নিরানন্দর জার্নাল (১৭)
আগাপাশতলা পবিত্র
সুমন চট্টোপাধ্যায়
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই স্তম্ভে আর শোকগাথা রচনা করব না। হোক না নিরানন্দর জার্নাল, এ বার কেবল আনন্দ-ধ্বনি শোনাব, বীরত্বের কথা বলব, জীবনের জয়গান গাইব।
গতকাল ঠিক বিকেল চারটেয় আমার শুকনো পাতার ডালে ঘূর্ণিঝড় নেমে এল, ইয়াস পৌঁছনোর আগেই। দুর্গাপুর থেকে একজন টেলিফোনে বলল, পবিত্র’দা আর নেই।
বিষয়টি এমন নয় আমি এই মর্মান্তিক পরিণতির আগাম আঁচ পাইনি। গত ১৬ মে রাতে দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তারবাবুর গলায় প্রত্যয়ের লেশমাত্র ছিল না, বোঝা গেল, তাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করার শেষ চেষ্টা করছেন। তারপর আমি আর পবিত্র-জায়া আমাদের ভগ্নি-সমা দেবযানীকে ফোন করিনি।
মিথ্যে স্তোক শোনাব কী করে? কেবল সিঙ্গাপুরে পবিত্রর ছেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জেনে নিয়েছিলাম সে এই সঙ্কটে বাড়ি আসছে কিনা। সিঙ্গাপুরের পাট চুকিয়ে, দামী চাকরি ছেড়ে দিয়ে, লটবহর নিয়ে সে বাড়ি এসেছে গত শুক্রবার। নিবিড় ঘন আঁধারে ওইটুকুই যা আলোর রেখা।
১৬ মে-র আগে পর্যন্ত রোজ রাতে আমার কাজ ছিল হাসপাতালের কর্ণধার আমার অনেক দিনের পরিচিত ডাঃ সত্যজিৎ বসুকে ফোন করে পবিত্রর খবর নেওয়া, তারপরে দেবযানীকে যা শুনলাম বিশ্বস্ত ভাবে সেটা রিপোর্ট করা। পবিত্র ভালো হয়ে যাবে এমন আশ্বাস সত্যজিৎ কখনও শোনায়নি, তবে একেবারে আশা নেই এ কথাও বলেনি। ফলে আমি আশা আর আশঙ্কার মধ্যে দুলছিলাম, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম পবিত্র যাতে শেষ হাসিটা হাসে। টানা ২৬ দিন বাঘের বাচ্চার মতো লড়ে পবিত্র শেষে আমাদেরই চোখের জলে ভাসিয়ে গেল। বড্ড অবিবেচকের কাজ করল সে।
ইস্কুলে তর্কশাস্ত্রের বইয়ে একটি উপপাদ্য পড়েছিলাম, ‘proper name is not connotative.’ সে জন্যই কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হতে পারে, শ্যামলা মেয়ের নাম হতে পারে শুভ্রা। পবিত্র সারাটা জীবন ধরে এই উপপাদ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে চাইলে একজন মানুষ নামে ও কর্মে এক হতে পারে। পবিত্র ছিল
আগাপাশতলা পবিত্র, নিষ্কলুষ, পরোপকারী, সৎ ও সজ্জন মানুষ। আমার জীবনে দেখা একমাত্র পবিত্র-পুরুষ।
পবিত্রর পদবীও ছিল চট্টোপাধ্যায়। দুয়ে দুয়ে চার করে অনেকে ভাবত আমরা বোধহয় দু’ভাই। আমি বা পবিত্র কেউই এই ভ্রান্তি দূর করার কোনও চেষ্টা করিনি ইচ্ছে করেই। সত্যিই তো আমাদের বন্ধন ছিল ভায়ের চেয়ে নিকট, শালগাছের মতো সুদৃঢ়, আকাশের মতো উন্মুক্ত আর পাহাড়ি ঝর্নার মতো উচ্ছল। গতকাল সন্ধ্যায় দেবযানীকে মেসেজ করলাম, পবিত্র আমার অর্ধেকটা জীবন নিয়ে চলে গেল, বাকি অর্ধেকটা নিয়ে এ বার শুধু অপেক্ষা ওর সঙ্গে পুনর্মিলনের
পবিত্রর নিবাস উখড়ায়, দুর্গাপুরের অনতিদূরে কোলিয়ারি এলাকা। এ তল্লাটে ওরা কয়েক পুরুষের বাসিন্দা, সবাই এক ডাকে চেনে। সুন্দর দোতলা বাড়ি, সামনে চোখ-জোড়ানো ফুলের বাগান। এই বাড়িতে আমি অজস্র রাত কাটিয়েছি, কদাচিৎ একা, বেশিরভাগ সময়েই বন্ধু অথবা সহকর্মীদের নিয়ে। দুর্গাপুরের দিকে যাচ্ছি শুনলে পবিত্র প্রতিবারই ওর বাড়িতে থাকার আব্দার করত, মাঝেমাঝে তা রক্ষা না করে উপায় থাকত না।
আরও একটি বাৎসরিক আব্দার থাকত পবিত্রর যা নস্যাৎ করে দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সুদক্ষ সংগঠক, এলাকায় অতি জনপ্রিয় পবিত্র প্রতি বছর শীতে উখড়া স্টেডিয়ামে দিন কতকের একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করত, প্রথমে ক্রিকেট ছিল পরে হয়ে দাঁড়াল ফুটবল। টুর্নামেন্টের ফাইনালের দিনে কোনও নামকরা খেলোয়াড় আর ভিআইপি-কে উখড়ায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার। এরাপল্লি প্রসন্ন, অশোক মালহোত্রা, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দু বিশ্বাস সবাই গিয়েছে সেখানে। আমি সঙ্গে নিয়ে গেছি ব্রাত্য বসু, গৌতম ভট্টাচার্য, অরূপ বিশ্বাসকেও। পবিত্র রসিকতা করে বলত, ‘আমার অক্ষৌহিনী সেনার দরকার নেই দাদা, একজন কৃষ্ণ থাকলেই যথেষ্ট।’ পবিত্র আমার সমবয়সী ছিল, বোধহয় সামান্য বড়ই হবে, তবু আমাকে ‘দাদা’ বলে ডাকত। সেই অভ্যাস ও আর বদল করেনি।
রাজনীতি ছিল পবিত্রর রক্তে, খানদানি কংগ্রেসি। দল বারেবারে ভেঙেছে, সহকর্মীরা দলে দলে বেরিয়ে গিয়েছে ও তবু কংগ্রেস ছাড়েনি। কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়ে একবার পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছিল, ওর সেবা আর কর্মদক্ষতার জন্য মানুষ এখনও ওকে সেলাম করে। ২০১৬ সালে ওকে অরূপ বিশ্বাস নিয়ে আসে তৃণমূলে। দুর্গাপুর পুরসভার নির্বাচনে জিতে জলের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ হয়। ওর কার্যকালে দুর্গাপুর ব্যারেজ ভেঙেছে দু’বার, নিপুন কর্মদক্ষতায় বিপর্যয় সামলে ও নগরবাসীকে জলের কষ্ট অনুভবই করতে দেয়নি। মিশন হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরাও বলছিলেন, এমন ভদ্র আর কাজের মানুষ তাঁরা খুব কমই দেখেছেন।
পবিত্রর পবিত্র মূল্যবোধ ওকে দুর্নীতির থেকে শতহস্তে দূরে রেখেছিল বরাবর। ও রাজনীতি করত নিজের পয়সায়, কারও কাছে হাত পাতেনি, তোলা বা পয়দা নেওয়া তো দূরস্থান। আমি পরিহাস করে বলতাম,’ তুই হচ্ছিস এনডেনজার্ড স্পিসিস’। পবিত্র জবাবে বলত, সেটাই ভালো দাদা, মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতে পারি, কেউ আমাকে দেখে আঙুল তুলে বলতে পারে না, লোকটা চোর। যে তল্লাটে পবিত্র থেকেছে, রাজনীতি করেছে, সেটা চুরি, অবৈধ কারবারের স্বর্গরাজ্য, হাওয়ায় টাকা ওড়ে। এমন পরিবেশের মধ্যে থেকেও লোভ সংবরণ করে যে সততার পথ থেকে এক ছটাকও সরে আসে না, আসতে চায় না, তাকে আমার বিনম্র শেষ নমস্কার।
দলীয় রাজনীতি করেও যে অজাতশত্রু থাকা যায়, পবিত্র সেটাও প্রমাণ করে ছেড়েছিল। সামাজিক সম্পর্কে, বিপদে পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কিংবা সরকারি সাহায্য বণ্টনে ও মানুষের দলীয় রং দেখত না। পবিত্র বিশ্বাস করত প্রতিদ্বন্দ্বীকে শত্রু ভাবা অন্যায়, রাজনীতির চেয়ে জীবনটা অনেক বড়। ইশ্, সবাই যে কেন পবিত্র হতে পারে না!
জীবনে কত যে রাজনীতিকের সংস্পর্শে এসেছি বলতে পারব না। পিরামিডের নীচের ধাপে পবিত্র
চট্টোপাধ্যায়ের সমতুল্য আর কাউকে দেখিনি। একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর জীবনদর্শন বা জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত পবিত্র ছিল তার অত্যুজ্জ্বল, ব্যতিকর্মী দৃষ্টান্ত। সে জন্যই তো শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে উখড়া আর দুর্গাপুর। আর আমি হারালাম আপনার চেয়েও আপনজনকে।