বাংলাস্ফিয়ার—“গড সেভ দ্য কুইন”। গত সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীতে এভাবেই রাণীর মঙ্গল কামনা করা হত। আর হবেনা। একটি প্রায় মজ্জাগত হয়ে যাওয়া জাতীয় অভ্যাসে বদল আসবে রাতারাতি।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো এত দীর্ঘ সময় ধরে আর কেউ সিংহাসনে বসেননি। ব্রিটেনের প্রতি দশজন নাগরিকের মধ্যে আটজনেরই জন্ম হয়েছে রাণীর রাজত্বকালে, তাঁর আশীর্বাদ-ধন্য হয়ে পনেরোজন প্রধানমন্ত্রী দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে এসেছেন এবং চলে গিয়েছেন। এর সূচনা হয়েছিল উইনস্টন চার্চিলকে দিয়ে, শেষ নাম হিসেবে থেকে যাবেন সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লিজ স্ট্রাস।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছরে রাণী এলিজাবেথ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিলেন। কেপটাউনে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় তিনি বলেছিলেন,’ My whole life, whether it be long and short shall be devoted to your service.’ রাণীর আশ্বাসবানী তিনি সারা জীবন ধরে পালন করে গিয়েছেন, একথা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কট্টর বিরোধীরাও স্বীকার করেন।
বি বি সি-র রয়াল করেসপন্ডেন্ট জনি ডাইমন্ড লিখেছেন, ৭০ বছরে প্রয়াত এলিজাবেথ কাউকে একটিও সাক্ষাৎকার দেননি। অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্প করার সময় টুকরো ছবি রেকর্ড করতে দিয়েছেন এই পর্যন্ত।
রাণী শেষ নিঃশ্বাস ফেলা মাত্র ব্রিটেনের নতুন রাজা হলেন প্রিন্স চার্লস, এবার থেকে তাঁর পরিচয় হবে রাজা তৃতীয় চার্লস। রাজা হলেও তাঁর রাজ্যাভিষেক পর্বটি কবে হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এলিজাবেথ রাণী হওয়ার ঠিক এক বছর পরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে তাঁর অভিষেকানুষ্ঠান হয়েছিল। নতুন রাজা চার্লসকে কতদিন অপেক্ষা করতে হয় আপাতত সেটাই দেখার।
এই মুহূর্তে রাণীর রাজকীয় অন্ত্যেষ্টির প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক, পান থেকে চুনও যাতে না খসে তার জন্য সজাগ কয়েকশ মানুষ।এই পরিকল্পনার কেতাবী নাম হল অপারেশন লন্ডন ব্রিজ। এই লন্ডন ব্রিজ ইংরেজদের সাবেক রাজধানীর এক ঐতিহাসিক প্রতীক যার নাম প্রথাগতভাবে জড়িয়ে রয়েছে উইন্ডসরের রাজা-রাণীদের মৃত্যুর সঙ্গে। নিয়ম হোল রাণীর মৃত্যু হলে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে কেবল বলবেন, ‘লন্ডন ব্রিজ হ্যাজ ফলেন।’ আর কিচ্ছুটি নয়।সেই মুহূর্ত থেকেই অপারেশন লন্ডন ব্রিজ কার্যকর করার পূর্ব পরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।
রাণীর মৃত্যুদিনটিকে ধরা হবে পরিকল্পনার প্রথম দিন। মানে ডি ডে নাম্বার ওয়ান। এই সময় যদি বিবিসি-র পর্দায় চোখ বোলান, দেখবেন উপস্থাপকদের সকলের পরণে কালো পোশাক, শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম বজায় রাখার সচেতন প্রয়াস। বিবিসি যেহেতু ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ সংস্থা তাই সাংবাদিক হয়েও সেখানে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়। বিবিসির প্রবীণ সাংবাদিক জেরেমি প্যাক্সম্যানের একটি বই আছে যার নাম ‘ অন রয়ালটি’। সেখানে তিনি মজা করে লিখেছেন, সত্তর এবং আশির দশকে প্রতি ছয়মাস অন্তর একটি উইকএন্ডে অফিসে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। একটাই কারণে। রাণী এলিজাবেথের মৃত্যু হলে কী কী করতে হবে বা করা যাবেনা সেই বিধিগুলি ভাল করে খতিয়ে দেখতে। তবে এখন জমানা বদলেছে, পাল্লা দিয়ে নিয়মকানুনও। এবার যেমন রাণীর মৃত্যু সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয়েছে রাজপরিবারের অফিশিয়াল টুইটারে। হাওয়ায় খবরটি তার অনেক আগে থেকেই ভেসে বেড়াচ্ছিল, ফলে দেখা গেল বিবিসির উপস্থাপক ততক্ষণে কালো পোশাক পরে প্রস্তুত।
রাণীকে সমাধিস্থ করা হবে মৃত্যুর এগারো দিনের মাথায়। তার আগে আগামীকাল শনিবার সেন্ট জেমস প্রাসাদে বসবে ‘অ্যাকসেশন কাউন্সিলের মিটিং।’ নতুন রাজা চার্লসের নাম ঘোষণার জন্য। প্রিভি কাউন্সিলের উপদেশক্রমে ওই কাউন্সিলের সভাতেই আনুষ্ঠানিকভাবে আবার রাণীর মৃত্যুর কথা ঘোষিত হবে। এই কাউন্সিলের পৌরহিত্য করার কথা প্রিভি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট যিনি এই মুহূর্তে হাউজ অব কমন্সের নেতার পদেও আছেন।
এরপর নতুন রাজা প্রিভি কাউন্সিলের সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হবেন, সেটি শনিবার হতে পারে, হতে পারে পরেও। সেখানে নতুন রাজা চার্চ অব ইংল্যান্ডকে রক্ষা করার শপথ নেবেন। তারপর সেই শপথের স্বাক্ষরিত কপি চলে যাবে রেকর্ড কিপারের অফিসে। ১৭১৪ সালে রাজা প্রথম জর্জ থেকে শুরু হয় এই প্রক্রিয়া যা আজ এত শত বছর পরেও একই মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়। সবশেষে অবিরাম তোপধ্বনির মধ্যে চার্লসের রাজা হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হবে সেন্ট জেমস প্রাসাদের বারান্দা থেকে।সেখানেই প্রথম উচ্চারিত হবে ‘গড সেভ দ্য কিং।’
তার আগে আজ শুক্রবারই রাণীর দেহ লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে নিয়ে আসা হবে, হয় বিশেষ বিমানে নতুবা রাজবাড়ির নিজস্ব রেলগাড়িতে। মঙ্গলবার পর্যন্ত কফিন সেখানেই থাকার কথা, তারপর গন্তব্য রাজপ্রাসাদের ওয়েস্টমিনস্টার হল। সেখানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাণীকে রাখা হবে আম-জনতার দর্শনের জন্য। মা যখন শেষশয্যায় শায়িত প্রথা মেনে চার্লসকে তখন পরপর স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ার্ল্যান্ড ও ওয়েলসে ঝটিকা সফরে বের হতে হবে।
লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে মৃত্যুর পরে একাদশতম দিনে সম্ভবত ১৮ সেপ্টেম্বর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। কমনওয়েলথ দেশগুলি সহ দুনিয়ার অসংখ্য দেশের মাথারা সেখানে আসবেন রাণীকে তাঁদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সবশেষে রাণী যাবেন উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে। সেখানেই তিনি সমাধিস্থ হবেন। শেষ হবে ব্রিটেনের রাজবাড়ির এক সুদীর্ঘ অধ্যায়। তখনই আওয়াজ উঠবে ‘দ্য কুইন ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং।’
বাহ্ বিস্তারিত এবং সুন্দর লেখাটি থেকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের রাজা/ রাণী হওয়া, অভিষেক এবং অন্ত্যেষ্টির কথা জানলাম।
লেখককে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
লেখাটা পড়ে একই সঙ্গে মুগ্ধ হলাম এবং পুরো প্রক্রিয়াটা জানতে পারলাম। বাংলা সাংবাদিকতায় এখন এই রকম লেখার বড় অভাব।
সুন্দর লেখা। অনেক কিছুই জানলাম আপনার এই লেখা পড়ে। ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের অনেক নিয়ম কানুন সত্যি বলতে কি আমরা জানি না। ধন্যবাদ আপনাকে। আর একটা কথা, রানীর স্বামী কি বেঁচে আছেন ? এটাও জানি না।