32 C
Kolkata
Tuesday, September 10, 2024

বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞান

Must read

সুমন চট্টোপাধ্যায়

কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান। বিশ্ব-টেনিসের অবিসম্বাদিত তারকা নোভাক জকোভিচকে নিয়ে গত প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ মেলবোর্নে যে নাটক অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, এটিই তার সারাৎসার। আর উপসংহারটি হল, অমর-কীর্তির হাতছানি উপেক্ষা করে নিজের অন্ধ-বিশ্বাস আর কুসংস্কারকে বাঁচিয়ে রাখতে একজন মানুষ প্রয়োজনে কোন অবিশ্বাস্য বিন্দু পর্যন্ত যেতে পারে জকোভিচ তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন ভাবীকালের কাছে। সে দৃষ্টান্ত গৌরবের নয়, কলঙ্কের।

নোভাক জকোভিচ কি তাহলে গো-মূত্রপায়ীদের সার্বিয় সংস্করণ?

এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় নোভাককে দেশে ফেরার বিমানই ধরতে হবে। যার অর্থ, একুশটি গ্র্যান্ড-স্ল্যাম জিতে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ের হীরের মুকুট মাথায় তোলার যে সুবর্ণ সম্ভাবনা নোভাকের সামনে এসেছিল, তার অপমৃত্যু হবে। কোভিড ইঞ্জেকশন না নেওয়ার ধনুর্ভঙ্গ প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকলে এ বার তাঁর উইম্বলডনে খেলাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। কেন না অস্ট্রেলিয়া যা করছে, ইংল্যান্ড তার চেয়ে ভিন্ন কিছু করবে বলে মনে হয় না। অবশ্য সেটা পরের ব্যাপার।

নোভাক এমন স্বখাত সলিলে ডুবে মরতে চাইছেন কেন? গত কয়েক মাসে দু’বার কোভিড হয়েছে তাঁর, সে সব চেপে গিয়ে তিনি মনের আনন্দে বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বাচ্চাদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেছেন এবং এ পর্যন্ত একটি বারের জন্যও মুখে মাস্ক লাগাননি। নানা রকম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত টেনিস সংস্থার কাছ থেকে বিনা টিকায় সে দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র আদায় করেছেন, প্রথম দফার আইনি লড়াইয়ে পদ্ধতিগত ভুল ত্রুটির ফাঁক দিয়ে জিতেও গিয়েছেন। এত করেও শেষ রক্ষা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন মন্ত্রক ফের নোভাকের ভিসা বাতিল করে দিয়ে, তাঁকে গোপন আস্তানায় অন্তরীণ করে রেখেছে। এমনকী এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন ক্রমশ জনপ্রিয়তা খোয়ানো অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও। তাঁরও সাফ কথা, কেউ একজন টিকা নেওয়া থেকে অব্যাহতি চাইতেই পারেন যদি তাঁর কাছে সেই আর্জির সারবত্তা প্রমাণ করার প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল প্রমাণ থাকে। তা যদি না থাকে তা হলে বাকি সকলের নিয়ম একই ভাবে তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। টেনিস তারকা বলে কেউ বিশেষ সুবিধে পাবেন না।

জকোভিচ বড় হয়েছেন সার্বিয়ায়, এমন কোনও দেশে নয় যেখানে সংস্কারের সঙ্গে বিজ্ঞানের লড়াইটা জবরদস্ত। সার্বিয়া এমন একটি দেশ যেখানে শিশুদের সবাইকে নিয়ম করে টিকা দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই ওই এক চিলতে দেশে আশি লক্ষ কোভিড ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে, অনুৎসাহীদের উৎসাহিত করতে সরকার টাকাও দিচ্ছে। আর পাঁচটি দেশের মতো সার্বিয়া প্রশাসনের লক্ষ্য হল, অতিমারীতে নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা। মানে ভাইরোলজি আর ইমিউনোলজির উপরেই বিশ্বাস রাখা। মোদ্দা কথায় সার্বিয়া সরকার বিজ্ঞানের ওপর সম্পূর্ণ আস্থাশীল।

তাহলে জকোভিচ হংস মধ্যে বক যথা হলেন কী করে? একটি ব্যাখ্যা হল, জকোভিচ জন্মেছেন বেলগ্রেডে যেখানে অলটারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প চিকিৎসার জনপ্রিয়তা সাঙ্ঘাতিক। জকোভিচের নিজেরও এ ব্যাপারে পড়াশোনা আছে, মাঝে মাঝে তা নিয়ে তিনি মুখও খোলেন। একটি সত্য ঘটনা বলা যাক। ২০১০ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন দেখে ডাঃ ইগর কেটোভিচ নামের এক ভদ্রলোকের মনে হয়েছিল, খেলতে খলতে জকোভিচকে যে মাঝেমাঝে মেডিক্যাল-ব্রেক নিতে হয় তার কারণ ‘অ্যাজমা’ নয়, বেশি বেশি করে রুটি খাওয়া। তার কিছুদিন পরেই সেই অন্তর্যামী ডাক্তারের সঙ্গে জকোভিচের দেখা হয় ক্রোয়েশিয়ায়, যেখানে তখন ডেভিস কাপ চলছিল। জকোভিচকে ডেকে তিনি এক অদ্ভুত পরীক্ষা করেন। ডান হাতটি উঠিয়ে রেখে বাঁ হাতে এক টুকরো পাউরুটি পেটের কাছে ধরতে বলেন তিনি। ব্যস এই পরীক্ষার পরেই জকোভিচের স্থির বিশ্বাস জন্মে যায়, গম-জাত কোনও কিছুর কাছে গেলেই তাঁর পেশিগুলো শিথিল হয়ে পড়ে।

এখানেই শেষ নয়। ২০১৬ সালে পেপে ইমাজ নামের একজনকে নিজের কোচ নিয়োগ করেন জকোভিচ। টেনিসের মাঠের বাইরেই পেপের নামডাক ছিল বেশি। কেননা তিনি প্রচার করতেন দীর্ঘ আলিঙ্গন যে কোনও রোগের নিরাময় করতে পারে। খুব সম্প্রতি জকোভিচের গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে শেরভিন জাফারিয়া নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে, যিনি ‘ওয়েলনেস অন্ত্রেপ্রেনর’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁর দাবি দীর্ঘদিন তিনি জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়েছেন, শমনদের সঙ্গে বসবাস করেছেন, সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন আশ্চর্য সব জড়িবুটি, আর ‘এলিক্সির’। ২০২০-র মে মাসে ইনস্টাগ্রামের একটি লাইভ অনুষ্ঠানে জকোভিচকে বলতে শোনা যায, মানুষ কেবল তার চেতনার বলে দূষিত জলকে পরিশুদ্ধ করে তুলতে পারে। কী ভাবে? Because water molecules react to our emotions, to what is being said.

এমন নয় বিশ্বের এই এক নম্বর টেনিস তারকা কোভিডের অস্তিত্বকেই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। সার্বিয়ায় সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করার পরে জকোভিচ ও তাঁর স্ত্রী এক মিলিয়ন ইউরো দান করেছিলেন রেসপিরেটর-সহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার জন্য। কোভিডের টিকায় কেন আপত্তি জকোভিচের? কারণ যে ভাইরাস বারে বারে মিউটেট করে, টিকা দিয়ে তার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাহলে করণীয়টা কী? খাদ্যাভ্যাস আর আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা। জকোভিচের কথায়, ‘I am curious about well being and how we can empower our metabolism to be in the best shape to defend against impostors like Covid 19’.

এমনই গোঁয়াড়-গোবিন্দ যন্তর, কেউ পারেনি নোভাককে তাঁর বিচিত্র, অবৈজ্ঞানিক, আধি-ভৌতিক সব ধারণা থেকে সরিয়ে আনতে। চুলোয় যাক কয়েকশো কোটি টাকা উপার্জন, চুলোয় যাক বিশ্ব-সেরার খেতাব, অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনা, সব হচ্ছে হোক, শেষমেশ যদি বেলগ্রেডে ফেরার বিমানে চাপতে হয় তাও সই। জকোভিচ তাঁর কুসংস্কারকে বুকে আঁকড়ে ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেনই। নট নড়ন চড়ন, নট কিচ্ছু।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article