সুমন চট্টোপাধ্যায়
নিয়মিত পুজো-আচ্চা করেন না বা গলায় মাদুলি, বাহুবন্ধে তাবিজ, আঙুলের আংটিতে নানাবিধ পাথর ধারণ করেন না, এ রাজ্যের অ-বাম রাজনীতিতে এমন চরিত্র আমি প্রায় দেখিনি বললেই চলে। সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে তাঁকে কখনও ঠাকুর-দেবতার কথা বলতে শুনিনি বা জ্যোতিষ-চর্চা করতে দেখিনি।
বাইরে যাঁরা এত দাপুটে নেতা, পারলে হাতে মাথা কাটেন, ভিতরে ভিতরে তাঁরা এত দুর্বল, এত সংস্কারগ্রস্ত কেন, আমি তার সদুত্তর খুঁজে পাইনি। একটি কারণ হতে পারে এঁদের রাজনৈতিক জীবন ভরপুর অনিশ্চয়তায় ভরা, দলের সর্বোচ্চ নেতার সামান্য ইঙ্গিতেই আজ যাঁকে রাজা বলে মনে হচ্ছিল কাল সেই তিনিই ফকির বনে যেতে পারেন। অতএব ভগবান ও ভাগ্যদেবীকে সদা প্রসন্ন রাখার এমন সম্মিলিত উদ্যোগ।
যেমন প্রণব মুখোপাধ্যায় রোজ সকালে এক্কেবারে নিয়ম করে চণ্ডীপাঠ করতেন। গোটা চণ্ডী তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। দিনের ওই সময়টিতে প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেও প্রণববাবু ধরতেন না। একই অভ্যেস আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তিনিও গড়গড় করে চণ্ডী মুখস্থ বলে যেতে পারেন। প্রিয়রঞ্জনকে প্রাত্যহিক পুজো-আচ্চা করতে দেখিনি তবে তিনিও দীক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন। বাবামণি আর মামনণির। সোমেন মিত্রর হাতের আঙুলে এক সময় এতগুলি পাথর থাকত যে দেখে মনে হতো তিনি অনায়াসেই পি সি চন্দ্র অথবা সেনকোর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হতে পারেন। সুব্রতবাবুরও পুজোর অভ্যেস ছিল, গলায় পৈতে রাখতেন, রামকৃষ্ণ- মা সারদার একনিষ্ঠ ভক্ত।
কেবল একটি বিষয়ে সুব্রত এঁদের সকলের চেয়ে আলাদা ছিলেন। ভূতগ্রস্ততায়। রাত যত বাড়ে, সমানুপাতে তাঁর ভূতের ভয়ও বাড়ে।
চোখে দেখা একটি ঘটনার কথা বলি। দিল্লিতে সুব্রতবাবুর হোটেলের ঘরে আড্ডা দিতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, একটা-দেড়টা তো হবেই। অফিসের সব কাজ সাঙ্গ হতে হতেই রাত ১০টা-সাড়ে ১০টা হয়ে যেত, তারপর যেতাম সুব্রতদার হোটেলে আড্ডা দিতে। সেদিন রাতে চেয়ার ছেড়ে উঠব উঠব করছি, হঠাৎ দরজা ঠেলে এক যুবকের প্রবেশ। তার বগলে একখানি ময়লা তোষক, হাতে বালিশ। দেখে শুনে মনে হল না যুবাটির সঙ্গে সুব্রতদার পূর্ব পরিচয় আছে। ঘরের এক কোণে তোষক-বালিশ রেখে সে বেরিয়ে গেল বেশ বিড়ম্বিত মুখেই। কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে প্রশ্ন করি, ‘এ ছোকরা কে গো? হঠাৎ এত রাতে তোষক-বালিশ নিয়ে তোমার ঘরে! কেসটা কী?’
‘এই হোটেলে কাজ করে। আমি ম্যানেজারকে বলে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। এখানেই শোবে বলে। রাতে আমি একা ঘরে থাকতে পারি না, ভূতের ভয় করে।’
ভূতের ভয় অনেকেরই থাকে, আমার গিন্নিরও আছে, কোটি টাকা দিলেও সে রাতে একা অন্ধকার ঘরে কিছুতেই ঢুকবে না। কিন্তু তাই বলে পয়সা দিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলেকে নিজের ঘরে ডেকে এনে ভূতের মোকাবিলা? এই সব মুহূর্তে নিজের অক্ষমতার জন্য আক্ষেপ হতো খুব, মনে হতো ইশ আমি যদি গপ্পো লিখতে পারতাম, এমন দুর্লভ অভিজ্ঞতার প্রতি সুবিচার করা যেত। দিনের আলো ফুটলেই যাঁর মুখে জঙ্গিয়ানার ফুলঝুরি ছোটে, রাতের অন্ধকার ঘন হতে থাকলে সেই বীরপুরুষই যে ভিতরে ভিতরে বেতসপত্রের মতো কাঁপতে শুরু করে দেয় অদৃশ্য কোনও অশরীরির ভয়ে, মনুষ্য চরিত্রের এমন নাটকীয় বৈপরীত্য চাক্ষুষ করে সে রাতে সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
সুব্রতবাবু কেবল যে ভূতে বিশ্বাস করতেন তা নয়, জোর গলায় দাবি করতেন ভূত-পেত্নি-দত্যি-দানোদের দর্শনলাভেরও সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। যেমন, দলীয় কাজে বহু বছর আগে একবার প্রিয়বাবুর সঙ্গে তাঁকে লখনৌ যেতে হয়েছিল। বাকিটা তাঁর মুখেই শোনা যাক। ‘এক রাত্তিরের মামলা বলে আমরা বেশি খোঁজাখুঁজি না করে গোমতী নদীর তীরে একটি সরকারি গেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। পাশাপাশি দুটো সিঙ্গল বেড, দুটোতেই মশারি টাঙানো। দুটো খাটের মাঝে এক চিলতে জায়গা। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মনে হল কে যেন আমার মশারিটা নিয়ে টানাটানি করছে। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখি, আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে মোড়া কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো নিবদ্ধ আমার ওপর। আমি তো ভয়ে গোঙাতে শুরু করে গিলাম, সেই গোঙানি শুনে প্রিয়দারও ঘুম ভেঙে গেল। তারপর দু’জনেই শুরু করে দিলাম চিল-চিৎকার, দারোয়ান জলদি আও। দারোয়ান এল কিছুক্ষণ পরে। সেটা বড় কথা নয়, ব্যাটার ছেলে খুবই নির্লিপ্ত গলায় জানিয়ে দিল, এ বাড়িতে প্রতি রাতেই অশরীরিরা ঘোরাঘুরি করে। আমরা যে ঘরটিতে শুয়ে আছি সেটাই ওদের সবচেয়ে পছন্দের। ওটা নাকি কোনও কালে নবাব-বাড়ি ছিল, অতৃপ্ত আত্মারা সেই বসতের মায়া কাটাতে পারেনি।’
তারপর কী করলে?
‘কী করলাম মানে? এই সব কথা শোনার পরে কেউ আর ওই ঘরে থাকে? আমি আর প্রিয়দা গেস্ট হাউসের রিসেপশনে গিয়ে সব ক’টা আলো জ্বালিয়ে দিয়ে সোফায় বসে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম। সকাল হতেই মালপত্র নিয়ে চেক আউট।’
সুব্রতদা দাবি করতেন বিদেশের হোটেলের ঘরেও তিনি সাহেব ভূত, মেম ভূত দেখেছেন। ভয় পেয়েছেন তবে লখনৌয়ের অভিজ্ঞতার মতো হাড় হিম করা নয়।
এটা সত্যি ঘটনা না বিশুদ্ধ ঢপবাজি সেটা বোঝার জন্য অনেক পরে আমি প্রিয়বাবুকে টোকা দিয়েছিলাম। হাসতে হাসতে প্রিয়দা জবাব দিয়েছিল, ‘আরে ওগুলো সব সোমেনের পাঠানো ভূত। আমি তো তাদের দেখিনি, তবে সুব্রতর যে শ্বাসরোধকারী গোঙানিটা শুনেছিলাম, সেটা আমার রেকর্ড করে রাখা উচিত ছিল। পুজোর সময় একডালিয়ার মাইকে বাজিয়ে দিতাম।’ (চলবে)