সুমন চট্টোপাধ্যায়
এই ফেসবুকে দেখি — সেলফি, খাওয়াদাওয়া আর ভ্রমণের ছবির সঙ্গে সম্ভবত একটি বস্তুই সসম্মানে প্রতিযোগিতায় নেমে থাকে, কবিতা। শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। কত কবি, কত রকম তাঁদের কাব্য, সে সব নিয়ে আবার কত না মন্তব্য অথবা আলোচনা।
কবিদের ঠেস দেওয়ার জন্য আমি লিখতে বসিনি। ঘাড়ে আমার একটিই মুন্ডু যে! আমার গিন্নি নিয়মিত কবিতা লেখে। অনেক বেশি বয়সে শুরু করেও অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেখতে পাই। ছাপবে বলে লোকে ওর কবিতা চেয়ে নেয়। কাব্য-পাঠের বিবিধ আসরে তার ডাক পড়ে। এ বার পুজোয় ওর বোধহয় ডজন খানেক কবিতা ছাপা হয়েছে ছোট-বড়-মাঝারি পত্রিকায়।
এতে আমার পদমর্যাদা বেড়েছে এম এ-র পাশে এলএলবি-র মতো। আগে লোকে কাগজওয়ালা বলে জানত। এখন কবি-পতি হিসেবেও চিনতে শুরু করেছে। সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য, মন্দ কী? সত্যি কথা বলতে কী, আমি কদাচিৎ কবিতা পড়ি। এমনকী গিন্নির কবিতাও উপরুদ্ধ না হলে বিশেষ একটা পড়ি না। মাইরি বলছি। চোদ্দ পুরুষের দিব্যি দিয়ে বলছি, স্রেফ বুঝতে পারি না বলে। একটা কিছু পড়লাম, নিজেরই মাতৃভাষায়, অথচ বোঝাটা মগজ থেকে হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছল না, এ এক অস্বস্তিকর অনুভূতি। অকপটে বলি, কস্তুরী চট্টোপাধ্যায় নামের যে রমণীর কথা বলছি, তিনি আদৌ পাতে দেওয়ার মতো কবি কি না তা নিয়ে আমারই গোড়ার দিকে সংশয় ছিল। নিজের তো মূল্যায়নের ক্ষমতা নেই, তাই মুখ বুজে থাকতাম। পরপর দু’জনের শংসাপত্র আমার সংশয়ের ভার একেবারে লাঘব করে দিয়েছে। প্রথমজন আমার প্রয়াত পিতৃদেব, দ্বিতীয়জন নবনীতা দেব সেন। দু’জনেই কস্তুরীকে বলেছেন, সে পুরোদস্তুর কবি। কোনও কোনও বিষয়ে বাবার কথা আমার ডেলফাইয়ের ওরাকল বলে মনে হত। পুত্রবধূ বলে বাবা তাকে রেয়াত করবে না জানতাম। আর জানতাম, বাবা যখন সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন, তখন আর বাড়তি একটি কথাও নয়!
বাবাও লেখক ছিলেন। প্রধানত ফিচার লেখক। আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে বহু বছর ধরে নিয়মিত লিখেছেন। কত কম কথায় কত বড় কথা বলে ফেলা যায়, বাবার ফিচারগুলি যেন তার বিজ্ঞাপন। সঙ্গে হীরকের দ্যুতি তাঁর নির্মেদ গদ্যে। বাবা গপ্পোটপ্পোও কয়েকটা লিখেছেন বলে জানি। কিন্তু কবিতা? মনে হয় একটিও নয়। আমি অন্তত বাবার কোনও প্রকাশিত কবিতার কথা স্মরণে আনতে পারি না।
অথচ সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম প্রেম। কবিদের প্রতি দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। যে ছেলে বা মেয়ে কবিতা লিখতে পারে, বাবার কাছে তার সাত খুনও মাফ। অকালে ঝরে যাওয়া পৌলমী সেনগুপ্ত চমৎকার কবিতা লিখত। ও আমাদের বাড়িতে এলে বাবা তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাব্যচর্চা করতেন। আলোচনা হত টেলিফোনেও। সারাটা জীবন বাবা অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর শ’য়ে শ’য়ে ছাত্র। তাঁদের মধ্যে অনেকেই খ্যাতিমান। জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। অথচ বাবার সবচেয়ে পছন্দের ছাত্র ছিলেন সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র কবিরুল ইসলাম। এত উজ্জ্বল তারকাপুঞ্জের মধ্যে কবিরুলদাকে সবচেয়ে পছন্দ করার ব্যাখ্যা বাবা দিতেন এইভাবে — ‘আমার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই অনেক কিছু করেছে, কিন্তু আর একজনও তো কবিতা লিখতে পারেনি। একমাত্র কবিরুলই কবি।’ মানে বাবার কাল্পনিক বর্ণ-কাঠামোয় কবিই হল কুলীন-শ্রেষ্ঠ।
হতেই পারে। বাবার মূল্যায়নের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার অবকাশ নেই। কারণ আমি কবি হতে পারিনি, মাঝে-মাঝে মনের মাঝারে কবি-কবি ভাব জন্মালেও কবিত্বের নিদারুণ অভাব বুঝতে পেরে চার কদম পিছিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, কবি হতে পারলে হয়তো অনুরাগিনীর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ত। তেমনই আবার গৃহশান্তিও বিঘ্নিত হত সমানুপাতিক হারে। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে যে ভগবান যা করেন, তা নিশ্চয়ই মঙ্গলের জন্য। (চলবে)