃত্য-নির্দেশক। আগামী কয়েকমাসে প্রায় শ’পাঁচেক বিয়েবাড়িতে কোরিয়োগ্রাফি করার বরাত পেয়েছেন তিনি। এবং কোভিড-বিধিকে মান্যতা দিয়ে মহড়ার সিংহভাগটাই হচ্ছে অনলাইন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়স্ক, অনভ্যস্ত মানুষজনকে তালিম দিতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন তিনি। ডঃ ফাইজারের পরিবারকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। কনের মা এবং এক দিদিমা ছিলেন নৃত্য-পটিয়সী আর কনে স্বয়ং ছোটোবেলা থেকেই শ্রী প্রেমের প্রিয় ছাত্রী।

ডঃ শেহার নৃত্যপ্রীতির জন্য কম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁর পরিবারকে। রক্ষণশীল মুসলমান আত্মীয়-পরিজনরা বাধা দিয়েছে, চোখ রাঙিয়েছে, শক্ত হাতে সেই ঝড় সামলেছেন শেহার বাবা। আবার নাচই ডঃ রোশন সালাউদ্দিনকে আকৃষ্ট করেছিল শেহার প্রতি, শেহা-রোশনের সম্পর্কে নাচই হয়ে উঠেছে অদৃশ্য সেতু। সম্বন্ধ করে হলেও, বিবাহপূর্ব মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন এই যুগল, পরস্পরকে বুঝে, জেনে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একসঙ্গে জীবন কাটানোর।

বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটি অবশ্য ছিল ছিমছাম, অনাড়ম্বর। সইসাবুদ সেরে খানিক কোরান পাঠ, অবশেষে ভায়োলিনে বেজে চলা জনপ্রিয় সব সিনেমার গানের সুর কানে নিয়ে কব্জি ডুবিয়ে মধ্যাহ্নভোজ।
ডঃ শেহার বিয়ের আসল আকর্ষণটি ছিল বিয়ের আগের রাতের ধামাকাদার নাচের অনুষ্ঠান, শেহা সেখানে শুধু কনে নন, গোটা অনুষ্ঠানের পরিচালক এবং প্রধান শিল্পীও বটে! সুইমিং পুলের ধারে শামিয়ানা খাটিয়ে, নিত্যনতুন পোশাকে ভাঙড়া থেকে সুফি, মূলধারার বলিউড থেকে ফ্ল্যামেঙ্কো কিম্বা কেরলীয় মুসলমানদের নিজস্ব নৃত্যশৈলী ওপ্পানা, কোনোটাই বাদ ছিল না। অনুষ্ঠানের আসল দর্শক ছিল সারি সারি ক্যামেরা, কখনও ক্লোজ-আপ, কখনও প্যানোরমা, নানারকম স্পেশ্যাল এফেক্ট, সবমিলিয়ে ক্যামেরাই ছিল গোটা অনুষ্ঠানের আসল পরিচালক। কুশীলবরা কখন ঢুকবেন কখন বেরোবেন কী ভাবে হাঁটবেন নাচবেন তাকাবেন হাসবেন, সবটাই নির্ধারিত হয়েছিল ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ থেকে। মেহেন্দি থেকে গায়ে হলুদ, উত্তর ভারতীয় বিবাহের সমস্ত লোকাচারই অনুসরণ করেছেন শেহা, তাতে অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে বর্ণময়, সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর কাড়ার পাশাপাশি মুছে গিয়েছে সাংস্কৃতিক বিভেদ।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article