নিরানন্দর জার্নাল (৫)
পরার্থে জীবনদান করল সৌরভ
আমার বাড়ির খুব কাছেই লেক গার্ডেন্স রেল-স্টেশন। নিরিবিলি, ছিমছাম, প্রেমের আদর্শ জায়গা। এ লাইনে খুব বেশি ট্রেন চলে না, রাতের ট্রেনের হর্নের গমগমে আওয়াজ আমি বিছানায় বসে শুনতে পাই। কাল রাত ১১টা নাগাদ হঠাৎ একটা ট্রেনের আওয়াজ শুনে মনে হল, এতে চড়েই সৌরভ নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরছে।
ফেরেনি। আর কোনও দিন ফিরবেও না। বেঁচে থাকলে শূন্য দলানে বসে সৌরভের অশীতিপর বৃদ্ধা মা হাপুস নয়নে কাঁদতেন, কে জানে একমাত্র পুত্র-শোকে হয়ত পাগলই হয়ে যেতেন, সব-হারানো মায়ের বুকফাটা হাহাকার প্রতিধ্বনিত হত ওদের পুরোনো জমিদার বাড়ির খিলানে, আমাদের কানে সে আওয়াজ পৌঁছত না সৌরভের না থাকাটা প্রকৃতির নিয়মে একদিন আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাবে, প্রসঙ্গ উঠলে আমরা সবাই সৌরভের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠব, সর্বস্বান্ত হওয়ার অসহ্য মর্মবেদনা বোধ করতেন একমাত্র ওর মা। ঈশ্বর এমন মর্মান্তিক পরিণতি থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, পুত্রের পাঁচ দিন আগে সৌরভের মা-ও চলে গিয়েছেন।
যে ট্রেনের আওয়াজ শুনে কাল রাতে আমার সাময়িক বিভ্রম হয়েছিল, তাতে চড়ে সৌরভ সত্যিই অনেক সময় মহেশতলায় ওদের বাড়িতে ফিরত। বেশির ভাগ রাতেই লাস্ট ট্রেনে। বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে ছাদে উঠে কোনও কোনও রাতে ও আমাকে ফোন করত। মধ্যরাতের পরে স্রেফ গপ্পো করার জন্য কাউকে ফোন করাটা যে খুব একটা সঙ্গত কাজ নয়, সৌরভের তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই ছিল না। ওর ভাবখানা ছিল, সুমন’দার ওপর আমার যা খুশি করার অধিকার আছে, তাই আমি যখন ইচ্ছে ফোন করতে পারি। এই অধিকারটুকু অর্জন করতে সৌরভ একেবারেই কোনও সময় নেয়নি, এটাই ছিল ওর বিশেষত্ব।
নিজের কোনও একটা কাজে সৌরভ এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ‘এই সময়’ অফিসে আমার এক রিপোর্টার সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কাজ হয়ে গেলে সেই রিপোর্টারকে ও অনুরোধ করে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। সেই আলাপ আত্মীয়তায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল চোখের পলকে, প্রথমে আমার, তারপর কস্তুরীর সঙ্গে। কবিতার সৌজন্যে শেষের দিকে আমার গিন্নির সঙ্গেই ওর যোগাযোগ ছিল বেশি।
সৌরভ কত বড় কবি ছিল, আদৌ ছিল কি না, আমি বলতে পারব না, আমার পক্ষে সেটা অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে। তবে বিকেল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত নন্দন চত্বর ছিল ওর বিচরণ ক্ষেত্র, কবি, হবু-কবি, অ-কবিদের সান্নিধ্যে ওর সময় কাটত। রাজনীতি করার সুবাদে সংগঠন করার একটা স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল, অনেক সময় মনে হত, ওর মাতব্বরি দাদাগিরির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এর জন্য আমার কাছে ধমকও খেয়েছে বেশ কয়েকবার।
সম্বৎসরে আমার কাছে একটাই আবদার থাকত সৌরভের। এই সময় পুজো সংখ্যায় ওর এবং আরও একজনের কবিতা ছাপানো। বেণীর সঙ্গে মাথাকে টেনে আনার কী প্রয়োজন, আমি সৌরভকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। বুঝেছি এটাও ওর জনসেবারাই এক ধরনের অভিব্যক্তি, ও চায় পুজোর সময় ওর কবি-বন্ধুর মুখেও হাসি ফুটুক। চাকরি-বাকরি করত না সৌরভ, করার খুব একটা ইচ্ছে ছিল বলেও আমার মনে হয়নি, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ছিল ওর অবৈতনিক চাকরি। পরের কারণে উৎসর্গীকৃত জীবন ছিল ওর, ধান্দবাজদের ভিড়ে এখানেই সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের অনন্যতা। জীবনে চরম মূল্যটিও দিতে হল সেই জন্যই। অন্যের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এল সংক্রমণ, পরে সেই হাসপাতালেই ভর্তি হল, আর বেরোল না। পরার্থে জীবন-দান।
ওয়েব-শাসিত সমাজে সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব সৌরভ বুঝতে পেরেছিল আমার একটি বক্তৃতা শুনে। বাংলা আকাদেমির আমন্ত্রণে বছর কয়েক আগে আমি বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। বিষয় ছিল গণমাধ্যমের অস্তরাগ, ব্যক্তিগত মাধ্যমের উল্কা সদৃশ উত্থান। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি কী ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে আমাদের জীবনে, তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে আমি তা বিস্তারিতে ব্যাখ্যা করেছিলাম। সেদিন রাতেই আমাকে ফোন করে সৌরভ বলেছিল, ‘তোমার কথা শোনার পরে আর সময় নষ্ট করিনি, একটু আগেই নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছি।’ ধীরে ধীরে ফেসবুকের টাইমলাইনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সৌরভের বসতবাটি।
তোকে আমার কিচ্ছু বলার নেই সৌরভ, স্যালুট করা ছাড়া। প্রাণের ভয়ে আমরা যখন দুরুদুরু বুকে শামুকের খোলের মধ্যে ঢুকে বসে আছি, এ কথা জেনেও যে চলে গেলে কোনও ক্ষতি নেই, তখন তুই তোর স্পর্ধিত যৌবন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলি আর্তের সেবায়। আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আমি তোকে তোপধ্বনি শুনিয়ে বিদায় জানাতাম ভাই আমার।