ভাগ্যিস তুই আর নেই প্রশান্ত !
সুমন চট্টোপাধ্যায়
একজন বিস্মৃত রিপোর্টারের গপ্পো শোনাই আপনাদের। করোনা-ত্রস্ত বাজারে রিপোর্টারদের ঘরে বসে রিপোর্ট করার নয়া কানুন কানে আসার পর থেকে বড্ড বেশি করে আজ তার কথা মনে পড়ছে আমার।হতে পারে, আপনাদের কারও কারও তার নামটি আবছা মনেও থাকতে পারে। কেননা একটা সময় ছিল যখন তার নাম হামেশাই ছাপা হত আনন্দবাজারে।
প্রশান্ত কুন্ডু। বাঁকুড়ার কাছে কোনও একটা গ্রামে আদি-নিবাস, লেখাপড়াও তেমন কিছু পাতে দেওয়ার মতো নয়। সুন্দর পেটানো চেহারা, হাতে স্টিলের বালা, মুখে হাসি, তেজি ঘোড়ার মতো সর্বদা টগবগ করে ফুটছে। প্রশান্তর মতো এক গাঁয়ের ছেলে কবে কীভাবে মুম্বাই শহরে পৌঁছে গিয়েছিল বলতে পারবনা, সম্ভবত নিজস্ব আত্মপ্রত্যয়ের তাগিদে। কেউ গায়ক হতে, কেউ নায়ক হতে মুম্বাই যায় আমরা জানি। যারা যায় তাদের মধ্যে এক শতাংশের স্বপ্ন সাকার হয়, বাকিরা ভগ্ন-মনোরথ হয়ে ফিরে আসে। প্রশান্ত গিয়েছিল জীবিকার সন্ধানে, বলিউড নিয়ে বাংলা কাগজে লেখালেখি করবে, এটাই ছিল তার স্বপ্ন। সেই অভীষ্ট সিদ্ধ করতে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে ও কী লড়াইটা লড়েছিল, সেটা আমি স্বচক্ষে দেখেছি। দেখেছি বলেই ওর প্রতি আমার অনুরাগ যতটা গভীর শ্রদ্ধাবোধ তার চেয়েও বেশি।
মুম্বাই আনন্দবাজার অফিসে বিজ্ঞাপনের এক বড় কর্তা ( তিনি আবার শান্তিদেব-সাগরময় ঘোষের সহোদর ছিলেন ) প্রথম আলাপেই প্রশান্তকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলেন। তাঁর সুপারিশেই আনন্দলোকে টুকটাক লেখা আরম্ভ করে প্রশান্ত, তারপর ধীরে ধীরে আনন্দবাজারে প্রবেশ, তবে স্থায়ী কর্মচারি হিসাবে নয় স্ট্রিঙ্গার হিসেবে।
সালটা ঠিক মনে করতে পারছিনা, অফিসের কাজে মুম্বাইতে গিয়ে আমার আলাপ প্রশান্তর সঙ্গে। যে যে গুণ থাকলে একজন জাত রিপোর্টার হওয়া যায় আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তার সব কয়টাই মজুত ছেলেটির মধ্যে।অসংখ্য লোককে চেনে, চেনেনা যাদের বীরদর্পে তাদের ফোন ঘুরিয়ে চোস্ত মারাঠিতে কথা বলতে পারে, ভয়-ডর বলে কোনও বস্তু নেই, যে কোনও কাজের কথা বললে এক পায়ে খাড়া, কোনও কথায় না নেই। মুম্বাই প্রবাসী বাঙালিদের অনেককে চেনে, দুগ্গাপুজোর সময় কর্পোরেট জগতের বাঙালি কেষ্টবিষ্টুদের সখের নাটক পরিচালনা করে। মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যেবেলা ’দাদামনি’ ওকে আদর করে বাড়িতে ডেকে নেন, দু’পাত্র পানীয়র সঙ্গে বে-লাগাম আড্ডা দিতে। প্রশান্তর একমাত্র অনুযোগ ছিল অশোককুমার বড্ড কিপটে, ভিতরের ঘরে পানীয়ের বোতল থাকে, গ্লাস খালি হলে হোমিওপ্যাথিক ডোজে ফের তা ভিতর থেকে ভর্তি করে আনেন, বোতল কক্ষোণো অতিথির সামনে বের করেননা। আমি মুম্বাই গেলে ও একেবারে গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে আসত, সঙ্গে থাকত সারাক্ষণ। অনেক রাতে এমন হয়েছে দেরির কারণে ও আর বাড়ি ফিরতে পারেনি, হোটেলে আমার বিছানায় দু’ভাই একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। আমি রামচন্দ্র হলে প্রশান্ত আমার বিশ্বস্ত হনুমান, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব কাজে আমার ছায়াসঙ্গী। বেশ মনে আছে মুম্বাই বিস্ফোরণের রাতে আমাকে নিয়ে ও সোজা দাউদ ইব্রাহিম আর ইয়াকুব মেননের মহল্লায় নিয়ে গিয়েছিল। তখন ঈদের সময়, শেষ রাতে আর একটা বড় মুসলিম জমায়েতে গিয়ে আমরা দু’জন পাত পেড়ে হালিম আর ফিরনি খেতে বসে গেলাম। মুখে মদের গন্ধ ভক ভক করছে, বিপন্ন মুসলিমদের চোখে-মুখে আতঙ্ক, প্রশান্তর কুছ পরোয়া নেহি ভাব এমনই অদম্য। রিপোর্টের সন্ধানে বেরিয়েছি যখন তখন ঢুকে পড়তে হবে ঘটনাস্থলের পেটের ভিতর, তাতে পরিণতি যা হওয়ার হোক। শহরের নানা প্রান্তে বিধ্বংসী বিস্ফোরণের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মুম্বাই ফিরে গিয়েছিল তার স্বাভাবিক জীবন-ছন্দে। আমার রিপোর্টের শুরুতেই লিখেছিলাম ‘সালাম মুম্বাই’।
প্রশান্ত খবর আনতে পারত কিন্তু লিখতে পারতনা। কিন্তু খবর যা আনত তাতে এক ফোঁটা ভেজাল নেই, পুরোটাই আঁখো দেখা হাল। হর্ষদ মেহতার শেয়ার কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার দিন খবর পাওয়া মাত্র প্রশান্ত পৌঁছে গিয়েছিল ওর বাড়িতে। বাড়ির সামনের দরজায় তালা-বন্ধ দেখে পিছনের পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল সেপাই-সান্ত্রীর তোয়াক্কা না করে। কেলেঙ্কারির খল-নায়কের প্রথম সাক্ষাৎকারটা পেয়েছিল বাঁকড়োর অজ পাড়াগাঁয়ের ওই ছেলেটাই।
আনন্দবাজারের বার্তা বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে আমি দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরি ১৯৯৩-এর শেষ দিকে। পরের বছর আগস্ট মাসে খবর এল গুজরাতের সুরাটে নাকি প্লেগ ধরা পড়েছে, আতঙ্কে কাঁপছে গোটা শহর। এত বড় একটা ঘটনা অথচ গুজরাতে তো আমাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। অগত্যা মুম্বাইতে ফোনে ধরলাম প্রশান্তকে।
সুরাটে নাকি প্লেগ শুরু হয়েছে। পারবি যেতে?
কেন পারবনা? আপনি বলুন কখন যাব।
কত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবি?
এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি, প্রথম যে ট্রেনটা পাব উঠে পড়ব।
রিজার্ভেশন?
দূর, তেমন হলে আন-রিজার্ভড কামরায় দাঁড়িয়ে চলে যাব।
টাকা-পয়সা?
সে আপনি ভাববেননা। পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে, তেমন হলে পরিচিত দু’চারজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে নেব।
প্লেগ কিন্তু সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তোর মেডিক্লেম আছে?
এবার হাসতে থাকে প্রশান্ত।” দাদা, ফুরণের চাকরি করি। অফিসের চেক দেরিতে হলে অনেক মাসে বাড়িওয়ালাকে সময়ে ভাড়া দিতে পারিনা, গঞ্জনা শুনতে হয়। আমার থাকবে মেডিক্লেম?
তুই মরে গেলে তোর বৌ-বাচ্চাকে দেখবে কে?
কেন আপনি? মাথার ওপরে ভগবান আছেন, পাশে আছেন আপনি, আমার কোনও চিন্তাই নেই।
এক বস্ত্রে সুরাট পৌঁছে টানা দু’ সপ্তাহ প্রশান্ত ছিল সেখানে। রোজ টো টো করে ঘুরে বেরোনোর পরে টেলিফোনে আমাকে ধারা-বিবরণী দিত, আমি নিজে সেটা গুছিয়ে লিখে দিতাম। বরাত জোরে সেই প্লেগে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু তীব্র আতঙ্কে প্রায় দু’লাখ লোক শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আতঙ্কের সেই মর্মন্তুদ কাহিনীগুলি আনন্দবাজারের কভারেজকে এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। রোজ সকালে পাঠক তা গিলত গপ-গপ করে। প্রশান্ত মুম্বাই ফেরার পরে সুরাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা দীর্ঘ রিপোর্টাজ লিখেছিল আমারই নির্দেশে। রবিবাসরীয়তে কভার-স্টোরি হয়ে সেটা ছাপা হয়েছিল। পড়তে পড়তে আমার মনে ভেসে উঠেছিল ওয়াজেদ আলি শাহের লখনউ ছাড়ার কাহিনী। প্রশান্তর লেখাটির শিরোণাম দিয়েছিলাম, ‘যব ছোড় চলে সুরাত নগরী।’
তারপর দেখতে দেখতে সব কিছুই কেমন বদলে গেল, না রইল সেই অযোধ্যা, না রইলেন রামচন্দ্র। তখন খবরের কাগজের খবর সংগ্রাহকদের বলত রিপোর্টার। সেই পরিচিতিটা ছিল বড় গর্বের, বড় আনন্দের। এখনও অভ্যাসবশত তাদের ভুল করে রিপোর্টার বলা হয়, যদিও আসলে তারা স্টেনোগ্রাফার। এখন তারা বাড়িতে বসে রিপোর্ট লেখার হুকুম পাচ্ছে, অচিরে শুনব রিপোর্ট করারই আর প্রয়োজন নেই। টেলিভিশন আছে, ইন্টারনেট আছে, দ্যাখ-শোনো আর টুকলি করে পাঠিয়ে দাও!
প্রশান্ত আর নেই আমাদের মধ্যে। বড় করুণ ব্যক্তি-জীবনের পরিণতিতে ও চলে গিয়েছে অকালে! ওর কথা ভাবলেই আমার গলায় একটা দলা পাকিয়ে ওঠে! আজ করোনা-ত্রাসে থরহরিকম্প সাংবাদিকদের কথা শুনে বড্ড বেশি করে যেন মনে পড়ছে প্রশান্ত কুন্ডুর কথা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।
(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)