সুমন চট্টোপাধ্যায়
প্রিয়-সুব্রত অচ্ছেদ্য জুটির মাঝখানে প্রথম দেওয়াল উঠল জরুরি অবস্থার পরে, ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে। সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে প্রিয়র অসম লড়াই তার অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, এ বার এলো দল ভাঙার পালা। প্রিয়দা না ইন্দিরাজি, ইন্দিরাজি না প্রিয়দা, এই নিয়ে চূড়ান্ত মানসিক টানাপোড়েনের পরে সুব্রত সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রিয়দা নয় ইন্দিরা।
সুব্রতবাবু বলতেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী আমার কাছে ছিলেন একটি আবেগের নাম, যার আকর্ষণ ছিল চুম্বকের মতো। আমি কোথাকার কোন এক গাঁয়ের ছেলে তবু ইন্দিরাজি আমাকে নামে চিনতেন, স্নেহ করতেন। বুঝতে পারতাম তাঁর হৃদয়ে আমার জন্য অতি ক্ষুদ্র হলেও কোথাও একটা জায়গা আছে। ইন্দিরাজি কলকাতায় এলে খোলা জিপে শহরে প্রবেশ করতেন, তার সারথি হতাম আমি। সে এক অন্য রকম রোমাঞ্চ! বলে বোঝাতে পারব না।’
সে তো বুঝলাম, বিদ্রোহের রাস্তা থেকে দাদাকে সরিয়ে আনতে পারলেন না কেন?
‘কতবার কত ভাবে যে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কী বলব! তবে প্রিয়দাও নিজের জায়গায় ঠিকই ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল প্রিয়দা কংগ্রেসে থেকে গেলে সঞ্জয় গান্ধী তাকে কচুকাটা করে দিত। ফলে প্রিয়দা এমন এক অন্ধ গলিতে ঢুকে গিয়েছিল যেখান থেকে বেরোনোর আর কোনও উপায় ছিল না। আমি দিল্লিতে রাজনীতি করতাম না, সাংসদও ছিলাম না, ফলে আমার সেই সমস্যাটা ছিল না।’
সে সময়ে আবেগ-বর্জিত, বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নিয়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঠিকই করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে সব কংগ্রেস নেতা বিপন্ন ইন্দিরা গান্ধীকে ছেড়ে গিয়ে সাময়িক হাততালি কুড়োচ্ছেন, তাঁরা কেউই শেষ পর্যন্ত এঁটে উঠতে পারবেন না, ইন্দিরা যেখানে থাকবেন সেটাই হবে প্রকৃত কংগ্রেস। সত্যিই তাই হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসটাই হয়ে গেল ইন্দিরা কংগ্রেস।
আবার এমনও হতে পারে প্রিয়র সঙ্গে ‘হাইফেনেটেড’ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সুপ্ত ইচ্ছা আগে থেকেই ছিল সুব্রতবাবুর, এই সুযোগে তিনি তা চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন। তিনি যে কেবলই প্রিয়রঞ্জনের উপগ্রহ নন, রাজনীতিতে তাঁর নিজস্ব একটি সত্ত্বা আছে হয়তো তাকে প্রতিষ্ঠিত করার তীব্র তাগিদও সুব্রত মনে মনে অনুভব করতেন। এর জন্য তাঁর গায়ে অযথা ‘বেইমানের’ লেবেল সেঁটে কোনও লাভ নেই কেন না যে কোনও মানুষের জীবনেই এটি উচিত প্রত্যাশা। প্রিয়র প্রভায় প্রভাকর হয়ে জীবন কাটাতে হবে এমন মুচলেকা তো সুব্রত মুখোপাধ্যায় কাউকে লিখে দেননি। শিষ্য গুরুকে অতিক্রম করে যাবে এটাই তো আমাদের পরম্পরা।
অগ্রজ-অনুজ দু’জনে দু’পথে গেলেন, সাময়িক লাভ হল প্রথমে অনুজের তারপরে অগ্রজের। ১৯৮০-র ভোটে ইন্দিরা বিপুল ভোটে লোকসভায় ফিরে আসার পরে বিদ্রোহীরা কেউ নাকে খত দিয়ে ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া বলতে শুরু করলেন। কেউ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে লাগলেন, কেউ আবার অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে সন্ন্যাসই নিয়ে ফেললেন রাজনীতি থেকে। প্রিয় তখন এই ফ্যা ফ্যা পার্টির দলে, ইন্দিরা কংগ্রেসের বন্ধ দরজার বাইরে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। আর ঠিক সেই সময়টিতেই রাজ্য কংগ্রেসে সুব্রতবাবুর লাগামহীন বোলবোলা। যদিও ৭৭-এর ভোটে রাজ্যে কংগ্রেস ভো-কাট্টা হয়ে গিয়েছে।
অগ্রজের ভাগ্য ফিরল প্রথমে সঞ্জয়, তারপরে ইন্দিরার ইহলোক ত্যাগের পরে। রাজীবের জমানায় প্রিয়রঞ্জন কেন্দ্রে মন্ত্রী হলেন, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হলেন, তাঁর বৃহস্পতি আবার তুঙ্গে উঠল। অনুজের ফের পুনর্মূষিক ভব অবস্থা। তারপর অনেক ডামাডোল, হাই-ভোল্টেজ নাটক, চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে বাম-বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বের ব্যাটনটা চলে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। আর আজ তো রাজ্য কংগ্রেসের অবস্থা ভাগীরথীর জলে প্রায় ডুবন্ত গ্রামের মতো।
রাজ্যে কংগ্রেসের নির্মম পরিণতির ইতিহাস লিখতে বসিনি, স্মৃতিচারণ করতে বসেছি সেই দলের সদ্য প্রয়াত এক গুরুত্বপূর্ণ কুশীলবের। চলে গেছেন প্রিয়, তারপর সোমেন, সবশেষে সুব্রত। এই ত্রিমূর্তির প্রস্থানের মধ্যে দিয়ে যবনিকাপাত হল রাজ্য কংগ্রেসের ইতিহাসের একটি অতি ঘটনাবহুল পর্বের। রেখে গেল এমন অনেক প্রশ্ন যা নিয়ে ভাবীকালের গবেষক নির্ঘাৎ অনেক কাটাছেঁড়া করবেন।
প্রথম প্রশ্ন অনেক পরে মমতা যা পারলেন প্রিয়-সুব্রতর দ্বারা তা সম্ভব হল না কেন? বাগ্মিতা, জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা প্রিয়র কিছু কম ছিল না। পিছনে ‘টেইল উইন্ড’ থাকলে আকাশে বিমানের যেমন গতি বাড়াতে বাড়তি সুবিধে হয়, বঙ্গ-রাজনীতির আকাশে সর্বাগ্রে সেই টেইল উইন্ড ছিল প্রিয়-সুব্রত জোটের পিছনেই। অথচ তাঁরা তার সুযোগ নিতে পারলেন না। কংগ্রেসে প্রিয়র যাঁরা সমসাময়িক তাঁরা অনেকেই কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর বিরোধিতা করার পরেও যে যাঁর রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। যেমন মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ার কিংবা কেরলে এ কে অ্যান্টনি। জীবদ্দশায় সেই মর্যাদাটুকু প্রিয় অথবা সুব্রত কেউই পেলেন না।
পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর যাবৎ বামপন্থী শাসন শুধু যে কমিউনিস্টদের চারিত্রিক স্খলনের কারণ হয়ে উঠেছিল তা নয়, বিরোধী কংগ্রেসের চরিত্রটাও বদলে দিয়েছিল। তার অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তিটারই মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো সঙ্গে ছিল হাইকমান্ডের চাপ, বামেদের সঙ্গে রাখতে হবে। একদিকে দিল্লির রক্তচক্ষু অন্যদিকে দুর্ভেদ্য লাল দেওয়াল, এমন বন্ধ্যা অবস্থায় কংগ্রেসের নেতারা যখন বুঝলেন তাঁদের ধাক্কায় বিশেষ কাজ হওয়ার নয়, তাঁরা অন্তরালে সমঝোতার রাস্তা ধরলেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরি হল। তাতে শাসকের তেমন কিছু গেল এল না, কিন্তু বিরোধী কংগ্রেসের দারুণ ক্ষতি হয়ে গেল। ভাবমূর্তির, বিশ্বাসযোগ্যতার। গোড়ায় যা ছিল একজন ব্যক্তির গায়ের লেবেল, এক সময় তা সেঁটে গেল গোটা দলটির গায়েই। তরমুজ। ওপরে সবুজ, ভিতরে লাল। ইতিহাস তাঁকে কী ভাবে স্মরণ করবে, আদৌ করবে কি না বলতে পারব না, তবে সব ক’টি গুণ থাকা সত্ত্বেও সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মঘাতী আত্মসমর্পণের জন্য নায়কের মর্যাদাটুকু পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেল।
ব্যক্তি সুব্রত লা জবাব, আড্ডাবাজ, রসিক, আমুদে, পরোপকারী। দুনিয়ার নানা দেশ দেখার ফলে তাঁর এক ধরনের বিশ্ববীক্ষা ছিল, গড়পড়তা বাঙালি রাজনীতিবিদের মধ্যে যেটা দেখা যায় না। কণ্ঠস্বরটা ভাঙা যদিও তা অনর্গল কথা বলায় বাদ সাধেনি। গুণীর কদর করতে জানতেন, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, সাংবাদিক, সৃষ্টিশীল যে কোনও মানুষকেই তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতেন। এই যে বাইপাসের ধারে যে জমিটির ওপর বর্তমানের সুরম্য অট্টালিকা, তার পিছনে সুব্রতবাবুর বদান্যতা অনস্বীকার্য। কাছাকাছি আনন্দবাজারও একই কারণে পুরসভার কাছ থেকে জমি পেয়েছিল। আসলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় বৃহদার্থে আনন্দবাজারি সংস্কৃতিরই বাহক ছিলেন, অভীক সরকার আর বরুণ সেনগুপ্ত দু’জনই ছিলেন তাঁর ভরসাস্থল?
প্রশাসক সুব্রত মুখোপাধ্যায়? যারপরনাই সংক্ষেপে আনপুটডাউনেবল। সিদ্ধার্থ শঙ্করের মন্ত্রিসভায় তাঁকে আমি কাজ করতে দেখিনি, তখন আমি স্কুলে, কিন্তু কলকাতা পুরসভার মেয়র, পরে পঞ্চায়েত মন্ত্রী হিসেবে দেখেছি। কলকাতা পুরসভার কাজে শৃঙ্খলা, সময়ের কাজ সময়ে করা, নিয়ম কানুন মেনে চলা এ সবই কড়া হাতে তিনি লাগু করেছিলেন। চারদিক থেকে তাঁর ওপর চাপ এসেছে, দলের কাউন্সিলররা ঘনঘন বিদ্রোহ করেছেন। পুরসভার তৃণমূলী ইউনিয়নের সঙ্গে সংঘাত হয়েছে, অনড় সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর মেয়াদকালে এক জনকেও এমনকী চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করেননি। তাঁর সোজা সাপটা যুক্তি ছিল, একে পুরসভার আর্থিক সঙ্কট, তায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লোক কর্মরত, আমি আর নতুন করে লোক নিতে যাব কেন? সু্বত যখন কলকাতা পুরসভার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, কোষাগার ছিল শূন্য, ধার নিয়ে কাজ চালাতে হতো। পাঁচ বছর পরে তিনি যখন দায়িত্ব ছাড়লেন কোষাগারে কয়েক’শ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত।
আর রাজনীতিক সুব্রত মুখোপাধ্যায়? অনেকটা সেই বহতা নদীর মতো, হঠাৎ মরুপথে এসে যার ধারাটাই হারিয়ে গেল। (শেষ)