শুভেন্দু দেবনাথ
‘রাজা আসে যায় আসে আর যায়
শুধু পোষাকের রং বদলায়
শুধু মুখোশের ঢং বদলায়
পাগলা মেহের আলি
দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায়, ওই রাস্তায়
এই নাচে ওই গান গায়:
‘সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়! সব ঝুট হায়!’
কলকাতায় যখন রমরমিয়ে চলছে মানুষের প্রাণ নিয়ে কালোবাজারি, ঠিক সেই সময় কিন্তু যারা আসল রাজা তারা অদ্ভুত রকমের নিশ্চিত। দুর্বোধ্য, দীর্ঘ নৈঃশব্দের পরে হ্যাঁ একটা ব্যবস্থা হয়েছিল বটে কিন্তু সে এক মস্ত খুড়োর কল। সরকারি হাসপাতালে একজন করোনা আক্রান্তকে ভর্তি হতে গেলে প্রথমে স্বাস্থ্যভবনে নাম নথিভূক্ত করতে হবে, তারপর স্বাস্থ্যভবন থেকে একজন ডাক্তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফোন করবেন, তারপর যদি সেই ডাক্তার মনে করেন রোগীর অবস্থা ঠিক নয়, তাহলে তিনি যে হাসপাতালে রেফার করবেন রোগী সেখানে গেলে জায়গা হবে।
আর জনগণের হাল হয়েছিল হঠাৎ লটারি পাওয়ার মতো। স্বাস্থ্যভবনে রেজিস্টার তো হয়েছে, কিন্তু ২৪ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলেও ফোন আসে না। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টার মধ্যেই ফোন চলে এসেছে, তবে সেই সংখ্যাটা হাতে গোনা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি রোগীর কিছু হয়ে যায় এবং তাঁর যদি বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার মতো পকেটের জোর না থাকে তাহলে বাড়িতেই অসহায়ের মতো মৃত্যু এক রকম অনিবার্য। করোনার মধ্যেই এমন কেস আমরা হাতে হাতে প্রচুর সামলেছি। এবং কী ভাবে আর কেমন করেই যে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করেছি তা যাঁরা ফ্রন্টলাইন ভলান্টিয়ার, তাঁরা সম্যক জানেন।
একদিন করোনার মধ্যেই আমার এক ভাই কাম বন্ধু, যার সঙ্গে কবিতা লেখার সূত্রে পরিচয়, পরে ঘনিষ্ঠতা, তার ফোন আসে আমার কাছে রাত সাড়ে ৯টার সময়। করোনা পজিটিভ তার মা। বন্ধুটিও একজন ভলান্টিয়ার, তবে ফ্রন্টলাইন কর্মী নয়। বহু মানুষকেই সে নানা ভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে অক্সিজেন, হাসপাতাল, ওষুধ, খাবার সবরকম ভাবে। তো সেই বন্ধুটি ফোন করে জানায় তার বাবা-মা দু’জনেই পজিটিভ, কিন্তু মায়ের অবস্থা সেদিন সন্ধেবেলায় হঠাৎ ডিটোরিয়েট করে, খিঁচুনি দিয়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। অক্সিজেন লেভেলও দ্রুত ওঠানামা করছে। এদিকে স্বাস্থ্য ভবনে রেজিস্টার করা সত্ত্বেও ফোন আসেনি। ছেলেটি যখন আবারও স্বাস্থ্য ভবনে ফোন করে মায়ের অবস্থা জানায়, সেখান থেকে বলা হয় ফোন যাবে। ছেলেটি যখন জিজ্ঞাসা করে যে তার মায়ের এখন এই অবস্থা সে কী ফেলে রাখবে মাকে? উত্তর আসে এটাই তাদের প্রসেস, এত তাড়া থাকলে বা পেসেন্টের অবস্থা বেশি সঙ্গীন হলে প্রাইভেটে নিয়ে যান। আমাদের এটাই প্রসেস, এটার মধ্যে দিয়েই চলতে হবে।
এহেন পরিস্থিতিতে কখনও এসব না সামলানোর অভিজ্ঞতাহীন বন্ধুটি আমায় বলে, যে করে হোক মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ছুটে যাই তার বাড়ি বেলঘরিয়ায়, অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা বন্ধুটি আগেই করেছিল। তারপর শুরু হয় হাসপাতালে হাসপাতালে ফোন। কোনও হাসপাতালেই বেড নেই। উপায়ন্তর না দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, চুলোয় যাক স্বাস্থ্যভবন, এখন যে কোনও হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আগে নিয়ে যাই, তারপর দেখা যাবে। অ্যাম্বুল্যান্সে করে বেরিয়ে যাওয়া হয়। তার মধ্যেই চলতে থাকে ফোন। অ্যাম্বুল্যান্সে বসে টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ে আমার এই বন্ধু কাম ভাইটিও। এর মধ্যে এক সাংবাদিক বন্ধু এবং ডাক্তার বন্ধুর সহায়তায় ডিসান হাসপাতালে কথা হয়। বেডের ব্যবস্থা হয়ে। রাত প্রায় ১২টা নাগাদ আমরা ডিসানে গিয়ে কাকিমাকে ভর্তি করি। ভর্তির প্রসেস থেকে শুরু করে সব কিছু মিটল যখন, তখন ভোর চারটে। ক্লান্ত অবসন্ন আমরা বাড়ির পথে ফিরি।
কিন্তু এই ঘটনা আমাদের মনে বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। আমার সেই বন্ধু কাম ভাইটি মধ্যবিত্ত পরিবারের, খুব বেশি না হলেও মেডিক্লেমের সূত্রে তার ক্ষমতা আছে প্রাইভেট হাসপাতালে কয়েক দিনের চিকিৎসা করার। কিন্তু যাদের সে অবস্থা নেই তাদের কী হবে? কবে স্বাস্থ্যভবনের ২৪ ঘণ্টার সময় আসবে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা, না হয় আমরা যারা কাজ করছি তাদের হাতে পায়ে পড়া। আমরাও তো অসহায়, কত জনকে কানেকশন বের করে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাব? সরকারি তরফে ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেই ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। রয়েছে দালাল চক্র। যাদের বাড়িতে কোনও রোগীর অবস্থা হঠাৎই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তাদেরই পড়তে হয়েছিল বিশ বাঁও জলে। এমনতরো অসম্ভব পরিস্থিতি সামাল দিতে সত্যিই আমাদের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। ১০০টা হাসপাতালে ফোন করলে তার মধ্যে একটি হাসপাতাল হয়তো পজিটিভ উত্তর দিত যে, বেড আছে। তবে এক্ষুনি নয়, আগামী সপ্তাহে বেড খালি হবে, আপনারা তখন একবার ফোন করুন। ভেবে দেখুন একবার অবস্থাটা। একজন রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৬০-৬২তে নেমে গিয়েছে, ডাঙায় তোলা মাছের মতো সে শ্বাস নিচ্ছে, অথচ স্বাস্থ্যভবনের ২৪ ঘণ্টার সময় আর আসছে না। অগত্যা সেই অক্সিজেন সিলিন্ডারের হাহাকার, এবং তার কালোবাজারি।
এতো শহুরে চিত্র, তবু এখানে অনেক কিছু করে, অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাসপাতালের বেড জোগাড় হয়েছে, কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে, জেলার দিকের তাহলে কী অবস্থা দাঁড়িয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়।
প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে ব্লক লেভেলের স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকের সঙ্গে আমরা কথা বলে জানতে পারি সেখানে বেসিক ওষুধপত্রও নেই। প্রেসারের ওষুধ, সুগারের ওষুধ নেই। আমার এক ব্লক লেভেলের স্বাস্থ্যকর্মী বান্ধবীর সঙ্গে জানায়, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং হাসপাতালগুলিতে নূন্যতম যে ওষুধ সুগার, প্রেশার, হার্টের সেটা নেই। বাজারে চড়া দাম, সেই সুযোগে বেসরকারি ডাক্তাররা মোটা টাকা পকেটে ভরছে। ভ্যাক্সিন নেই অথচ স্লট বুক চলছে, ডেট ও স্থান দিয়ে দিচ্ছে। বৃদ্ধলোক এই রৌদ্রে অনেক দূর থেকে গাড়ি ভাড়া করে এসে খালিহাতে ফিরে যাচ্ছে। কীভাবে, কেন! স্লট কেন দিচ্ছে! দেশে এত ভ্যাকসিন কোথায় যাচ্ছে! কেন নূন্যতম ওষুধ নেই তাও আজ নয়, বহুদিন যাবৎ! কেন বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশে নর্মাল ডেলিভারি হচ্ছে যেখানে দুয়ারে সরকার আছে! কেন স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য গাড়ি দেওয়া হয়নি! অথচ তাদের আসতেই হবে ডিউটিতে৷
এতগুলো সরকারি বাস কী করছে, কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি কেন সব কিছু জানানোর পরেও!’
দু-তিন দিন পরেই আমার বান্ধবীটির আবার ফোন। জানাল, লকডাউনের মধ্যে কোনমতে একটা গাড়ি জোগাড় করে মাথাপিছু দেড় হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে তারা ডোমজুড় এলাকায় ডিউটিতে গিয়েছে। ৩টের সময় তাদের ডিউটি শেষ, কিন্তু এরপর সেই গাড়িটি আর তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। ওরা সিওএমএইচ এবং স্বাস্থ্যভবনকে লিখিত ভাবেও জানিয়েছে কিন্তু কোনও বন্দোবস্ত হয়নি। শেষমেশ বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ফাঁকা লরিতে করে তারা বাড়ি ফিরেছে। এই লকডাউনে স্বাস্থ্যকর্মীদের ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই। যারা জীবন বিপন্ন করে গত দেড় বছর ধরে লড়ে যাচ্ছেন, তারা বাধ্য ডিউটিতে যেতে, কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরার সামান্য নিশ্চয়তাটুকুও নেই।কত টাকা মাইনে পায় ওরা? যে রোজ দেড় হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে ডিউটিতে যাবে?
প্রতিবারই ভোটপর্ব মেটে, প্রতিবারই রাজা আসে আর যায়, প্রতিবারই হাজার প্রতিশ্রুতির ভিড়ে মানুষ শুধুই প্রতিশ্রুতির মোহতে ভুলে আঙুলে কালি লাগায়, কিন্তু প্রশ্ন করতে শেখে না। জবাব চাইতে জানে না। প্রতিবারই ভাবে কেউ আসবে, দিন বদলাবে, কিন্তু ওই ভাবনাটুকুই সার। আসলে রাজা এলো কী গেলো তাতে কি এসে যায়, আসল কথা হল রাজ্যপাট বদলাক আর না বদলাক, আমি-আপনি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই থাকব।