সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমি তখন দিল্লিতে কংগ্রেস কভার করি, রোজ বিকেলে নিয়ম করে ২৪ নম্বর আকবর রোডে দলের সদর কার্যালয়ে ঢুঁ মারতে হয়। দলীয় অফিস হলেও আসলে সেটি ছিল সাংসদের বাংলো। আশির দশকের মাঝামাঝি অনেক রাজনৈতিক দলই তাদের কোটায় পাওয়া এমপি বাংলো দলের অফিস হিসেবে ব্যবহার করত। যেমন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির অফিস ছিল অশোক রোডে এক দলীয় এমপি-র বাংলোয়। তারপর গত সাড়ে তিন দশকে প্রায় সব ক’টি দল নিজেদের অফিস তৈরি করে নিয়েছে, সবচেয়ে ঝাঁ চকচকে অফিসটি বানিয়েছে বিজেপি। কংগ্রেস এখনও তার পুরোনো ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছে। সম্ভবত এই কারণে যে ওই বাড়ির ঠিক পিছনেই ১০ নম্বর জনপথ, সনিয়া গান্ধীর বাসস্থান। হতে পারে সভানেত্রীর সুবিধের কথা ভেবেই গান্ধী পরিবারের ভক্তবৃন্দ দলীয় অফিস আকবর রোডেই রেখে দিয়েছেন।
কার্যালয়ের এক একটি ঘরে এক একজন সাধারণ সম্পাদক আর দলীয় কোষাধ্যক্ষ বসতেন। কংগ্রেস সভাপতির জন্যও একটি ঘর বরাদ্দ ছিল, সেটি তালাবন্ধই থাকত বেশিরভাগ সময়ে। কোষাধ্যক্ষ সীতারাম কেশরী নিজের পোষ্যটিকে কোলে করে ঘরের গদিতে বসে থাকতেন। উল্টোদিকের ঘরে বসতেন রাজীব গান্ধীর বিশেষ আস্থাভাজন তামিলনাড়ুর নেতা জি কে মুপানর, অতি সজ্জন মানুষ, সর্বদা হাসিমুখ, চেইন স্মোকার। পেটে কামান দাগলেও মুপানরের মুখ থেকে কোনও খবর বের করা যেত না, আমরা তাঁর ঘরে কিছুটা সময় কাটাতাম ফাইভ ফিফটি ফাইভ প্রসাদ পাওয়ার লোভে। মুপানর খবরের প্রশ্নে যতটা কৃপণ, সিগারেট বিলিতে তার চেয়েও বেশি উদার ছিলেন।
আমরা যাঁরা বাংলার রিপোর্টার তাঁদের কাছে মুপানর কিংবা কেশরীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন রাজেন্দ্র কুমারী বাজপেয়ী। উত্তরপ্রদেশের এই সম্ভ্রান্ত নেত্রী ছিলেন নরম-সরম স্বভাবের, তাঁকে দেখে আমার অন্তত মায়ের মতোই মনে হতো। দেহাতি স্টাইলে শাড়ি পরতেন, এক মাথা ঘন সাদা তুল শক্ত করে বাঁধা, সিঁথিতে পুরু সিঁদুর লম্বা করে টানা। আমার ধান্দা একমুখী, খবর চাই। প্রশ্নের সোজা জবাব দিতে তিনি ঢাক ঢাক গুড় গুড় করতেন না, বিশুদ্ধ সংস্কৃতগন্ধী হিন্দুস্থানীতে যা জিজ্ঞেস করতাম তারই জবাব দিতেন। অনেক রাতে বাড়িতে ফোন করলেও বিরক্ত হতেন না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস নিয়ে কারও যে আদৌ মাথা ব্যথা থাকতে পারে, এ কথা ভেবেই তিনি যারপরনাই বিস্মিত হতেন বোধহয়। কেন না সর্বভারতীয় কংগ্রেসের মানচিত্রে তখন চোখে দূরবীন লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে খুঁজতে হতো।
চিরশত্রু সিপিএমের সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মাখামাখি নিয়ে তখন রোজ বাজপেয়ীজির কাছে অভিযোগ আসত, কলকাতা থেকে ফোনে নতুবা দিল্লিতে এসে সরাসরি। কাঁকড়ার দল কংগ্রেস, পরস্পরকে কাঠি করতে এ দলের নেতারা স্বর্গসুখ পেতেন। সুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে এমন সংগঠিত অভিযোগের পিছনে দলে তাঁর বিরুদ্ধ শিবিরের সুচারু পরিকল্পনা ছিল তো বটেই। বাজপেয়ীজির ঘরে আমাদের সামনেই এক বঙ্গজ কংগ্রেসিকে বলতে শুনেছিলাম, ‘ম্যাডাম, ইয়ে সুব্রত মুখার্জি এক পাক্কা তরমুজ হ্যায়। ও কিসিকা বাত নেহি মানতা। উনকো তুরন্ত দল সে বহিষ্কার করনা চাহিয়ে।’ এমন বিশুদ্ধ হিন্দি বাজপেয়ীজি বড় একটা শোনেননি, হাসতে হাসতে উনি জানতে চাইলেন, ‘আরে ভাই, ইয়ে তরমুজকা মতলব কেয়া হ্যায়? হর রোজ বাঙ্গাল কে নেতালোগ মেরে পাস আকে তরমুজ তরমুজ করতা হ্যায়। ইয়ে হ্যায় কেয়া চিজ?’
এ বার কাপড়ে-চোপড়ে অবস্থা সেই অভিযোগকারী বাঙালি ভদ্রলোকের। কয়েক সেকেন্ড তিনি মাথা চুলকোলেন, এদিকে সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন, তারপর আমারই কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে কাতর কন্ঠে অনুরোধ করলেন, ‘একটু বলে দাও না বস, তরমুজকে হিন্দিতে কী বলে! ইশ কেন যে আমি না জেনে এখানে আসতে গেলাম!’
দিল্লিতে যে-ই তাঁর কাছে আসে সে-ই কেন একজন রক্তমাংসের মানুষকে তরমুজ বলে পরিচয় দেয় তার রহস্যভেদ করতে বাজপেয়ীজির কিছুটা সময় লেগেছিল। অভিযোগে-অভিযোগে অতিষ্ঠ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তাঁর মতো করে অনুসন্ধান চালিয়ে একদিন এআইসিসি অফিসে নিজের ঘরে বসে বলে ফেললেন, ‘লাগতা হ্যায় তুমহারা তরমুজকো আভি কংগ্রেসসে নিকালনাহি পড়েগা। লেকিন উসসে পহলে ম্যায় উনকো এক আল্টিমেটাম দুঙ্গি।’
ঘটনাচক্রে বাজপেয়ীজির ঘরে সে সময় অন্য কোনও বাংলা কাগজের রিপোর্টার ছিল না। ফলে পরের দিন আনন্দবাজারেই একমাত্র খবরটি বড় করে প্রকাশিত হল আমার বাই-লাইন দিয়ে। আমার ক্ষুর খাওয়ার সম্ভাবনার সূত্রপাত সেখান থেকেই।
দলীয় অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায় সে সময় সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটার পর একটা আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন। কারও সাধ্য ছিল না তাঁকে নিবৃত্ত করে। এ ভাবে চলতে চলতে একবার কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা শিল্প ধর্মঘটে সুব্রতবাবু নিজেকে সামিল করার ঘোষণা করেন কলকাতায় সিটু অফিসে বসে, সাংবাদিক বৈঠকে। এতদিন পর্যন্ত কংগ্রেস হাইকমান্ড সুব্রতবাবুর শৃঙ্খলাভঙ্গকে তেমন একটা গুরুত্বই দেয়নি। কিন্তু সিটু অফিস থেকে তাঁর এই ঘোষণার পরে দিল্লির টনক নড়ে।
সে যাত্রায় সুব্রতবাবুকে সাবধান করে দিয়েই কংগ্রেস হাইকমান্ড এই বিতর্কে ইতি টেনেছিল। তাঁকে বহিষ্কার করা হয়নি। সিটুর সঙ্গে যতই দহরম মহরম করুন পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসে সুব্রত মুখোপাধ্যায় নামের স্বতন্ত্র ওজন ছিল, কংগ্রেস ভাঙার সময় তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ছিলেন, ফলে দিল্লিতে তিনিও নির্বান্ধব ছিলেন না। সবচেয়ে বড় কথা কংগ্রেস নামক হট্টমন্দিরে শৃঙ্খলা, অনুশাসন জাতীয় গালভারী শব্দের তেমন প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। একমাত্র গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করলে বা তাঁদের নামে গালমন্দ করলে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার একটা সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু সুব্রত মুখোপাধ্যায় তো সত্যিই তেমন গর্হিত কিছু করেননি।
আমে-দুধে এক হয়ে গেল, মাঝখান থেকে কেস খেয়ে গেলাম আমি। (চলবে)