নিরানন্দর জার্নাল (২)
এবার নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষা
সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে, সহজ, কঠিন, দ্বন্দ্বে ছন্দে চলে যাবে।’
হ্যাঁ, ভোটের পরেও তাতে এক ছটাক ইতর বিশেষ ঘটবে না।
২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ ভোট নিয়ে আমি একটি শব্দ লিখিনি বা উচ্চারণ করিনি। ফেসবুকের অনেক বন্ধু নানা ভাবে প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আমি শুনেও না শোনার ভান করে থেকেছি। আজও আমি সেই মৌনব্রতের প্রত্যয়ে অবিচল আছি, থাকবও।
তাই বলে কি আমি ভোট দিইনি? দিয়েছি, সপরিবার দিয়েছি। করোনার ভয়ার্ত আবহে দুটো মুখোশ লাগিয়ে, দুরু দুরু বুকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, লাইনে দাঁড়িয়েছি। নাগরিকের প্রায় সব অধিকার আজ অন্তর্হিত, শিবরাত্রির শলতের মতো এই এক ভোটদানের অধিকারটুকুই বেঁচে আছে। সেই অধিকার প্রয়োগ করব না, তাও কী হয়?
অনেক অনেক কাল পরে গতকাল টেলিভিশন খুলে ভোটের ফল প্রকাশের অনুষ্ঠান দেখেছি, পণ্ডিত প্রবরদের মতামত শুনেছি, কে রাজা থেকে ফকির হল বা ফকির থেকে রাজা সেই গপ্পোগুলোও শুনেছি। সার কথা যেটা বুঝেছি তা হল, ‘ওপিনিয়ন পোল’ বা ‘এগজিট পোলের’ মতো লোক-ঠকানো গিমিকগুলো এ বার আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত। ফলাফলের এই চেহারা কোনও চ্যানেলের কোনও সমীক্ষায় প্রতিফলিতই হয়নি। মিডিয়ার অন্দরমহলের খবর রাখি বলে জানি, এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি বুঝতে না পারার ফল নয়, এটা ইচ্ছাকৃত, প্রভুদের অকৃপণ দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে সেবাদাসদের ভীরু প্রতিদান। গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের অন্যতম যুগ-লক্ষণ হল মিডিয়ায় পচন ধরা, ফলে একরাশ দুর্গন্ধ ছাড়া তারা আর কিছুই ছড়াচ্ছে না।
আমি গভীর ভাবে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন আমার এক প্রাণের প্রিয় বন্ধুর জীবন-মরণ নিয়ে। আজ আট দিন হল দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের আইসিইউ-তে সে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝে চলেছে। বন্ধুটি রাজনৈতিক কর্মী, দুর্গাপুর পুরসভার কাউন্সিলর, আমার জীবনে দেখা একমাত্র অ-বাম রাজনীতিক যে ঘরের টাকা খরচ করে দল করে, কারও বিপদ দেখলে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পয়দা-কামানো লোকজনের মধ্যে থেকেও যে এখনও বিশ্বাস করে নিঃস্বার্থ ভাবে মানুষের সেবা করাটাই রাজনীতি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে যাওয়ার পরে বাড়ির লোক মায় ডাক্তারবাুরাও ওকে পই পই করে নিষেধ করেছিলেন ভোটের প্রচারে চর্কি কাটা বন্ধ করতে, সে শোনেনি। আজ তারই নির্মম অথচ অনিবার্য পরিণতি ভুগতে হচ্ছে তাকে। আমার কাছে ভোটের ফলাফলের চেয়ে ভোট-প্রচারের ভুক্তভোগী এই বন্ধুটির প্রাণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের ফল যাই হোক, রাজ্যে যে সহসা রামরাজ্য ফিরে আসবে না আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই বন্ধুটি না থাকলে আমার নির্বাসিত, নিঃসঙ্গ জীবনের অবশিষ্টটুকুও অর্থহীন হয়ে পড়বে, কেউ কোনও দিন ভরাতে পারবে না সেই শূন্যতা।
ভোটে যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে, আমরা ভয়ে ভয়ে দিনযাপন করছি সহস্রগুণ কঠিন আর এক লড়াইয়ের মধ্যে, মানুষের জীবনরক্ষা। ভোটের উচ্চনাদ উত্তেজনার মধ্যে এই লড়াইটা কিছুটা আড়ালে চলে গিয়েছিল, তার জন্য ভাইরাসের আগ্রাসন কিন্তু কমে যায়নি, বিপজ্জনক ভাবে বেড়েছে। দিল্লি অথবা মুম্বইয়ের সঙ্গে তুলনায় কলকাতার হাল হয়তো সামান্য ভালো যদিও তাতে আত্মশ্লাঘা বোধ করার কোনও কারণ দেখি না। বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলির প্রায় কোনওটিতে বেড নেই, অক্সিজেন আছে তো সিলিন্ডার নেই, স্বাস্থ্যকর্মী আছে কিন্তু টিকা নেই। সবচেয়ে অস্বস্তির কথা বিশেষজ্ঞরা তোতা পাখির মতো রোজ পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে সকলেই কম-বেশি ইতস্তত করছেনl একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক, যিনি আগামী বুধবার থেকে পনেরো দিনের জন্য নিজের রাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করে দিয়েছেন।
এই যে দোদুল্যমানতা তার পিছনেও সক্রিয় রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের ক্রুঢ অঙ্ক। লকডাউন মানে বোঝার ওপর শাকের আঁটি, নড়বড়ে অর্থনীতি আরও বেহাল হয়ে যাওয়া, নানা কারণে এমনিতেই বিপর্যস্ত আম-নাগরিকের রোষাণলে ঘৃতাহুতি দেওয়া। রাজনীতিকরা শেষ বিচারে নিজেদের স্বার্থের কথা ভাববেন এর মধ্যে অস্বাভাভিকতা কিছু নেই। আবার এ কথাও একই রকম সত্য যে নেতৃত্বের আসল অগ্নি-পরীক্ষাটি হয় সঙ্কটের সময়েই।
এটা মামুলি সঙ্কট নয়, একটি অপ্রস্তুত দেশের মহা-সঙ্কট, বিশেষজ্ঞরা যাকে বলছেন ‘মেডিকেল এমার্জেন্সি’। আমার কাছে ভোটের ফলাফল তখনই কিছুটা অর্থবহ মনে হবে যদি দেখি রাজ্য-নেতৃত্ব আর কাল-বিলম্ব না করে সঠিক রোগের সঠিক দাওয়াইটিই প্রয়োগ করছেন।