27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

অর্পিতাকে কাঁদতে দিন

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

এই মড়া-কান্না আসলে মায়া কান্না!
দূর, দূর, দূর এটা কান্না নয়, নাটক।

নচ্ছাড় মেয়ে একটা, এখন কুম্ভীরাশ্রু ফেলে সিমপ্যাথি পাওয়ার চেষ্টা করছে!

শুক্রবার জোকার ই এস আই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না দেখে অনেক ইক্ষণকামী বঙ্গপুঙ্গব এই সব মন্তব্য করে রমন-সুখ পাচ্ছেন। এই মনোবিকারের দু’টি বিদেশি প্রতিশব্দ আছে, একটি ইংরেজি, অন্যটি জার্মান। Sadist আর  Schadenfreude! দু’টি শব্দের অর্থই মোটামুটি এক — অন্যের, বিশেষত অপছন্দের লোকের দুর্গতি দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা।

আমি দুঃখিত একটি বাচ্চা মেয়ের হাপুস নয়নে কান্না দেখে আমার ছিটেফোঁটা আনন্দ হয়নি। বরং সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়েছে। আমি নিজে মেয়ের বাপ, বয়সে অর্পিতা তার চেয়ে হয়তো ছোটই হবে। কন্যার এ মতো দুর্দশা চাক্ষুষ করে আমার সামনে এক পৃথুলা, মলিন থান পরিহিতা, কিছুটা কর্কশ কণ্ঠের এক মধ্যবয়সী মহিলার মুখচ্ছবিটা স্মৃতিপটে ভেসে উঠল। অর্পিতার মায়ের।এমন অসহায়, বজ্রাহত, বেদনাবিধুর মুখ আমি কখনও প্রত্যক্ষ করেছি বলে মনে পড়ে না। অর্পিতাকে মাটিতে লুটোতে দেখে, কেন জানি না আমার মনটা ওর মায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। অসহায়তার একই ফ্রেমে আমি দেখলাম মা-মেয়ের মুখ।

বিশিষ্ট লেখক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্পিতার কাহিনির মর্মকথাটি বলে দিয়েছেন — যৌন দাসত্ব। এক্কেবারে আটপৌরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অর্পিতা, শিক্ষাদীক্ষা কতদূর বলতে পারব না। প্রথমে সে শিকার হয়েছে নিজের দুর্দমনীয়, মাত্রাজ্ঞান ও  কাণ্ডজ্ঞানহীন উচ্চাশার, যার ফলে তার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। আকাশের চাঁদ হাতের মুঠোয় পেয়ে যে অমাবস্যার অন্ধকারের কথা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে বসেছিল। উচ্চাশা আর লোভ দুই রিপুর তাড়নায় তার মনে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস জারিত হয়েছিল, এই অকল্পনীয় বিলাস-ব্যসনের মূল্য যদি এক অক্ষম বৃদ্ধের যৌনতৃপ্তি দিয়ে মেটাতে হয়, তাহলে সে আর এমনকী ব্যাপার! 

বুড়ো তো অচিরেই খাটিয়ায় উঠবে, তার কাছে থেকে যাবে বিপুল ঐশ্বর্য, যা হয়তো সেও এক জীবনে ভোগ করে উঠতে পারবে না। এই ট্রান্সজ্যাকশনাল ম্পর্কে প্রাপ্তির পাল্লা তার দিকে ভারী, সম্ভবত অর্পিতা সচেতন ভাবে সেই অঙ্কটাও কষে রেখেছিল। কোনও দিন যে আচম্বিতে তার অপরিণত মস্তিষ্কের ওপর এমন ভাবে আকাশ ভেঙে পড়তে পারে, গুমঘরের কালো অন্ধকারে স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপর অবশিষ্ট জীবনের অর্ধেক রাত কাটাতে হতে পারে, কোনও দিন সে কি এমন দুঃস্বপ্নও দেখেছিল? ফলে অপ্রত্যাশিত, অবিশ্বাস্য বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কায় মেয়ে যদি কান্নায় ভেঙে পড়ে বারেবারে মূর্ছা যায়, তা কি একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়? এ নিয়েও কুৎসিত কটাক্ষ করে যেতে হবে?

আমি এ কথা নিশ্চিত জানি, কাউকে গ্রেফতার করার অভিপ্রায় নিয়ে সে দিন ইডি অভিযান চালায়নি। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের দূরতম পরিকল্পনাও হানাদারদের ছিল না। মন্ত্রীমশাইয়ের বাড়িতে একগাদা সম্পত্তির দলিল এবং তাতে অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের নাম একাধিক জায়গায় লেখা আছে দেখে তাঁরা অর্পিতার বাড়িতে হানা দিয়ে বিপুল গুপ্তধনের সন্ধান পান। তারপর পরপর কী হয়ে চলেছে, সেই নাটক অভিনীত হচ্ছে আপনাদের সামনেই, আমি তার পুনরুক্তি করছি না। কিন্তু অন্তরালের সারসত্যটি হলো, পার্থবাবুর ব্যাখ্যাহীন অবিমৃষ্যকারিতার জন্যই তিনি মরেছেন, মরেছেন এই ভ্রান্ত আত্মপ্রত্যয়ের জন্য যে রাজ্য মন্ত্রিসভার দু’নম্বর ব্যক্তি, শাসকদলের মহাসচিবের বাড়িতে সহসা উষালগ্নে এসে কেউ দরজায় কড়া নাড়ার সাহসই পাবে না।পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এমন নাটকীয়, মশলাদার কাহিনি নিয়ে যদি কখনও টালিগঞ্জ-মার্কা ছবি হয়, তার নাম হওয়া উচিত ‘গান্ডু নাম্বার ওয়ান’।

শাসকদলের নানাবিধ দাদা-কাকাদের মই হিসেবে ব্যবহার করে কেরিয়ার গুছোনো তো অনেকেরই পরিচিত ব্যাধি। শাসকের হাত মাথায় থাকলে অনেক বন্ধ দরজা চিচিং ফাঁক হয়ে যায়, যোগ্যতা বা অভিনয় দক্ষতা থাকুক আর নাই থাকুক। বাম জমানায় এই উপদ্রবটি ছিল না। টালিগঞ্জকে কমিউনিস্ট নেতারা ধাপার মাঠের ফিলমি সংস্করণ বলে মনে করতেন। দাদা ধরলে দেওয়া নেওয়া হবে, দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে শরীর। হতে পারে এদের মধ্যে অর্পিতা ভাগ্যবান, সে এমন প্রকাণ্ড সাইজের দাদা ধরেছিল যাকে রাজনীতির দাতা কর্ণের আসনে বসানো যায়। তার মানে এই নয়, অর্পিতা একাই দাদা-সিঁড়ির সাহায্য নিয়েছে বা পেয়েছে।

শাসকদলে আর এক সত্তর ছুঁই ছুঁই নেতা আছেন, ম্যাজিকওয়ালাদের মতো পোশাক পরে, সং সেজে যাঁকে প্রায় রোজই কোনও না কোনও খেঁদি-পেঁচি তারকার বাহু সংলগ্ন হয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়। তিনি নাকি সকলেরই বাবা, গঙ্গাবক্ষে সুন্দরীদের নিয়ে উন্মত্ত নৌকা-বিহারও তিনি আয়োজন করে থাকেন বাবার মতো আদর-যত্নে। তিনিও দেখলাম পার্থবাবুকে পাপী বলে চিহ্নিত করেছেন!

এ পর্যন্ত ঠিক আছে। ইডি-র হেফাজতের মেয়াদ ফুরোলে পার্থ-অর্পিতার ক্ষমতার অসাম্যের ছবিটা আরও বেশি করে প্রকট হবে। বাংলার জেলে পার্থ ভিআইপি-র মর্যাদা পাবেন, প্রাপ্যের অতিরিক্ত আরও অনেক সুবিধে পাবেন, কপালে থাকলে বের হয়ে তিনি ঝাঁকের কই হয়ে ঝাঁকে মিশে যাবেন। অর্পিতার হবেটা কী? তার দিকে কেউ ফিরেও দেখবে কি? কে দেবে তাকে আইনি সাহায্য? অসহায়তার অতল সাগরে আস্তে আস্তে সে ডুবে যাবে। সবাই বলবে, ‘ওকে ছুঁয়োনা, ছুঁয়োনা ছি, ও যে চণ্ডালিনীর ঝি!‘ তার বেলা?

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article