আমিও মোরিমোতো হতে চাই
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জাপানি যুবাটির কাহিনি পড়ে আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
এই রে, গোড়াতেই বোধহয় মস্ত গলদ হয়ে গেল, একটি ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ বাংলা শব্দ ব্যবহার করে ফেললাম। দেখবেন আপনারা যেন আবার এ নিয়ে গোল পাকাবেন না। দিনকাল ভালো নয়, খুবই ভয়ে ভয়ে দিন কাটাই, সন্তর্পণে পা ফেলি, পারতপক্ষে নিজে কাউকে টেলিফোন করি না, ভুল করে আমায় কেউ করে বসলে ডান-বাঁ ভালো করে দেখে নিয়ে মেপেজোপে বাক্য নির্বাচন করি, রাজনীতির আলোচনা থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থাকি, পারলে আরও দূরে থাকতে চাই। অনুপ্রাণিত হতে গিয়ে আজ একটু খুচরো স্খলন হয়ে গেল, নিজ গুণে আপনারা মাফ করে নেবেন।
অনুপ্রাণিত হয়ে জাপানি যুবাটির মতো আমিও এক লাইনের একটি বিজ্ঞাপন দেব বলে মনস্থ করেছি।
Rent me, who does nothing.
আমাকে ভাড়া করুন, আমার কোনও কাজ নেই।
টুইটার, ফেসবুকে এই একটি লাইন লিখে জাপানি যুবাটি এমন শোরগোল ফেলে দিয়েছে যে ‘মইনিচিশিনবুম’-এর মতো নামী কাগজ বিশাল ছবি-সহ তার সাফল্যের কাহিনি প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নজরে পড়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসেরও।
যুবাটির নাম শোজি মোরিমোতো। বয়স সাঁইত্রিশ, ছিপছিপে লম্বা চেহারা। কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পরে কিছুদিন তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করেছিলেন। ধাতে সয়নি বলে কিছুদিন পরেই চাকরিতে রাম রাম করে দেন। যাওয়ার সময় প্রকাশনা সংস্থার দুর্মুখ মালিক শিজোকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, তুমি থাকলে না গেলে তাতে আমাদের কিছুই যায় আসবে না।
শোজি কোনও জবাব দিতে পারেননি, মনে দুঃখ পেয়েছিলেন। দীর্ঘমেয়াদি কোনও কাজের সুযোগ যখন কিছুতেই জুটছে না, শোজি অন্য এক জনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একটা টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে এক লাইনের আবেদনটি ছড়িয়ে দিলেন ভাইরাল-দুনিয়ায়। যে ভদ্রলোকর দৃষ্টান্ত শোজিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তিনিও কিছু করেন না, অথচ রোজ দু’বেলা নতুন নতুন গেরস্থের বাড়িতে পেটপুজোর আমন্ত্রণ পান।
দু’বছরে তিন হাজার জাপানি, পুরুষ এবং নারী, শোজির ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এই মুহূর্তে টুইটারে তার অনুগামীর সংখ্যা দু’লাখ আশি হাজার। গোড়ার দিকে শোজি দাতব্য করতেন, পয়সা নিতেন না। পসার জমার পরে তিনি এখন মাথাপিছু আট হাজার টাকা ফি নেন। কিছু না করার জন্য এমন লোভনীয় দক্ষিণা বোধ হয় একমাত্র জাপানিরাই দিতে পারেন।
ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতার জোয়ারে শোজি এখন ভেসে চলেছেন। একজন লিখেছেন, ‘হাঁটার সময় একজন সঙ্গী পেয়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমরা নিজেদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই হাঁটছিলাম, কেউ কোনও কথা বলিনি যদিও ইচ্ছে করলে বলতেই পারতাম’। দ্বিতীয় আর একজনের বক্তব্য, ‘হাসপাতালে যাওয়া নিয়ে আমি বেশ কিছুদিন ধরে গড়িমসি করছিলাম, শোজি সঙ্গ দেওয়ায় আমার দ্বিধা কেটে গিয়েছিল।’
নানা জনে নানা কারণে ডেকে নেয় শোজিকে। কোনও বাড়িতে হয়ত কোনও খেলার জন্য একজন কম পড়েছে, শোজির ডাক পড়ল। তবে বেশিরভাগ ডাকেরই উদ্দেশ্য সঙ্গ লাভ। এলাকা ছেড়ে কোনও পরিবার হয়ত দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে শোজি গিয়ে তাদের বিদায় জানিয়ে এলেন। বনিবনা না হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী যাচ্ছেন ডিভোর্স দিতে, শোজি তাদের সহযাত্রী। কাজের চাপে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যে সব স্বাস্থ্যকর্মী বিষাদে ডুবে আছেন মাঝে মাঝে গিয়ে তাদের মনের দুঃখের কথাও শোজি শুনে আসেন।
এক যুবতী লেখক মইনিচি শিমবুনের কাছে কবুল করেছেন তিনি বিভিন্ন দরকারে অন্তত দশবার মোরিমোতোকে ডেকে নিয়েছেন। হয়তো কোনও অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে গিয়েছেন, পাশে বসিয়ে রেখেছেন ভাড়া করা সঙ্গীটিকে। হয়তো কোনও দিন তার মনে হয়েছে প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদি গোপন বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, বন্ধুদের কারও কাছে মুখ খোলা যাবে না, নির্বাক শ্রোতার দায়িত্ব পালন করবেন শোজি। মহিলা জানিয়েছেন একবার নিষিদ্ধ পল্লিতেও পাশে থেকেছেন এই বিশ্বস্ত সঙ্গী। মহিলার কথায়, ‘আমি যখন ওকে আমার গোপন গন্তব্যের কথাটা বললাম, শোজি মন দিয়ে শুনলেন, কোনও কথা বললেন না, নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা। তখন আমার মনে হল সেই মুহূর্তে এমন নীরব সমর্থনই আমার একান্ত প্রয়োজন।’
শোজি মোরিমোতো নিজে কী ভাবে দেখেন তাঁর এমন অভিনব উদ্যোগকে? ‘আমি নিজে থেকে মুখ খুলি না, কেউ কিছু জানতে চাইলে সংক্ষেপে আমার যতটুকু জানা আছে, জানিয়ে দিই। লোকে যখন পিঠচাপড়ে দিয়ে বলে লড়ে যাও, আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। আমার মনে হয় যখন কেউ কিছু করতে চাইছে তখন সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটি হল, গোটা বিষয়টি একেবারেনিচু লয়ে নামিয়ে আনা, স্রেফ তাদের পাশে থাকা।’
নিজের কাজ, এত মানুষের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, এ সব নিয়ে শিজো মোরিমোতো একেবারেই যেন ভাবলেশহীন। কেউ যদি তাঁকে বলে, কিছু না করাটাও আসলে এক ধরনের সমর্থন, শিজোর জবাব হবে,‘আচ্ছা, তাই নাকি?’ শিজোর বিশ্বাস তিনি বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লোকের ডাকে সাড়া দেন না। তা সত্ত্বেও লোকে যদি আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে যে যার মতো করে এর ব্যাখ্যা করে তাঁর কিছুই করণীয় নেই।
জবাবে এই জাপানি যুবা কিছুটা বিবাগী কিছুটা উদ্ধত। ‘আমি কারও বন্ধু নই, কেউ আমার পরিচিতও নয়।সম্পর্ক মানেই নানা রকম জটিলতা, আমি সে সবের থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। তবে পাশে পেলে মানুষের অসহায় নিঃসঙ্গতাবোধে যে কিছুটা হলেও আরামের মলম লাগে, এটা আমি মানি।’
একাকীত্বের সমস্যা এখন ভুবন জুড়ে, অনেকের কাছেই বিরতিহীন নিঃসঙ্গতা যেন গলায় দড়ির ফাঁস। এমন সময়ে কেউ যদি নীরব সঙ্গ দিতে আসে, নিজে চুপ থেকে অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে, নিজের কোনও মতামত ব্যক্ত করে না, সবচেয়ে বড়ো কথা নানাবিধ জ্ঞান-বর্ষণ করে না, তাকে তো মানুষ স্বাগত জানাবেই। শিজো মোরিমোতোর কাহিনী ইঙ্গিত করছে এমন ‘ডু নাথিং’ সঙ্গদানেরও একটা বাজার হয়তো আছে, আছে কড়ি ফেলে সঙ্গসুধা পানের আকুলতা।
শিজোর সাফল্যের দৃষ্টান্তে তাই আমিও অনুপ্রাণিত। আমি এখন বেবাক বেকার, হাতে অফুরন্ত সময়। তাছাড়া এ কাজ করা মানে রথ দেখা আর কলাবেচা একসঙ্গে হয়ে যায়। সময় কাটে, বিনিময়ে সামান্য লক্ষ্মীলাভও হয়।
বাকিটা আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম। তবে এই নীরব পুরোহিতের দক্ষিণার ব্যাপারে দরাজ হলে তবেই আমাকে ডাকবেন!
রইলাম ডাকের প্রতীক্ষায়…