31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

চুপিসারে চলে গেলেন মাস্টারমশাই

Must read

নিরানন্দর জার্নাল (৩)

চুপিসারে চলে গেলেন মাস্টারমশাই

সুমন চট্টোপাধ্যায়

ভেবেছিলাম, আজ লঘু-চালে লঘু কোনও বিষয় নিয়ে লিখব। নাম দিয়েছি বটে ‘নিরানন্দর জার্নাল’, তাই বলে কেবলই শোক, মৃত্যু, আতঙ্ক আর হাহাকার নিয়েই লিখতে হবে নাকি? অবসাদ অথবা আতঙ্ক যেন খেতে পেলে শুতে চায়, যত ভাববেন ততই মনে হবে গলার ফাঁসটা যেন একটু একটু করে আরও শক্ত হচ্ছে। বাঁচতে হলে এমন তমসাচ্ছন্ন আচ্ছাদন ফুঁড়ে বেরোতেই হবে। নতুবা আমরা সব্বাই পাগল হয়ে যাব, সমাজটাই বদলে যাবে পাগলা গারদে।

কী লিখব কী লিখব ভাবতে ভাবতে গতকাল সন্ধ্যায় একটি হোয়াটস অ্যাপ বার্তা এলো। পাঠিয়েছে সুপর্ণ পাঠক, আমার ভ্রাতৃসম, দীর্ঘদিনের সহকর্মী। আমাদের সঙ্গে ওদের সম্পর্কটা পারিবারিক। সুপর্ণর বাবা, আমাদের দেবদাস কাকা ছিলেন যেমন সজ্জন তেমনই স্নেহশীল মানুষ। মনে হয় আমার প্রতি তাঁর একটু বাড়তি দুর্বলতা ছিল। এই পাঠক-পরিবার আবার চক্রবর্তী পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সেই চক্রবর্তী পরিবার যার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কটি মাত্রই কিছুদিন আগে জীবনাকাশ থেকে খসে পড়েছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

সুপর্ণর বার্তা নিয়ে এল নীরেন্দ্রনাথের অনুজ সহোদর হীরেন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার খবর। ঘাতক সেই কোভিড। আরও জানতে পারলাম হীরেনবাবুর স্ত্রী গায়ত্রী কাকিমাও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের একটা বৈশিষ্ট হল ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনো। পরিবারে একজন আক্রান্ত হল মানে বাকিদেরও শিয়রে সমন।

হীরেনবাবুর বয়স হয়েছিল মাত্র একানব্বই। ‘মাত্র’ শব্দটি সচেতন ভাবে প্রয়োগ করছি এই কারণে যে বয়স তাঁকে মোটেই কাবু করতে পারেনি, শরীরে ফাইটিং-ফিট, মনে তরতাজা তরুণ, অটুট স্মৃতিশক্তি। জীবনকে তিনি যৌবনের প্রেয়সীর মতো আষ্টেপৃষ্টে ভালোবাসতেন, প্রচারের আলোর সম্পূর্ণ বাইরে থেকে নিজের মতো করে উপভোগ করতেন জীবনের রূপ-রস-গন্ধ। এমন একটি সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রাণোচ্ছল মানুষের যাত্রা স্রেফ অকারণে ভঙ্গ হয়ে গেল হঠাৎ। সুপর্ণর বার্তায় পেলাম সেই দুঃসংবাদ।

হীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার মাস্টারমশাই ছিলেন। সম্ভবত আমরা যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি হীরেনবাবু ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান হয়ে এলেন চণ্ডিকা প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শূন্যস্থানে। তার কিছুদিন আগে কলেজে প্রফেসার্স কমন রুমে বসেই চণ্ডিকাবাবুর হার্ট-অ্যাটাক হয়, আমরা তড়িঘড়ি তাঁকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করি, শেষ রক্ষা হয় না।

প্রথম দর্শনেই হীরেনবাবুকে আমার দারুণ ভালো লেগেছিল, মাস্টারমশাই-সুলভ কপট গাম্ভীর্য নেই, পাণ্ডিত্য ফলানোর চেষ্টা নেই, রসিক, হাসিখুশি, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর একজন সহজ স্বাভাবিক মানুষ। কমন-রুমে নিজের চেয়ারে বসে বিলিতি তামাক ভরে তিনি পাইপ জ্বালাতেন, গোটা ঘরটা সেই সৌরভে ম’ ম’ করত। পরে জেনেছিলাম হীরেনবাবু বিলেতে ডি ফিল করতে গিয়েছিলেন সস্ত্রীক কিন্তু দেশে ফিরে এসেছিলেন একা। তাঁর স্ত্রী সদ্যোজাত পুত্রকে নিয়ে বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন। প্রতি বছর একবার হীরেনবাবু যেতেন লন্ডনে আর একবার গায়ত্রী দেবী আসতেন ভারতে। দাম্পত্যের এই বন্দোবস্ত জারি ছিল বহু বছর। ওঁদের একমাত্র পুত্র সুমা তার জাপানি বৌ নিয়ে বিলেতেই থাকে, মস্ত বড় সরকারি চাকরি করে, এখন বাবার মৃত্যুর পরেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে কলকাতায় আসতে পারছে না। স্যারের এমন অনভিপ্রেত মর্মান্তিক পরিণতির কথা যখনই ভাবছি, হাত-পাগুলো কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে।

অধ্যাপকদের সঙ্গে হীরেনবাবুকে আমি কখনও অন্তরঙ্গ ভাবে মেলামেশা করতে দেখিনি, তাঁর বন্ধু বলতে ছিলাম আমরা ছাত্ররাই। বিশেষ করে আমাদের চারজনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল খুবই নিবিড়— সুরঞ্জন দাস, ভাস্কর চক্রবর্তী, সুগত বসু আর আমি। বালিগঞ্জ স্টেশনের সন্নিকটে একটি গলির দোতলা বাড়ির এক তলায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেখানে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল অবাধ। কতবার, কত অসময়ে, কত রকম অবস্থায় আগাম নোটিশ না দিয়ে তাঁর দরজায় টোকা দিয়েছি, হীরেনবাবু একটুও বিরক্ত না হয়ে ভিতরে বসিয়ে নিজের হাতে বিলিতি কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। একা পুরুষ মানুষের বাড়ি সচরাচর যতটা অগোছালো হওয়ার কথা হীরেনবাবুর ফ্ল্যাট তা একেবারেই ছিল না, ঝকঝক করছে মেঝে, এক ফোঁটা নোংরা নেই, ঘরের প্রতিটি জিনিস গভীর যত্নে পরিপাটি করে সাজানো। আমি কখনও সখনও ইয়ার্কি মেরে বলতাম, ‘স্যর আপনার নিশ্চয়ই কোনও গোপন বান্ধবী আছেন যিনি ফ্লাটটাকে এমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখে দেন।’ হীরেনবাবু হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠতেন, বড় রোমান্টিক ছিল তাঁর কণ্ঠস্বর।

আসলে হীরেনবাবুর সারা জীবনের প্রেয়সী ছিলেন একজনই। গায়ত্রী। একদিন সকালে হীরেনবাবু রান্নাঘরে গিয়েছেন কফি তৈরি করতে আমি বুক-শেলফের বইগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। একটিও ইতিহাসের বই নেই, প্রায় সবটাই সাহিত্যের, বাংলা ও ইংরেজি দুটোই। হাতড়াতে হাতড়াতে জীবনানন্দর একটি কবিতার বই বের করে মলাট খুলতেই অপার বিস্ময়। মুক্তোর মতো বাংলা হরফে লেখা, ‘গায়ত্রী, প্রিয়তমা, সুন্দরীতমাকে।’

জীবনে অনেক যশস্বী মাস্টারমশাইকে দেখেছি আমি, তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসাও পেয়েছি। কিন্তু বন্ধু-মাস্টারমশাই পেয়েছি এই এক জনকেই, যিনি তাঁর ‘প্রিয়তমা, সুন্দরীতমাকে’ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন ঘোর অনিচ্ছায়।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article