প্রথম চুম্বন
শম্পা সাহা
আমি প্রেমে পড়েছিলাম পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা চেহারা আর বড় বড় চোখের এক প্রবল রোমান্টিক সৈনিকের। প্রেম চলত চিঠিতেই। দেখাসাক্ষাৎ? ছুটিতে সে বাড়িতে এলে।
একবার পূজোয় সে বাড়ি এসেছে। দেখা হবে দু’জনের। দাঁড়িয়ে আছি মৌলালির মোড়ে আধঘণ্টার উপর। মনখারাপ, রাগ, অভিমানে মন টলমল, মুখ শুকিয়ে আমসি। শেষে দেখি তার প্রিয় বন্ধু, কান এঁটো করা হাসি হেসে বাস থেকে নামলো।
-নিখিল তোমাকে যেতে বলেছে। ওদের বাড়িতে। কাকিমা বাড়ি নেই। ফাঁকা বাড়ি। তাই ও আসতে পারল না।
মরণ! গা জ্বলে গেল। কিন্তু কী আর করা! এতদিন পরে দেখা হবে, বাড়িতে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বেরিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি ফিরলে ভালো দেখায় না। চললাম সেই হবু শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে। ইয়ে, মানে, মনে মনে তখনও সেটাই সত্যি ছিল।
বেল বাজাতেই দরজা খুললেন তিনি। সাদা পাজামা আর হাফ হাতা গেঞ্জি, এলোমেলো চুল। নির্ঘাত দুপুরে এক পেট সাঁটিয়ে ভাতঘুম দিচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হল গোটা বাড়িতে আমরা দু’জন! বুক ধড়ফড় করতে লাগল, পেট গুড়গুড়! কানের পাশে হাজার ফড়িং উড়লে যেমন হয়। নিজেকেই নিজে চোখ রাঙাচ্ছি! এ সব কী হচ্ছে, হ্যাঁ ?
সে আমার দিকে সেই বড় বড় চোখ মেলে তাকাল, লম্বা লম্বা চোখের পাতা আর কেমন একটা মায়াময় দৃষ্টি, ব্যস্ আমি ভুল বকতে শুরু করলাম….আমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হয় না, না? ভালোবাসা না ছাই! সব টাইমপাস!…. বলেই যাচ্ছি, সে হঠাৎ আমার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে দিল তার গুঁফো ঠোঁট দিয়ে। প্রথমে কেমন ঘুরে গেলো মাথাটা। একেবারেই অনুভূতিহীন, অসাড়!
ধীরে ধীরে সাড় ফিরে আসতে টের পেলাম, গভীর ভাবে চেপে বসে আছে তার ঠোঁট আমার ঠোঁটে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কষ্টে? যন্ত্রণায়? শ্বাসবায়ুর অভাবে? নাঃ! সে সব কিছু না। এক অবশ করা ভালো লাগা ,আমার ঠোঁট ছুঁয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে। তার বাঁ হাতটা আমার মাথার পেছনে, ডান হাতটা আমার কাঁধে! এ অবস্থায় কতক্ষণ ছিলাম জানি না। চোখ বুজে ডুবে যাচ্ছিলাম, অতলে, আরও গভীর অতলে!
দুহাত বাড়িয়ে খড়কুটোর মত কিছু ধরতে গিয়ে দেখি সে হাতদুটো বেইমানের মত আগলে ধরলো সে মানুষটার কাঁধ দুটোকেই, শক্ত করে। সে দিন আমি অমৃত পান করেছিলাম, না সে, জানি না!
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বেল বাজার পর সম্বিত ফেরে দু’জনের। ডোর বেল ততক্ষণে পাগলা ঘণ্টি হয়ে গিয়েছে! আমি সদ্য-হওয়া অভিজ্ঞতার আবেশ অনুভব করব, না দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রসভঙ্গকারী মানব অথবা মানবী সম্পর্কে আশঙ্কিত হব?
হৃদপিণ্ড বিদ্রোহ করছে, আর খাঁচার ভিতর থাকবে না। লাফ দিয়ে বাইরে পড়বে বলে প্রস্তুত। গলা শুকিয়ে কাঠ, মনে হচ্ছে ধরণী দ্বিধা হও, এ বার মরে যাই। ভূমিকম্প, পাতাল প্রবেশ বা বোমাবর্ষণ, যা হোক একটা কিছুতে! কিন্তু কিচ্ছুটি হল না,কিচ্ছু না! ফেললুম তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে। ততক্ষণে বীরপুঙ্গব ফৌজিটি অনেক সাহস জুটিয়ে দরজা খুলে দেখে, গঙ্গা আনয়নকারী ভগীরথের মত আমাকে সে বাড়িতে আনয়নকারী তার বন্ধুটি দাঁড়িয়ে আছে । ভগবান! চূড়ান্ত টেনশনের পর যেমন ক্লান্তি নামে তেমন এলিয়ে পড়ল গা-হাত-পা সব! কুলকুল করে ঘাম দিচ্ছিল ওই আশ্বিনেও! ওকেই কি কালঘাম বলে?
যাক! বন্ধুটিকে দেখে তবু খানিক আশ্বস্ত হওয়া গেল! সে মক্কেল শিকারি বিড়ালের মত গোঁফ খাড়া করে জিজ্ঞাসা করলো…
-তোরা কিছু করছিলি নাকি?
-কেন?
-না, চোখমুখের যা অবস্থা দেখছি!
-দেব এক থাপ্পড়।
বীর সৈনিক প্রেমিকার মানসম্মান বাঁচাতে মাঠে নেমে পড়েছে ততক্ষণে!
সেদিন দুটো সোল মিলেমিশে এক হয়েছিল, সেটুকুই মনে রেখে দিয়েছে সময়। কবে কখন সে সব ভেঙেভুঙে হাফ হল, আর কে মনে রাখে বলুন?