31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

আতঙ্ক না আতঙ্ক নয়

Must read

নিরানন্দর জার্নাল (৮)

আতঙ্ক না আতঙ্ক নয়

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আমরা আতঙ্কিত হব না, হব না? হলেও কতটা হব?

বেঙ্গালুরুর নিমহ্যান্সের এক সায়কিয়াট্রিস্টের একটি ভিডিয়ো দেখার পর থেকে আমার মনে প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। নিমহ্যান্স, দিল্লির এইমস, ইন্ডিয়ান সায়কিয়াট্রিক সোসাইটির কয়েকজন যশ্বসী মনোবিদ একত্রে একটি স্বাক্ষরিত বিবৃতি প্রকাশ করেছেন ‘মিডিয়ার বন্ধুদের’ উদ্দেশে। ভিডিয়োটিতে রয়েছে সেই বিবৃতির সার কথাটুকু।

এঁদের বক্তব্য, ক্রমাগত কেবলমাত্র মৃত্যু, শ্মশান আর মানুষের হাহাকারের কথা দেখিয়ে মিডিয়া এমন একটি আতঙ্কের আবহ তৈরি করেছে যে সমাজের উপর তার অশুভ প্রভাব পড়ছে মারাত্মক। গলা সামান্য খুশখুশ করলেই লোকে পাগলের মতো রেমডেসিভিরের সন্ধানে ওষুধের দোকানে দৌড়চ্ছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ঘরে মজুত করছে, হাসপাতালে বেড বুক করার জন্য কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিচ্ছে, স্নায়ুর ওপর এমন ক্রমাগত চাপ সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ আবার আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কোভিড ভাইরাসের থেকেও দ্রুতহারে, তাতে বিভ্রান্ত, অসহায় সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়ছে অবিশ্বাস্য হারে।

উদাহরণ দিতে গিয়ে নিমহ্যান্সের ওই ডাক্তারবাবু তাঁর একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। ‘দিন কয়েক আগে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করে খবর দিলেন, তাঁর বাবা কোভিড পজিটিভ হয়েছেন, এখনই তাঁর জন্য হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা করতে হবে, যত টাকা লাগে লাগুক, বাবার চিকিৎসায় তিনি কোনও কার্পণ্য করবেন না। আমি সেই বন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম বাবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল কত। সে বলল, ছিয়ানব্বই। আমি বললাম, বাড়িতে রেখেই তাঁর বাবার চিকিৎসা সম্ভব, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই। বন্ধুটি তখন জানাল, ইতিমধ্যেই সে দু-দু’টি হাসপাতালে বেড বুক করে ফেলেছে, তার মধ্যে একটিতে বাবাকে নিয়ে যাবেই। তাঁকে নিরস্ত করার শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি জানতে চাইলাম, শিক্ষিত, ওয়াকিবহাল মানুষ হয়েও তিনি এমন অবুঝ হচ্ছেন কেন? বন্ধুটি চিৎকার করে বলে উঠলেন, আপনি কি টেলিভিশন দেখেন না? দেখতে পাচ্ছেন না কী ভাবে পরের পর মানুষ সামান্য অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে?’

এই কাহিনি শুনিয়ে ডাক্তারবাবুর পাঞ্চ-লাইন, একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকই যদি মিডিয়ার দ্বারা এ ভাবে প্রভাবিত হন, তাহলে আম-জনতার অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।

মৃত্যু সত্য ডাক্তারবাবুরা সে কথা অস্বীকার করছেন না। তাঁদের যুক্তি, মুদ্রার উল্টো দিকটিও একই রকম সত্য, কিন্তু মিডিয়ায় সেটা প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যাচ্ছে। সেই সত্যটা কী? ওই ডাক্তারবাবু জানাচ্ছেন প্রতি ১০০ জন কোভিডাক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৯০ জনেরই অসুখ সারছে বাড়িতে থেকেই। বাকি যে ১০ শতাংশ হাসপাতালে আসছেন তাঁদের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হচ্ছে। অর্থাৎ এঁদের যুক্তি অনুসারে কোভিড অতিমারি হলেও প্রাণনাশের সর্বগ্রাসী আতঙ্ক অতিরঞ্জিত। অযথা আতঙ্ক ছড়ালে কেউ শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন না।

এহ বাহ্য, সংখ্যাতত্ত্বের নিক্তিতে মাপলে এই যুক্তি অকাট্য। তেমনি আবার শুধুই সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আড়াল করা যায় না, সব বেটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটা মিডিয়াকে একতরফা দোষ দিয়েও লাভ নেই। মানুষের মনে আতঙ্ক অথবা বিপন্নতাবোধ মিডিয়ার কারণে তৈরি হয় না, পারিপার্শ্বিক আরও অনেক সংশ্লিষ্ট বিষয় আছে। শাসক ভয় পেয়ে দিনের পর দিন লকডাউন চাপিয়ে দিলে, আমরা তো ভয় পাবই। হঠাৎ করে কোভিডের টিকা যদি একদিন বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়, আমরা কি আনন্দে নেত্য করব? সুযোগ বুঝে ওষুধের কালোবাজারিরা যদি ডক্সিসাইক্লিনের মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ লোপাট করে দেয়, আমরা কি তাদের নামে জয়ধ্বনি দেব? সত্যি কথা বলতে কি এই অতিমারিতে দুনিয়ার সব দেশের মানুষই কম-বেশি আতঙ্কিত বোধ করেছে, এখনও করছে। মার্কিন মুলুকে কোভিডের সংক্রমণ ধরা পড়ার পরে লোকে হুমড়ি খেয়ে দোকানে দোকানে হানা দিয়ে ছিল টয়লেট পেপার মজুত রাখতে। বলে দেওয়া খুব সহজ, আতঙ্কিত হবেন না। হয়তো অযথা আতঙ্কিত হওয়াটা উচিতও নয়। কিন্তু যমরাজের চৌকাঠে পা দিয়ে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাও নিরুপায়। আতঙ্কিত বোধ করাটা তাদের এখন মৌলিক অধিকার। সেই আতঙ্ক নিরসনের দায় মিডিয়ার নয়, রাষ্ট্রের।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article