31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

শিল্পে নিঃশ্বাস নিচ্ছে অবরুদ্ধ ইরান

Must read

বাংলাস্ফিয়ার — জ্যামে আটকে থাকা গাড়ির ভেতর বসে দরদর করে ঘামতে ঘামতে কিম্বা ধুলো-ধোঁয়ায় দম আটকে খাবি খেতে খেতেও চমৎকার সব দৃশ্যে চোখ আটকাচ্ছে, চোখ জুড়োচ্ছে আজকাল, তেহরানের মানুষের। প্রাণের আনন্দে বহু ইতিহাসের সাক্ষী ইরানের রাজধানীটির সৌর্যায়ন করে চলেছেন একদল চিত্রশিল্পী। জনবহুল এই মহানগরের ধূলিধূসরিত রাস্তাঘাট আর পুরনো গলিপথগুলোকে বর্ণময় করে তুলতে, স্টুডিওর চার দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন এ শহরের চিত্রকরেরা। এই প্রবণতার বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল অতিমারি-দগ্ধ সময়ে, এখনও তাতে ভাঁটার টান লাগেনি।

সময়ের হাত ধরে পালটে যেতে থাকা পুরনো মহল্লাগুলোকে সংরক্ষণ করা এই চিত্রকরদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বুলডোজারের নির্মম আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া ঊনবিংশ শতকীয় ইমারতের জায়গায় মাথা তুলছে অত্যাধুনিক হর্ম্যরাজি। ভোল বদলে ফেলা পাড়া গলি রাজপথে যাতে ইতিহাসের গন্ধটুকু লেগে থাকে, সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।

বছর বত্রিশের মোর্তেজা রহিমি পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি হলেও শিল্পের প্রতি পরম অনুরাগ তাঁর। থাকেন তেহরানের উপকণ্ঠে।তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, পুরনো দিনের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে আছে যে স্মৃতিমেদুরতা, তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এই শিল্পীদের প্রয়াস। কত মনোরম অট্টালিকা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, মনে পড়ে যাচ্ছে;, আবেগমথিত করছে তেহরানের মানুষকে।

চিত্রকর হাসান নাদেরালি তুলির আলতো আঁচড় আর ঝলমলে রঙে আলো-আঁধারির খেলা ও গতিকে ধরতে চেয়েছেন অনেকটা যেন ইম্প্রেশনিস্ট অঙ্কনশৈলীতে। চার দেওয়ালের বাইরে খোলা আকাশের নীচে আঁকাজোকার প্রতি তীব্র আসক্তি বছর আটান্নের নাদেরালির, ধ্বংসের মধ্যে, ক্ষয়ের মধ্যেও যে রম্যতা,তাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি রঙ, তুলির সাহায্যে।

১৯৭৯-র ইস্লামিক বিপ্লবের সময়ে মাত্র সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যা ছিল যে শহরের, আজকে সেখানে দশ কোটি মানুষের পদচারণা। ১৯৮০-তে যখন ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হুসেন ইরান আক্রমণ করেন, সে সময় থেকেই দলে দলে মানুষ তেহরানে আশ্রয় নিতে থাকেন, নবনির্মিত এই ধর্মীয় রাষ্ট্রটির রাজধানীর জনসংখ্যা প্রায় বিস্ফোরক আকার নেয়। উচ্চশিক্ষা আর চাকরির খোঁজে রাজধানীতে মানুষের ঢল নামে। ফলত সঙ্কট তৈরি হয় বাসস্থানের।বিশালাকার সব আবাসন তৈরি করে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে সরকার। ১৭৯৬ সনে ইরানের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তেহরানে। ঊনবিংশ শতকে কাজার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শহরে যেসব সুরম্য হর্ম্য নির্মিত হয়, দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, গত কয়েক দশকে তাদের ধ্বংসস্তূপের ওপর মাথা তুলছে একের পর এক অত্যাধুনিক বহুতল আবাসন।এই ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিস্মৃতির যে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি, তা থেকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করেছেন শিল্পী ও ইতিহাসবিদরা।

মোজাইকের কারুকাজের জন্য বিখ্যাত কাজার রাজাদের অধুনা ভঙ্গুরপ্রায় প্রাসাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে শিল্প বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা মির্জা জানান ঐতিহাসিক গুরুত্বের এইসব প্রাচীন অট্টালিকা যে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি সে সম্পর্কে জনমত তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলেছে এইসব ঐতিহাসিক ইমারতের সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক মূল্য সম্পর্কে।

তেহরানের বিখ্যাত ওউদলাজান এলাকার বাসিন্দা, সরকারি কর্মচারি সোমাইয়া আবেদিনি চার দেওয়ালের বাইরে, খোলা আকাশের নীচে চিত্রসৃষ্টির এই যে ঝোঁক, তার এক পরম অনুরাগী। শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস সংরক্ষণের এই উদ্যম তাঁর ব্যক্তিসত্ত্বাকে আলোড়িত করে। ওউদলাজানের প্রতিটি খিলান, গলিপথ, বাগানবাড়ি তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, শিকড় ধরে টানে, মনে করিয়ে দেয় তাঁর বেহস্তে বাবার কথা, যাঁর শেষ নিঃশ্বাসটি মিশে আছে ইতিহাসস্পন্দিত এই প্রতিবেশে।

করোনার দমবন্ধকরা দিনগুলিতে আকাশের চাঁদোয়ার নীচে বন্ধনহীন শিল্পসৃষ্টি প্রাণিত করেছিল শিল্পীদের, মুক্তি দিয়েছিল তালাবন্ধ গ্যালারির নৈরাশ্য থেকে। ৭.২ কোটি মানুষ অতিমারির কবলে পড়েছিলেন, ১, ৪১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় ইরানে, এই সংখ্যা ছিল পশ্চিম এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুহার।

এই চরম স্বাস্থ্যসঙ্কট-জনিত অস্থিরতা খানিক প্রশমিত হতে না হতে বেশ কয়েকজন শিল্পী চার দেওয়ালের গন্ডির বাইরে নিয়ে এলেন তাঁর স্টুডিওটিকে। সূর্যালোকের উত্তাপ, বহমান বাতাসের স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে কাগজ-কলম-তুলি-রঙ-ইজেলে প্রাণবান হয়ে উঠলো তাঁর উন্মুক্ত শিল্প ঘর। রোজ বেড়িয়ে পড়তেন তাঁরা, এক এক দিন এক এক জায়গায়।জনবিরল রাস্তাঘাট হয়ে উঠতো তাঁদের নিজস্ব কর্মশালা।

তাঁদের আঁকা প্রাচীন পারসিক হর্ম্য, তেহরানের নিজস্ব কারুকাজের বাসস্থানের বেশ কিছু ছবি স্বদেশ বিদেশের শিল্পানুরাগী মানুষ কিনেছেন, আরো বেশি করে কিনেছেন স্মৃতিমেদুর প্রবাসী পারসিকরা।

বিশ্ব অর্থনীতির থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থদণ্ড এবং জীবনযাত্রার ক্রম-অবনয়নে, ক্রুদ্ধ বিরক্ত হতাশ ইরানের সাধারণ মানুষ আরো বেশি করে স্বান্ত্বনা খুঁজছেন অতীতচারিতার মধ্যে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সদিচ্ছায় আমেরিকা-ইরানের যে পারমাণবিক চুক্তির সম্পাদিত হয়, ২০১৮-র মে মাসে তা থেকে বেরিয়ে আসেন উত্তরসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে সেই চুক্তিটি পুণরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা শুরু হলেও কোনোরকম ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারেনি এই দুই দেশ। নানারকম অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় আস্তে আস্তে দারিদ্র্যের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে ইরান। অথচ, এত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও শত ফুল বিকশিত হয়ে চলেছে, সে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে।

১৯৮০ থেকে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয় ইরান ইরাকের মধ্যে, আর সেই সময় থেকেই রক্ষণশীল মোল্লাতন্ত্রও ধীরে ধীরে শিল্প-সংস্কৃতির গুণগ্রাহী হয়ে উঠতে থাকে। ইসলামি অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ এবং মৃত যোদ্ধাদের মহিমান্বিত করে আঁকা ছবিতে শহরের সব মলিন পাঁচিল ভরে উঠলো।

শাহ মহম্মদ রেজা প্যাহলাভি-র শাসনকালে খনিজ তেলের ব্যবসায় ইরানের অর্থনীতির রমরমার দিনে পাবলো পিকাসো, ক্লদ মনে, জ্যাকসন পোলক প্রভৃতি বিখ্যাত চিত্রকরদের যে সব কীর্তি সংগ্রহ করা গিয়েছিল, সাংস্কৃতিক নিষেধাজ্ঞা খানিক ঢিলেঢালা হওয়ার ফলে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে সেগুলি আবার প্রদর্শিত হচ্ছে।

পশ্চিমী সংস্কৃতির প্রতি তীব্র বিরাগ লালন করেন ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি। ২০২১ এ যখন তিনি নির্বাচিত হ’ন, তার কয়েকদিন আগেই জনপ্রিয় মার্কিনী শিল্পী অ্যাণ্ডি ওয়ারহলকে নিয়ে একটি প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তেহরানের মিউজিয়ামটি আবার খুলে দেওয়া হয়।

যে শিল্পের বাজার একদিন বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছিল, সফল জনপ্রিয় শিল্পীদের উদ্যম ও আগ্রহে তা আজ বেগবান স্রোতস্বিনী। ইরানী চিত্রকর তাঁর কীর্তির বিনিময়ে চড়া দর পাচ্ছেন। ক’দিন আগেই ২.২কোটি ডলারেরও বেশি দামে ১২০ টি চিত্রকলা বিক্রি হয়েছে ইরানের এক নিলামে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় দূরদর্শনে নিয়মিতভাবে ছবি আঁকার ক্লাস নেওয়া হয়, রঙ- তুলি-ইজেলে নিজেদের প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হয় অপেশাদার শিল্পীদেরও। অঙ্কনশিল্পে শিক্ষানবিশদের ভীড়ে গমগম করে ইরানের শিল্প শিক্ষালয়গুলো, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। প্রদর্শনীর আয়োজন করতে সরকারী অনুজ্ঞার প্রয়োজন, নতুন শিল্পীদের কাজ দেখতে ভীড় করে অল্পবয়সী শিল্পপিপাসু ছেলেমেয়েরা। তাঁদের মধ্যেই নাম-না-জানা অপরিচিত একটি মানুষ নাদেরালিকে বলেছিলেন,” দারিদ্র্যের মধ্যেই শিল্প প্রস্ফুটিত হয়, বৈভবে তা শুকিয়ে ওঠে।”

- Advertisement -

More articles

4 COMMENTS

  1. ‘…..দারিদ্র্যের মধ্যেই শিল্প প্রস্ফুটিত হয়, বৈভবে তা শুকিয়ে ওঠে ‘— লেখার একেবারে শেষ অসাধারণ লাইনটি যেন ‘ ধ্রুবপদ’ , যা পুরো লেখাটিকে চিরকালীন সত্যের বন্ধনে বেঁধেছে। যদি লেখাটি অনুবাদ হয়, তাহলে বলবো অনূদিত লেখাটি অনবদ্য।

    • ম‍্যাম অনুবাদ হলে আমার মনে হয় স‍্যর উল্লেখ করতেন। কার লেখা থেকে অনুবাদ করেছেন। আর স‍্যরের সবসময়ই সর্বোৎকৃষ্ট এটা বলার কী অপেক্ষা করতে হবে?

      দুঃখিত, অযাচিতভাবে মন্তব্য করলাম।

  2. এক চরম মৌলবাদী দেশ, যারা শিয়া পন্থী , যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে বিধ্বস্ত এবং আপনার লেখা থেকে জানলাম গত শতাব্দীর আটের দশকে ইরান ইরাক যুদ্ধের সময় একটা শহর তেহেরান, তার ওপর প্রচণ্ড রকম জনসংখ্যা চাপ, তার‌ও ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, এইসব উপেক্ষা করে তারা যে শিল্প সংস্কৃতি পথে আবার নতুন করে হাঁটতে চলেছে, আপনার এই লেখা পড়ে আমরা জানতে পারলাম। যদিও তৈল ভান্ডার থাকার জন্য তারা তেমনভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েনি, তবু একটা মুসলিম দেশে শিল্প সংস্কৃতির চর্চা যে হচ্ছে, এটাই আশ্চর্যের বিষয়। এই লেখাগুলো আমার মনে হয় আলাদা করে বই আকারে প্রকাশিত করলে বহু মানুষ লেখাগুলো পড়তে পারবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সমস্ত লেখা কিছুদিন পরেই হারিয়ে যায়। তাই আমার অনুরোধ, চেষ্টা করবেন যাতে এগুলো একটা বইয়ের মধ্যে সংগৃহীত হয়ে থাকে। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article