27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

তাবলে ভাবনা করা চলবে না

Must read

তাবলে ভাবনা করা চলবে না

সুমন চট্টোপাধ্যায়

অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে স্থির করলাম, সত্য কথাটা অকপটে প্রকাশ্যে বলে রাখাই ভালো। তাতে আমার আত্মার আরাম, হয়তো আপনাদেরও বিভ্রান্তির নিরসন।

ফেসবুকে অসংখ্য বন্ধু আমাকে রোজ অনুরোধ করছেন, এ বারের বিধানসভা ভোট নিয়ে লেখার জন্য। দু’টি কারণে এই অনুরোধ রক্ষায় আমি অপারগ। এক) আমি ক্লান্ত, শরীরে-মনে বিধ্বস্ত, একান্ত ভাবে ওষুধ-নির্ভর, বিশ্রাম বিনে গতি নেই। চলার মতো সঠিক সময়ে থামতে জানাটাও জীবনে খুব জরুরি। শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢোকাটা আমার পক্ষে চরম অস্বস্তিকর, এই খেলায় দূরের দর্শক হয়ে থাকাই আমার ভবিতব্য।

দ্বিতীয় কারণটি একটু স্পর্শকাতর, আমার পক্ষে গভীর বেদনার, তবু সূর্যের পূর্ব-গগনে উদয়ের মতো সত্য। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল আমি লিখতে চাই, বলতেও চাই। কিন্তু সেই সুযোগ আমাকে দিচ্ছে কে? এ পর্যন্ত কোনও খবরের কাগজ আমাকে লেখার আমন্ত্রণ জানায়নি, কয়েদ-বাসের আগে সাড়ে সাত বছর যে কাগজটির সম্পাদনা করেছি, সূতিকা-ঘর থেকে কোলে-পিঠে লালন করেছি, তারাও নয়। একই ভাবে ভোট সংক্রান্ত কোনও আলোচনায় সামান্য অতিথি হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণও কোনও টেলিভিশন চ্যানেলের কাছ থেকে পাইনি। আমি ব্রাত্যজন, কুষ্ঠরোগীর মতো অস্পৃশ্য, দীপান্তরবাসী। অড ম্যান আউট হু হ্যাজ নো টেকারস।

কেন এমন হল তা ব্যাখ্যা করার দায় আমার নয়, যারা আমাকে অস্পৃশ্য ঠাওরাচ্ছে তাদের। এটি তাদের নিজস্ব অধিকারের বিষয়ও বটে, আমার কিছু বলার থাকতেই পারে না। কিন্তু আমি বিমর্ষ নই, কাউকে দোষারোপ করার পক্ষপাতীও নই। জীবনের অসংখ্য চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, ঝড়ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করে আমি আন্তরিক ভাবেই মেনে নিয়েছি, ‘ভালো-মন্দ যাহাই ঘটুক সত্যেরে লও সহজে।

আরও একটি কথাও একই রকম সত্য। তা হল হালফিলের সাংবাদিকতায় আমার মতো বেয়াদপ, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে অভ্যস্ত একজন আপাদমস্তক বেমানান, কাবাব মে হাড্ডি। পরশুরাম লিখেছিলেন রেড়ির তেল আর ঝর্ণার জল মিশ খাবে না কখনও। স্বধর্মে অবিচল থেকে নিজের মতো করে নিজের গৃহকোণে সময় কাটাতে পারছি, এটা অভিশাপ নয়, মঙ্গলময়ের স্নেহাশীর্বাদ। কোতল হওয়া নিশ্চিত জানার পরে পাগলেও তো আর বধ্যভূমিতে যাবে না। আমার সঞ্চয় তো আমারই থাকবে, সেটা তো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!

হাতে রইল পেন্সিল। তাই দিয়ে নিধিরাম সর্দার ছাড়া আর কিছু হওয়া যায় না।

যে কোনও ভোটের কভারেজ শ্রমসাধ্য এবং ব্যয়সাধ্য। কর্মহীন জীবনে গ্যাঁটের টাকা খরচ করে আমি গাড়ি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ব এটা চরম বাড়াবাড়ি রকমের প্রত্যাশা হয়ে যাবে না? নিজের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে পণ্ডিতি ফলানোর আমি ঘোরতর বিরোধী, আমার সেই পাণ্ডিত্যই নেই। আমি বিশ্বাস করি মাঠে নেমে গায়ে ধুলো মেখে, মানুষের সঙ্গে অবিরাম কথা বলে তবেই ভোটের হাওয়ার একটা আঁচ পাওয়া সম্ভব, এর কোনও মেড-ইজি নেই। আমার যেহেতু সেই সুযোগ নেই তাই আমি ভোট নিয়ে স্পিকটি নট হয়ে আছি। আমি নিরুপায়।

এই ভাবেই কি তাহলে আমার ভবলীলা সাঙ্গ হবে? হয়তো নয়। আমি একে বাঙাল, তায় ভয়ঙ্কর রকমের ত্যাঁদোর, পথ যত বন্ধুর হয় আমার অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হয় সমানতালে। আমি রাজপ্রাসাদের সিংহাসন থেকে রাজপথে নেমে এসে হতোদ্যম হইনি। নিজের কাগজ করতে গিয়ে সম্ভাব্য সব ধরনের বাধার মুখে পড়েছি, অনিদ্রায় কেটেছে রাতের পর রাত, তবু প্যাভিলিয়নে ফেরার কথা ভাবিনি। ফলে যতদিন আমি বাঁচব কোনও না কোনও নতুন স্বপ্ন আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করবেই। আমার আর আমার স্বপ্নের মৃত্যু হবে একসঙ্গে, একই দিনে, একই ব্রাহ্ম মুহূর্তে।

আপাতত আমি তাই কেবল স্বপ্ন দেখছি আর গুনগুন করছি আমার গুরু গৌরকিশোর ঘোষের বড্ড প্রিয় একটি গান— তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে/ তা বলে ভাবনা করা চলবে না/ তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে/ হয়তো রে ফল ফলবে না/ তা বলে ভাবনা করা চলবে না/ আসবে পথে আঁধার নেমে/ তাই বলে কি রইবি থেমে/ তুই বারেবারে জ্বালবি বাতি/ হয়তো বাতি জ্বলবে না/ তা বলে ভাবনা করা চলবে না।

ভাবনা না করাটাই এখন আমার একমাত্র ভাবনা।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article