একমাত্র জন্নত, একমাত্র আলোকবর্তিকা
কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি, অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে।’তাঁর কথামতো আমরাও হয়তো যে যার মতো করে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করেছি। অধিকার করেছি। আমাদের অনুরাগের স্পষ্ট অনুপাতে তাঁকে গ্রহণ করেছি। বিবিধ ভাবে। স্বতন্ত্র ভাবে। ভিন্নভিন্ন অক্ষরেখায়। যার সান্নিধ্যে ভালো থাকবার নির্ণয় আছে।
আকাশ একটাই। শুধু মেঘেদের অনন্ত অমেয়স্বচ্ছ জলকণারা তার সীমাহীন নীলে প্রসারিত। যে যার মতো করে আঁজলা ভরে নাও। এভাবেও বলা যায়, আমাদের অর্ধেকেরও বেশি ঋতুজীবনের শরীর তাঁর তাপের আঁচে সিক্ত। না চাইলেও তিনি জড়িয়ে থাকেন। হয়তো কারও কারও জীবনের কিছু বিভ্রান্ত জড়িত দিশা পথ খুঁজে পায় তাঁর আশ্রয়ে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তাঁকে নিজের মতো করে আমরা অমোঘ করেছি। আপন করেছি। সময়ে অসময়ে দুঃসময়ে তাঁর সঙ্গেএকাত্ম বোধ করেছি। আচ্ছন্ন বোধ করেছি। একেবারে নিজের নিয়মে কখনও বা ঘোর বেনিয়মে।
সেই সহজপাঠের দিনগুলো থেকে কত তারাপথ অতিক্রম করে চলেছি তবুও তাঁর কাছ থেকে আমাদের নেবার অন্ত নেই। এ ভাবেই ঋণ বহন করে চলেছি আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে। কখনও সুখে কখনও স্বস্তিতে কখনও বা প্রান্তজোড়া বিষণ্ণতায় তাঁর হাতটি ধরে ডুব দিয়েছি। ‘যেতে যেতে একলা পথে’অবগাহন করেছি তাঁর গভীরতায়। যে গভীরতার তল পাওয়া যায় না। জীবনের রুক্ষ মরুপথে তাঁর আশ্রয় আমাদের নির্ভার করেছে। নির্ভয় করেছে। অশঙ্ক করেছে। শোকশূন্য করেছে। অঙ্ক কষলে হিসেব মিলবে না।
তিনি যতই বলুন ‘আমায় নাইবা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে’, প্রেমেঅপ্রেমে বিরহ বেদনায় সুখে দুঃখে অথবা কিছু ভাঙা স্বপ্নের গায়ে দু’এক পশলা বৃষ্টির মতো যেন তিনি আছেন। থাকেন। রয়ে যান। প্রয়োজন হয়ে। অকপট মেঘমুক্ত আকাশের মতো বিস্তীর্ণ আয়ত প্রসারিত হয়ে। এখনও, এত বছর পরও। আমাদের ছন্নছাড়া শতচ্ছিন্ন জীবনের সূর্যোদয়ে সূর্যাস্তে তাঁকে ডাকতেই হয়। মনে রাখতেই হয়। তিনি আসেন চেতনে অবচেতনে, একা এবং অনেক হয়ে। তাই তিনি নেই এই কথা ভাবনায় আসে না কখনও। আসতে নেই।
যখন প্রথম বোধ এসেছে জীবনে তখন থেকেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। দিদিরা একেবারে বালিকা বয়স থেকে শান্তিকেতনের ছাত্রী বলে আরও বেশি রবীন্দ্রনাথকে নিজের বলে মনে হয়েছে। আমাদের ছোট শহরের সেই বাড়িতে দিদিদের সূত্রে তিনিও ছিলেন আমাদের গুরুদেব। রবীন্দ্রনাথের চাইতেও তাই গুরুদেব আমাদের বেশি কাছের ছিলেন। যেন ভ্রূণের ভিতর সঞ্চিত এক অথই ঠাঁই। নিরুদ্ধ। স্থরিত। একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড প্লেয়ার ছিল আমাদের, তাতে সকাল সন্ধে রবিঠাকুরের গান বাজাতেন মা। গীতিনাটকের গানগুলো এইভাবেই শুনে শুনে এখনও মুখস্থ হয়ে আছে। তারপর বালিকা বয়স থেকে ইস্কুলের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত রবীন্দ্রগান আর গীতিনাটকে নিয়মিত নাচে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে তাঁকে নিয়ে পথ চলা শুরু। তাঁকে ছাড়া‘কী আছে শেষে পথের’ জানি না।
ভাবলে বিস্ময় লাগে চলে যাবার এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ এখনও কারও কাছে রঙে রসে যেমন ভাসেন, আনন্দে আয়াসে যেমন আসেন, কারও কাছে আবার একাকিত্বের অন্ধকারে নিভৃতে আসেন। কারও কাছে সাহস উদ্দামতা হয়ে আসেন। কারও কাছে অদম্য অভয় হয়ে আসেন। কারও কাছে শান্তির বারি নিয়ে আসেন। আসেন কেন? আমরা আনি তাই। বুকের ভিতর কোণে আমরাই তাঁকে রেখে দিই যত্নে তাই। বারবার পথ হারাতে চাই না তাই। অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরতে চাই তাই।
সব মিলিয়ে তিনি যেন একটা গোটা পৃথিবী। এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আকাশ বাতাস অরণ্য নদী পাহাড় সব তাঁর। আমরা যে যেমন ভাবে পারি স্নান করি তাঁর অসীমে। তেমন ভাবে ভেবে দেখলে আকাশের নীলে, বাতাসের ঘ্রাণে, অরণ্যের আরণ্যকতার বন্য শব্দে তিনি নামিয়ে আনেন অসময়ের শ্রাবণ। কী সহজে, যখন খুশি, যেমন খুশি। এই শ্রাবণের অন্য রূপ, অন্য নেশা। হয়তো এই ভাবেই তাঁর অবাধ সৃষ্টির মেঘবতীজলে আমরা ভিজতে থাকি আনখশির, জীবনভর। নদীর পাড় জুড়ে তাঁর গান যেমন স্তব্ধতা ভাঙে, তাঁর অক্ষরস্রোত তেমনই আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ ভাবে এবং এ ভাবেই অন্তরঙ্গ, প্রগাঢ় ছায়ারেখায় রবীন্দ্রনাথে বানভাসি হয় ইহজীবন। মনের ভিতর ইরাবতী আনতে পারেন তিনিই।
তিনি যদি না জন্মাতেন কী হতো জানি না। জানতেও চাই না। জীবনে খড়কুটোর মতো জড়িয়ে তাঁকেনিয়ে বাঁচে বাঙালি। সুখে শোকে আমাদের আগলে রাখেন তিনি। এই আগল আছে বলেই আমাদের কিনারাহীন অস্থির জীবনস্রোতে, ঘটনা অঘটনার আগাছায় তিনি থাকেন পাশে এক চিলতে রোদ্দুর হয়ে। তাঁর থাকাটা তাই ভীষণ অত্যয়, জরুরি। অন্তত আমাদের প্রজন্মে এই সত্যটা অস্বীকার করাটা চরম গুনাহ। তাঁর না থাকাটা যেন অকল্পিত। দুর্ভাগা অভাগা বাঙালির একমাত্র নির্ভরতা তিনি। একমাত্র জন্নত। একমাত্র আলোকবর্তিকা। একমাত্র প্রত্যয়, ভরসা, আস্থা। প্রতিটা বিষাদরেখা পার করে আমাদের অণু পরমাণুতে রবীন্দ্রনাথই আমাদের একমাত্র অতলবাস।
‘যতোবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারেবারে…।’ সবার ক্ষেত্রে ঠিক না হলেও কারও কারও ক্ষেত্রে কথাটা ভীষণ ভাবে ঠিক। যতোই ইচ্ছের সঙ্গে চেষ্টা জুড়ে জোনাকি আলো যতোবার জ্বালাতে চাই, তবুও নিভে যায় বারবার। এমন ভাবে আর কে ভেবেছেন মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে? আমাদের মনের এমন কোনও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম চেতনা বা অনুভূতি নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি। কী করে বুঝেছিলেন মানুষের এতো বিচিত্র মানসিক সঞ্চারণ, কে জানে। মানুষের অথই মনের প্রতিটা অনুভব যেন তাঁর নিজের ছিল। শব্দের পর শব্দ লিখে গেছেন অন্তহীন এই সব অনুভূতি নিয়ে। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনা রাগ বিরহের বাইরে হাজারোবোধের মনের ভিতর আসা যাওয়া, দেওয়া নেওয়া সব তাঁর কাছে ছিল যেন জীবনের সহজপাঠ। গীতবিতান নিয়ে যে পাতাই খুলে বসি না কেন, মনে হয় এতো আমারই কথা। এর মধ্যেই তো আমার রোজকার বাস অথবা পরবাস। সকাল সন্ধে রাত্রি দিন। শুধু তাঁর মতো করে আমরা ভাবতে পারিনা। জানি না আমাদের পরে আমাদের পরের প্রজন্ম বা তার পরের প্রজন্ম তাঁকে এই ভাবে পাবে কি না। তাঁকে নিজের করে চাইবে কি না। চাইলেও অতি অল্প সংখ্যায়। তাঁর কাছ থেকে এই অন্তহীন নেবার শেষ কোথায় জানি না। যে বিশাল ছায়াপথ তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য সেই পথ দিয়ে বড় আরামে বড় নিশ্চিন্তে, বড় যত্নে আমরা পা ফেলছি প্রতিটি ক্ষণ…
পরাণ সখা বন্ধু হে আমার। তাঁকে ছাড়া চলব, এমন ‘ঈশ্বর’ আর কে আছেন আমাদের? যদিও রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বরের মতো ভাবাটাই মস্ত বড় ভুল আমাদের। এ বিষয়ে নবনীতাদি (দেব সেন) তাঁর প্রবন্ধে অনেক কথা বলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিরাকার শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। আমি আকার নিরাকার কোন ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করি না। শুধু এইটুকু মানি ‘ঈশ্বর’ শব্দটি মানুষের কাছে খুব দূরের কেউ। গ্রহ তারা নক্ষত্রের মতো নভস্থলের কেউ। যাঁরা এ বিষয়ে বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও একই ধারণা নিশ্চয়ই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো অত দূরের দেবতা, স্রষ্টা, অমত্র, অব্যয় নন। তাঁকে অত দূরের করে রাখার দরকারটা কী? কেনই বা করব? তিনি তো আমাদের মনের মানুষ। খুব কাছের মানুষ। রোজকার জীবনের বন্ধু, সখা, স্বজন। আমাদের ভিতরপ্রাণের মানুষ। আমাদের জীবনের সঙ্গে তাঁর খুব সখ্য। তাঁকে দেবতা বলে ভাববই বা কেন? রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর বা ঠাকুর হলে আমাদের মতো ঈশ্বর-অবিশ্বাসী মানুষদের কাছে তাঁর তো কোন অস্তিত্বই থাকে না। তিনি মানুষ, চিরসখা, আত্মার জন, পরম বন্ধু। তিনি আমার তোমার সবার শেষ আশ্রয় বা প্রশ্রয়। এইটেই পরম সত্য আর কিছু নয় …