নীলার্ণব চক্রবর্তী
গালিবকে আমায় চিনিয়েছিলেন, বাংলার এক সাহিত্যিক, রবিশঙ্কর বল। যিনি খোদার আসনের পাশে বসে রয়েছেন মনে হয় এখন। দারু খেতে খেতে জীবন থেকে তাঁর নিরঞ্জন হয়েছে, মরে গেছেন। তো, রবিদা একদিন গালিবের একটা লেখা শুনিয়েছিলেন,‘কয়েদ-এ-হয়াত ও বন্দ-এ-গম আসল মে দোনো এক হ্যায়/ মওতসে পেহলে আদমি গম সে নাজাত পায়ে কিঁয়ু।’ জীবনের সঙ্গে দুঃখ যে ওতপ্রোত, তার এমন একটা চমৎকার বিন্যাস দিলেন গালিব, কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে যা হয়তো। হয়াত কথার অর্থ হল জীবন। কয়েদ-ই-হয়াত মানে জীবনের জেলখানা। বন্দ-এ-গম, মানে দুঃখ-বন্দি। দুটোই এক, বলছেন গালিব। ফলে গালিবের হিসেবে জীবনটাই যখন জেলখানা, তা হলে বলাই যায় আলাদা করে জেলযাত্রার মূল্য কী-বা?
আছে, আলাদা করে জেলযাত্রার মূল্যও আছে। কারও কারও ক্ষেত্রে একশো বার আছে। লক্ষ্য করবেন, লেখার দ্বিতীয় লাইনে একটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কেন মৃত্যুর আগে মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে? কবি এখানে সারা জীবন ধরে দুঃখ থেকে মুক্তি না পাওয়ার একটি যুক্তি দিয়েছেন, নিজের প্রতিই এই পংক্তি, যাকে আমরা স্বগতোক্তি বলি, তা-ই। যে কাজে, খানিকটা নিজের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে নিজেকে দেখতে হয়। গালিব যা পেরেছিলেন জীবনের জেলখানায়। আর সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়েছে সত্যিকারের জেলে গিয়ে। জেলে তিনি উনিশ মাস ছিলেন, যদি ভাল মানের আত্মা থেকে থাকে আধারে, আত্মোপলব্ধির পক্ষে এটা কম সময় নয়। তা ছাড়া আত্মকে বাইরে থেকে দেখার জন্য যে ধরনের নির্ভেজাল অন্ধকার প্রয়োজন হয়, সেই অন্ধকার জেল তাঁকে দিয়েছিল বলে মনে হয়, ফলে সেই অন্ধকার আসলে আলো, নিজেকে দেখার জন্য এক অনবদ্য আলো। সুমনদার সেলিব্রিটিত্ব, তার সম্পাদকের দম্ভ, লেখকের লাভের অঙ্ক, সব ঝরে গিয়ে আসল ন্যাংটো মানুষটা বেরিয়ে এসেছিল তখন। এবং সেই নগ্নতাকে দেখার ক্ষমতা তৈরি হল তার পর। তার পর কলম চলল, ‘গুমঘর গুলজার’ হয়ে তা-ই বেরিয়ে এল বাইশের বইমেলায়।
অনেকে এই বই প্রকাশের আগে ফেসবুক থেকে সংবাদ জেনে গিয়েছিলেন। তাঁরা আমায় বলেছেন, মিডিয়ারই বেশির ভাগ, কেন আমি এক জন জেল-ফেরত সাংবাদিকের আত্মকথা প্রকাশে এতটা উদগ্রীব হয়েছি? তাঁরা সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নানা ‘কীর্তি’ বলে গিয়েছিলেন ফোনে। আমি চুপ করে শুনে গিয়েছিলাম, মিনিট দশ পর থেমে গিয়ে বলেছিলেন তাঁরা, প্রায় সবাই– রাখছি তা হলে। আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ ঠিক আছে, রাখুন। একজন বললেন, সুমনদা কী করেছে রে তোর জন্য, এই যে এত লেবার দিচ্ছিস, কত পয়সা দিচ্ছে প্রকাশক? আমি তাদেরও কিছু বলিনি ওই একই ভাবে, স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে কতক, বাচালতাকে সুইচ অফ করে, একটু অপাঙ্গে হেসে। আজ বলতে চাই কেন আমি এ বই করেছি, শুনুন: আমার যে ‘ভিতর’ রয়েছে, সেটি আমায় যা বলে করে ফেলি, তার সঙ্গে তর্কের কোনও ব্যাপার আমি রাখি না। তর্ক থাকেও না। কারণ সেই ‘ভিতর’ যা বলে তার একটা কড়া ধাতের যুক্তি থাকে। এ ক্ষেত্রে যুক্তিটা হল, সুমনদা লাগাতার যে ভাবে অপমানিত হচ্ছিলেন, কেন কে জানে তা যেন অনেক দূরে থেকে আমারও গায়ে এসে লাগছিল খানিক। আমি চেয়েছিলাম এই অপমানটা যখন পাল্লার এক দিকে, পাল্লাকে নামিয়ে দিয়েই চলেছে নীচে, পাতালে, তখন অন্য দিকে কিছু একটা চাপানো উচিত। সেই ভারের-ই নাম– গুমঘর গুলজার। বাটখারা শব্দটা সচেতন ভাবেই বললাম না, কারণ, বাটখারা এক নিরেট বস্তু, তার পাতা উল্টানো যায় না।
না, গুমঘর গুলজার এই বইটিতে শুধু সুমন চট্টোপাধ্যায়ের জেল-কথা নেই। রয়েছে আরও নানা লেখাপত্তর, যার মধ্যে আমি মনে করি প্রয়াত প্রিয়জনদের স্মরণে এখানে সুমন চট্টোপাধ্যায় যা লিখেছেন, তাতে সাহিত্য ভূমিতে তাঁর নামে বেশ কয়েক একক জমি নির্দিষ্ট হয়েছে। আসলে সুমনদা তো রিপোর্টার। রাজনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে চিনতেন লোকজন, কিন্তু রাজনীতি-অতীত একজন দুরন্ত রম্যরচনাকার যে তিনি, সেই পাথর-চাপা ললাটের অংশটা যেন এই বইয়ে ঝিলমিলিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
এখানে আরও একটি প্রসঙ্গ বলি। বইটির লেখাগুলি যখন আমায় সুমনদা দিচ্ছিলেন, আমি বলেছিলাম আপনি কিছু কাব্যজাতীয় লিখে দিন। মুক্তগদ্যরূপ যা। অন্তত এক ফর্মা এমন লেখা থাকুক না বইতে। কারণ সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু কথাসূত্রে আমার বার বার মনে হয়েছে যে, একজন কবিতা লেখক তাঁর মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে, গদ্যের আগুন লেগেছে, সে উঠছে না। অ্যালার্মও বাজছে না তার উপর। কে না জানে গদ্যের অগ্নিবাণে কত তাবড় পুড়ে মরে হেজে গেছে, ভূত হয়ে আছে। সুমনদা এ ক্ষেত্রে দ্বিধা-গৃহে ঢুকে এমন ভাবে তালা মারলেন যে সে কাজটি আমি হাসিল করতে পারিনি। আগামীতে কোনও দিন তা হবে নিশ্চয়ই। আঘাতকে পরশ ও পুরস্কার হিসেবে উগরে দেওয়ার আদর্শ মাধ্যম কবিতা, সুমনদা যেটা রসস্রোতে জানেন একদিন কাজেও করবেন আশা করি।
এই বইটি ৩২২ পাতার। একটি নব্য প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে। নাম– ভিরাসত আর্ট পাবলিকেশন। ঘটনাচক্রে এই প্রকাশনটির সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। ফ্লিপকার্টে বইটি পাওয়া যায় এখন। প্রথম পর্যায়ে ছাপা বইমেলায়, ফলে তাড়াতাড়ি সারতে হয়েছিল, প্রোডাকশনের মান ধুলোয় পড়ে গিয়েছিল। আপাতত ধুলো ঝেরে, পরের মুদ্রণে, সাফসুতরো করা হয়েছে বলে দেখেছি। আমি মনে করি সুমন চট্টোপাধ্যায় চাইলে এ বই অন্য কাউকে দিয়ে দিতে পারতেন, এখন নানা জন প্রকাশন করছেন এবং সাফল্যের সঙ্গেই। তা দেননি কারণ, বিষাদে ঘুমানো সুমন চট্টোপাধ্যায়কে জাগিয়েছিলাম আমি, বইয়ের ম্যানুস্ক্রিপ্ট সাজিয়েছিলাম। ভদ্রলোক সুমনদা, সাংবাদিক শুধু নন, তাই আর কোথাও দেওয়ার কথা ভাবেননি। ভাবলে ভাল হত কি না, সে প্রশ্নটা আজ তিনি ভাবছেন কি না জানা নেই।
আমি একটা দাবি করতে পারি, সুমন চট্টোপাধ্যায়কে আপনি কালো তালিকাভুক্ত করতে পারেন। অর্থ, সংবাদ ইত্যাদি যোগে নানা দিন ট্রেনে কফি হাউজের কলের জল ভরতে ভরতে যা-খুশি-তাই বলতে পারেন, কিন্তু গুমঘর গুলজারের লেখককে পারবেন না। বইটি এমনই রমণীয়।