পিতৃ-তর্পণ
সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমার স্থির বিশ্বাস ছিল বাবা বেঁচে থেকে নিজের সেঞ্চুরিটা করে যাবেন। বিরানব্বই পর্যন্ত তিনি চান্সলেস ইনিংস খেলেছিলেন, স্লিপে পর্যন্ত একটাও ক্যাচ তোলেননি। নিয়মনিষ্ঠ, অত্যাশ্চর্য সংযমী জীবন ছিল তাঁর। তারপর হঠাৎ কীভাবে যেন তিনি ঘনঘন অসুস্থ হতে থাকলেন, বাড়ি-হাসপাতাল করতে হল অনেকবার, চব্বিশ ঘণ্টা আয়ার নজরবন্দি হয়ে পড়লেন, বিছানা ছেড়ে আর উঠতেই পারলেন না। তার আগে থেকেই অবশ্য বছর ছয়েক তিনি বিছানার বাইরে নামতে পারতেন না। এক সকালে আমার গিন্নির উপস্থিতিতে তাঁর হৃদযন্ত্র ধুকপুক করা একেবারেই বন্ধ করে দিল। বাবা সেদিন চুরানব্বই ছুঁইছুঁই।
শ্রীযুত সুনীল চট্টোপাধ্যায়, আমার পিতৃদেব। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁকে শত কোটি প্রণাম।
বাবা মান্য-গণ্য-দেশবরেণ্য গোছের কেউ ছিলেন না, ফলে তাঁর শতবর্ষ মনে রাখার দায় নেই কারও। সময়টা করোনাক্রান্ত অবশ হয়ে না থাকলে আমি হয়তো কোনও ছোট জায়গায় একটি ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম, ডাক দিতাম তাঁর কয়েকজন প্রিয় ছাত্রছাত্রীকে। খবরের কাগজের পাতায় নয়, বর্ণাঢ্য স্মরণানুষ্ঠানেও নয়, সুনীল চট্টোপাধ্যায় আবছা ভাবে হলেও বেঁচে আছেন তাঁদের স্মৃতিতেই। সম্ভবত আরও কিছুদিন থাকবেন। ছাত্র-বৎসল, দরদী, আদর্শ শিক্ষক হিসেবে, বিপন্ন হতে হতে যে প্রজাতিটি অধুনা বিলুপ্তই বলা চলে।
ঘটনাচক্রে আমার দুই পিসি এবং আমি কলেজে সুনীল চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্রও ছিলাম। পিসিরা পাঁচের দশকে সিউড়িতে, বিদ্যাসাগর কলেজে, আমি সাতের দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সিতে। সুদূর চণ্ডীগড়ে মৃত্যু-শয্যা থেকে বড় পিসি বাবাকে শেষ যে চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে আসন্ন চির-বিচ্ছেদের করুণ রাগিনী ছিল না, ছিল বাবার পড়ানোর স্মৃতি-রোমন্থন। পিসি লিখেছিলেন, ‘‘সেই কত বছর আগে সিউড়িতে তুমি আমাদের ‘পেলোপনেসীয়’ যুদ্ধের ইতিহাস পড়িয়ে ছিলে, ভাবলে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দেয়”। দুই দশক পরে আমিও বাবার ক্লাসে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে একই যুদ্ধের ইতিহাস শুনেছি, ফলস্বরূপ থুকিডিডিসের প্রেমে পড়েছি, এখনও সুযোগ পেলে পেরিক্লিসের ‘ ফিউনারাল ওরেশন’ বারেবারে পড়ি। প্রেসিডেন্সির দোতলায় ইতিহাসের সেমিনার রুমে বসে আমার মনে হত, স্বয়ং পেরিক্লিসই যেন ভর করেছেন ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের ওপর, পরণে মামুলি খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে চক-ডাস্টার।
বাবা বিশ্বাস করতেন, চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে নাকি পড়ানোই যায় না। পড়ানোর মতো পড়াতে হলে শিক্ষককে দণ্ডায়মান থাকতেই হবে সারাক্ষণ। এই অভিমতের সঙ্গে অনেকেই হয়ত সঙ্গত কারণে একমত হবেন না। তবে নিজের বিশ্বাসে বাবা অটল-অবিচল থেকেছেন বরাবর, ৪০ বছরের অধ্যাপনায় একটি ক্লাসেও চেয়ারে বসে পড়াননি।
বাবা ইতিহাস পড়াতেন কিন্তু তিনি ঐতিহাসিক ছিলেন না। বস্তুত সেই চেষ্টাটুকুও তিনি কোনও দিন করেননি, গবেষণার ধার ধারেননি, মৌলিকতার নামাবলী গায়ে চাপিয়ে একটাই পেপার ১০টা সেমিনারে ১০ রকম ভাবে পরিবেশন করতে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াননি, দলবাজিতে নাম লেখাননি, তথাকথিত বৈদগ্ধ্যের উজ্জ্বলতায় নিজেকে উদ্ভাসিত করার তাগিদই তিনি অনুভব করেননি কোনও দিন। নিজেকে সচেতনভাবে সরিয়ে রেখে তিনি কেবল শিক্ষকতায় মন-প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, মনে করেছেন শিক্ষকতার চেয়ে সম্মানজনক পেশা আর কিছুই হতে পারেনা। যখন যেখানে পড়িয়েছেন-সরকারি অথবা বেসরকারি কলেজ- সেখানেই সুনাম কুড়িয়েছেন, একটি দিনের জন্যও ক্লাস ফাঁকি দেননি, নিজেকে প্রস্তুত না করে কখনও ক্লাস নিতে ঢোকেননি, ঘড়ি ধরে ক্লাসে গিয়ে ঘণ্টা বাজা পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্র-সেবা করেছেন একাগ্র চিত্তে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে সাধারণ ছাত্রের সুবিধার্থে তিনি বাংলায় দু’টি বই লিখেছিলেন প্রাচীন ভারত আর প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ প্রকাশক। প্রথম দিন থেকেই বই দু’টি বেস্ট সেলার, কয় ডজন সংস্করণ হয়েছে তার সঠিক হিসেব আমার জানা নেই।
অথচ বাবার হৃদয়ের বিষয় ইতিহাস ছিল না, ছিল সাহিত্য। বাবার অজান্তে আমার ঠাকুর্দা তাঁকে হুগলি মহসিন কলেজে ইতিহাস অনার্স ক্লাসে ভর্তি করে দেন, সেই ভুল সংশোধনের সুযোগও বাবা আর পাননি। বাবা-ছেলের সম্পর্কে এই ভ্রান্তি ছায়া ফেলেছিল বরাবর। সারাটা জীবন ধরে বাবাকে অনুতাপ করতে শুনেছি, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যের বোঝা তাঁকে বয়ে বেড়াতে হল নিরুপায় হয়ে। ভাবলে বিস্মিত হই, অন্যের বোঝাও যে এমন সৎভাবে, আন্তরিকতার সঙ্গে কেউ বহন করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় সুনীল চট্টোপাধ্যায় তার আদর্শ দৃষ্টান্ত। এমন নীতিনিষ্ঠ পেশাদারিত্বই বা কোথায় দেখা যায়?
জীবনের একেবারে অন্তিম প্রহরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আদর্শ শিক্ষকের সম্মান জানিয়েছিল। তাঁর প্রিয় ছাত্র সুরঞ্জন দাস, তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাড়ি বয়ে এসে তাঁকে সম্মানিত করে গিয়েছিলেন। এই স্বীকৃতি বাবার আজীবন নিরলস সাধনার ফল।
(২০ ডিসেম্বর ছিল বাবার শততম জন্মদিন)