সুমন চট্টোপাধ্যায়
মিকি-মিনি মাউস
প্রিন্স চার্মিং-সিন্ডারেলা
রোমিও-জুলিয়েট
সাইমন-গারফ্রাঙ্কল
শার্লক-ওয়াটসন
বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তাই না? চলুন আমাদের এই বঙ্গভূমে নেমে আসা যাক।
উত্তম-সুচিত্রা
ফেলুদা-তোপসে
প্রিয়-সুব্রত
অনেকটা যেন কান টানলে মাথা আসার মতো। ঠান্ডা মাথায় হিসেব করলে দেখা যাবে, প্রিয়-সুব্রতর মানিকজোড়ের সম্পর্ক সময়ের বিচারে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। মেরেকেটে ১০-১২ বছর। তবু পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস রাজনীতিতে এই জুটি কেমন একটা ‘মিথের’ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘ইয়ে জুড়িদা জবাব নেহি!’
১৯৭২-এ কংগ্রেসের ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপট তৈরির কাজে প্রিয়-সুব্রত জুটির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সন্দেহ নেই। যদিও সেই ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এটুকু বিলক্ষণ জানা আছে, সেই কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্বের সমতুল নয়। তাছাড়া ৭২-এর ভোটে কংগ্রেস যে লাগামছাড়া রিগিং করেছিল সেটাও তর্কাতীত। ২০১১-য় যেটা মমতার প্রয়োজন হয়নি। এটুকু বোধহয় নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাজ্য কংগ্রেসের বৃদ্ধতন্ত্রকে অনেকটাই কোণঠাসা করে দিয়ে এই জুটি সংগঠনটির চরিত্র অনেকখানি বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অনেক যুবা তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমেছিল। গান্ধীর মাথার টুপিটা নয় তাঁর হাতের লাঠিটাই হয়ে উঠেছিল নয়া প্রজন্মের লড়াইয়ের অস্ত্র।
এই যেমন সুব্রত মুখোপাধ্যায় সুযোগ পেলেই দলের প্রবীণদের হেনস্থা করতেন। একবার অভিযোগ উঠেছিল, তিনি আভা মাইতির শাড়ি ধরে টান দিয়েছিলেন উত্তেজিত হয়ে। আর একবার প্রফুল্ল সেনকে মুখের উপর বলেছিলেন, ‘শুনুন, আমাদের সঙ্গে লড়তে যাবেন না, আমরা হলাম জাতীয়তাবাদী নকশাল।’ সোনার পাথরবাটি আর জাতীয়তাবাদী নকশাল একই বস্তু। তবু এই ধরনের মজার মজার মন্তব্য করার অভ্যাসটি ছিল সুব্রতবাবুর জন্মগত। মমতা সম্পর্কে প্রকাশ্যে যত বিদ্রূপ সুব্রত মুখোপাধ্যায় করে গিয়েছেন, দ্বিতীয় কোনও নেতার সেই সাহস হয়নি।
আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, প্রিয়-সুব্রত ‘গুড কপ-ব্যাড কপ’ খেলা খলতেন। আবার বৈপরীত্যের আকর্ষণ বললেও খুব ভুল বলা হবে না। প্রিয় গুপী গাইন হলে সুব্রত বাঘা বাইন। প্রিয় তাত্ত্বিক, ওষ্ঠে সরস্বতী, দিল্লি দাপাচ্ছেন, নির্বিবাদী, ভালো মানুষ। সুব্রত বাঘা তেঁতুল, দুরন্ত সংগঠক, প্রতিপক্ষের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। এ মতো মানিকজোড়, এমন নিঃস্বার্থ আত্মিক বন্ধন, এমন অনায়াস পারস্পরিক নির্ভরতা কংগ্রেস রাজনীতিতে আর দেখা যায়নি। অবাম রাজনীতির মাঠে প্রিয় তখন মেসি হলে সুব্রত অবশ্যই নেইমার।
৭১-এর লোকসভা ভোটে বিপ্লবী গণেশ ঘোষের মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় বাম নেতাকে হারিয়ে প্রিয় গেলেন লোকসভায়, সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। পরের বছর পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভা। মুখ্যমন্ত্রীরা সাধারণত যে দু’টি দপ্তর নিজেদের কাছে রাখেন তার রাষ্ট্রমন্ত্রী করা হল সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে- স্বরাষ্ট্র ও তথ্য সংস্কৃতি। সাঁতার শেখার জন্য সোজা ইংলিশ চ্যানেলে নামার মতো। এমন স্বীকৃতি তিনি কোনও দাদা ধরে পাননি, আদায় করে নিয়েছিলেন।
৭৫-এ দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে তথ্যমন্ত্রী হওয়ার সুবাদে সুব্রতবাবুই অঘোষিত মালিক হয়ে উঠলেন রাজ্যের সব খবরের কাগজের। তাঁর হাতেই থাকত সেন্সরের কাঁচি, কোন খবরটা ছাপা হবে, কোনটা হবে না সে ব্যপারে তিনিই ছিলেন শেষ কথা। আনন্দবাজারের অগ্রজদের মুখে শুনেছি, এই দায়িত্বটি পালন করতে গিয়ে সুব্রত কখনও স্বভাবসুলভ দাদাগিরি দেখাননি। একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে পরে অনেকবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। প্রতিবারই দেখেছি সুব্রতদার মুখ লাজে রাঙা হয়ে উঠেছে। ‘আমার দুরবস্থার কথাটা একবার ভাবো। সম্পাদকীয় লিখছেন কারা? সন্তোষ কুমার ঘোষ, গৌর কিশোর ঘোষ, নিখিল সরকার। আর হাতে লাল পেন নিয়ে তার ওপর চোখ বোলাচ্ছে কে? যার নিজেরই ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙার অবস্থা। তার ওপরে সাধুভাষা, বাপের জন্মে শুনিনি এমন সব শব্দ, কঠিন বাক্যবন্ধ, আমার মনে হতো এর চেয়ে বড় শাস্তি আমাকে কেউ কখনও দেয়নি। এই ভাবে দিন কতক যাওয়ার পরে আমিই হাতজোড় করে বললাম, এমন কিছু লিখবেন না যাতে আমার চাকরিটা চলে যায়। ব্যস তাতেই কাজ হয়ে গেল।’
প্রিয়-সুব্রত দু’জনেই গ্রামের ছেলে, প্রথমজন কাঠ বাঙাল, দ্বিতীয়জন বিশুদ্ধ ঘটি। বরিশালের উদ্বাস্তু পরিবারের সন্তান প্রিয়র কলেজ জীবন পর্যন্ত কেটেছে অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে। সুব্রত মাস্টারমশাইয়ের সন্তান, বজবজের কাছে একটি গ্রামে তাঁর বেড়ে ওঠা। আশ্চর্যের কথা, দু’জনেই মোহনবাগানের সমর্থক। আমার বরাবর মনে হয়েছে বাকি সব বিষয়ে প্রিয়কে গুরু মানলেও এই একটি বিষয়ে তিনি বাঙালের পোলাকে জাতিচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একটা সময় পর্যন্ত সুব্রত কলকাতায় থাকলে মোহনবাগানের একটা খেলাও বাদ দিতেন না। অনেকটা আর একজন তালিবানি মোহনবাগানি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো।
যৌবনে সত্যিই কেমন ছিল গুরু-শিষ্যের ভাব-ভালোবাসা? শুনুন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জবানিতেই। ‘আমার বা প্রিয়দার কলকাতায় কোনও ডেরা ছিল না, বাড়ি ভাড়া করে থাকার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। মহাজাতি সদনে একটা এক চিলতে ঘর পেয়ে গেলাম বরাতজোরে। ঘরে একটা মামুলি চৌকি, তার উপরেই দু’জনে জুড়িসুড়ি মেরে শুয়ে থাকতাম। দু’জনেরই দুটো করে খাদির ধুতি আর কলারওয়ালা মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। প্রতি রাতে শোয়ার আগে আমার ডিউটি ছিল দু’জনের কাপড়ই কেচে বাইরের বারান্দার রেলিংয়ে মেলে দেওয়া।’
‘একবার প্রিয়দার জল বসন্ত হল, সারা গায়ে বড় বড় গুটি, সঙ্গে ধুম জ্বর। বিছানায় পড়ে প্রিয়দা সারা রাত ধরে কাতরাচ্ছে, আর আমি চন্দনের বাটা জোগাড় করে মশারির তলায় বসে গুটিগুলোর ওপর বুলিয়ে দিচ্ছি। এ ভাবে একজন পক্সের রোগীর সঙ্গে লেপটে থাকলে আমি নিজেও যে সংক্রামিত হতে পারি, সেই ভাবনাটাই তখন আমার মাথায় আসেনি। তখন আমার মনে হচ্ছে, আহা প্রিয়দার যখন এত কষ্ট হচ্ছে আমারও হোক। চলব একসঙ্গে, লড়ব একসঙ্গে, তেমন হলে মরবও একসঙ্গে।’
ঠিক যেন ‘রাম অউর শ্যাম’-এর চোখে জল আনা চিত্রনাট্য! (চলবে)