শ্রীচরণেষু মা,
সুমন চট্টোপাধ্যায়
মায়ের কাছে মাসির গপ্পো বলেই শুরু করা যাক।
সিপাহি বিদ্রোহের ১০০ বছর আর দ্বি-খণ্ডিত স্বাধীনতার ঠিক এক দশক পরে আমার জন্ম।
তুমি দেখে যেতে পারোনি, এখন ইন্টারনেট নামের একটি বিষম বস্তু দুনিয়া জয় করে ফেলেছে। বেশ কাজের জিনিস, মুশকিল আসান। কৌতূহলবশত সেখানে পায়চারি করতে গিয়ে দেখি, একটি সাইটে দাবি করা হয়েছে, ১৯৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর এই ধরাধামে নাকি ৩২ হাজার ৫০০ নবজাতক ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। আমি তাদেরই একজন।
জানো তো মা, ৬৪ বছর পরে একই পৃথিবীতে প্রাত্যহিক নবজাতকের সংখ্যা চার লাখের উপরে। মানে আমার সময়ের চেয়ে আট গুণ বেশি। এত ক্ষুধা, এত দারিদ্র্য, এত অপুষ্টি, চারিদিকে এত হানাহানি, অতিমারী, তারই মধ্যে এমন কিলো কিলো বাচ্চা পয়দা করার কী দরকার আমি বুঝতে পারি না। অবশ্য যে দেশের মাটিতে তুমি আমায় জন্ম দিয়েছিলে, সেই দেশটাই আর নেই। এক দেশে জন্মে আমি এখন আর এক দেশের নাগরিক। পুরোনো দুনিয়াটাকেও আর চিনতে পারা যায় না। সর্বত্র ডামাডোল।
মা, তোমাকে আরও একটা খবর দিই। আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনে দুনিয়ায় আরও দু’টি গুরুত্বপূর্ণ জন্ম-মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। জন্মেছিলেন তৃতীয় মার্টিন লুথার কিং, মারা গিয়েছিলেন ফ্যাশন দুনিয়ার দিকপাল, নাম ক্রিশ্চিয়ান ডিওর। এর বাইরে সে বছর ওই তারিখে উল্লেখ করার মতো আর কিছু ঘটে থাকলে আমার সে কথা জানা নেই।
তোমার মুখেই শুনেছি, আমার জন্মের আগে তুমি ঠাকুর্দার লিলুয়ার বাড়িতে বসে প্রহর গুনছিলে। অনতিদূরে, জি টি রোডের উপর জয়সওয়াল হাসপাতাল স্থির হয়েছিল আমার জন্মস্থান হিসেবে। পরে অনেকবার ওই হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছি, একটিবারও ভিতরে ঢোকার কৌতূহল বোধ করিনি, বাইরে থেকে দেখেই পিণ্ডি চটকে গিয়েছে। এত নোংরা, এত পূতিগন্ধময়। এমন একটি হাসপাতালের মেটারনিটি ওয়ার্ডে ভূমিষ্ঠ হয়েও যে বেঁচে গিয়েছি, এটাই তো যথেষ্ট!
জন্ম দিলে অথচ জন্মক্ষণটি ঠিক করে বলে গেলে না, তার মাশুল আমাকে গুনতে হয়েছে বারবার। তুমি কেবল এটুকু বলেছিলে, আমার জন্মের আগের রাতে ছিল কালীপুজো। পরের দিন সকালে অমাবস্যা কাটার পরে প্রতিপদের প্রথম প্রহরে আমার জন্ম। তুমি জানো আমি স্বভাব-কৌতূহলী। অনেক অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছি, সে বছর ২২ অক্টোবর অমাবস্যা শুরু হয়েছিল রাত ১টা ২১ মিনিটে, শেষ হয়েছিল পরের দিন সকাল ১০টা বেজে ১৩ মিনিটে। এই জন্মক্ষণটি স্মরণীয় করে রাখতে, দাদু, মানে তোমার বাবা আমার নাম রাখতে চেয়েছিলেন তিমিরেন্দু। তিমির অবগুন্ঠন কাটিয়ে চাঁদের উদয়। কিন্তু বাবা ‘ভিটো’ দেওয়ায় সেই নাম তৎক্ষণাৎ খারিজ হয়েছিল। চ্যাটুজ্জে গুষ্টিতে কারও বুকের পাটা ছিল না সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের কথা অমান্য করে। আচ্ছা মা, বাবার নামটাও তো সুনীল না হয়ে ইদি আমিন হতে পারত!
দাদুর মনে দুঃখ দিয়ে বাবা আমার যে নামটি শিরোধার্য করলেন, তার জন্য আমাকে কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি। ‘সুমন’ এমন একটি নাম, লিলুয়া পেরোলই যার লিঙ্গভেদ ঘটে যায়। আশির দশকের শেষার্ধ্বে দিল্লিতে থাকাকালীন প্রায়শই আমাকে পাঠানো চিঠিপত্রের খামের ওপর লেখা থাকত, ‘মিস সুমন’। কোন দৈববশে পুরুষের নাম ‘সুমন’ হতে পারে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও আমাকে জেরবার হতে হয়েছে অসংখ্যবার। নব্বইয়ের দশকে কলকাতায় ফেরার পরে নাম-মাহাত্ম্যের কারণে শুরু হয় আর এক আপদ। আমাকে গায়ক সুমন ঠাওরে অনুরাগিনীরা দলে দলে আমার নম্বরে ফোন করতে শুরু করলেন। এত মেয়ের এত রকম কণ্ঠস্বর একটিও আমার জন্য নয় ভেবে কষ্ট আর ঈর্ষা দুটোই হতো সমপরিমাণে। প্রথম প্রথম সবিনয়ে চেষ্টা করতাম সুন্দরীদের ভ্রান্তি-বিলাস কাটাতে, ভবী কিছুতেই ভোলার নয় বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিই। এই মুহূর্তগুলিতে ব্যাপক রাগ হতো বাবার উপর। বঙ্গীয় শব্দকোষ ঘেঁটে তিনি কি আর কোনও নাম পেলেন না?
অথচ অন্ধকার ভেদ করে আমার ভূমিষ্ঠ হওয়াটা মিথ্যা নয়। বাবার মুখে জন্মক্ষণের যে হিসেব শুনেছি, সেটা সত্য হলে অমাবস্যা কাটার আগেই আমার জন্ম হওয়ার কথা। বাবা বলেছিলেন, ‘ওইদিন সকাল ১০টা নাগাদ আমি হাসপাতালে পৌঁছে শুনি তোর জন্ম হয়ে গিয়েছে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঠিক মুহূর্ত নিয়ে আমার কোনও কৌতূহল ছিল না, আজও নেই।’
ফল হয়েছে এই রকম। এক এক জ্যোতিষী এক এক রকম ছক বানিয়ে মাল কামিয়ে গিয়েছেন, আমার ধন্দ আর জটিলতা কমার বদলে বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। স্বজন-বন্ধুদের উৎসাহে আমার অনেকগুলো কোষ্ঠীও তৈরি হয়েছিল, একটার সিকি শতাংশও মেলেনি। বরং কোষ্ঠী যা বলেছে হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। পঞ্জিকা মতে আমার জন্মের সকালে অমাবস্যা কেটে গেলও সূর্যদেব কয়েক ঘন্টা পরেই ফের অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। গুগল করে জেনেছি সেদিন ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। সেই গ্রহণে আমার জন্মক্ষণটি চিরতরে ঢাকা পড়ে গিয়েছে, এ কথা বলে মনকে প্রবোধ দিয়েছি বারবার।
মা, দুঃসময়ের দিনলিপি লিখতে আজ জন্মদিনে ভালো লাগছে না, তোমারও শুনতে ভাল লাগবে না। অতএব সেই নাম-মাহাত্ম্যেই ফেরা যাক। আমার ছেলেবেলায় ‘সুমন’ নামটি ততটা জনপ্রিয় ছিল না। আর এখন তো বাজারে বর্ষার ইলিশের মতো কিলো কিলো সুমন। এ সবের কোনও কিছুই তুমি দেখে যেতে পারনি, মাঝ সমুদ্রে আমাকে একা ফেলে দিয়ে চুপিসাড়ে চলে গেলে সেই কবে। বলতে গেলে তখন থেকেই আমি হাবুডুবু খাচ্ছি, খাচ্ছি তো খাচ্ছিই। কী আশ্চর্যের কথা জন্মের পরেও বিবিধ অসুখের কারণে যার বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত ছিল, সে-ও চৌষট্টিটি বসন্ত দেখে ফেলল গড়িয়ে গড়িয়ে।
তোমার অশ্রু-সজল আশীর্বাদ ছাড়া কি এই অসম্ভব সম্ভব হতো?
এই আশীর্বাদটুকু জারি রেখো, বাকি সব আমি বুঝে নেব। আমার জীবন তো এখনও শুরুই হলো না মা।
প্রণাম নিও।