27 C
Kolkata
Sunday, September 15, 2024

মদের আমি মদের তুমি

Must read

নিরানন্দর জার্নাল (১০)

মদের আমি মদের তুমি

সুমন চট্টোপাধ্যায়

দিন কতক আগে ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছিলাম, লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পরে দিল্লিতে মদের দোকানের সামনে লম্বা লাইন। শিরোনামে লিখেছিলাম, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’। এ বার কলকাতায় পাড়ায় পাড়ায় একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখার পরে সেই নীতিবাগিশ মনোভাব থেকে আমি সরে এসেছি। এখন আমার মনে হচ্ছে সব ছবির একটাই শিরোনাম হওয়া উচিত।’ মদ খাচ্ছি, বেশ করছি, কার বাপের কী!’

অবস্থান বদলের সবচেয়ে বড় কারণ বিবেক-দংশন। একদা আমি নিজেই আইএসও সার্টিফায়েড মাতাল ছিলাম, বলতে গেলে সেই কলেজ জীবন থেকেই। হতে পারে কালীপুজোর রাত্রি-শেষে আমার জন্ম হয়েছিল বলে কারণ-বারির প্রতি আমার এমন তীব্র আসক্তি ছিল। অনেক বছর হল আমি সুরা-সুখ বঞ্চিত, স্বেচ্ছায় নয় শারীরিক কারণে। আমাদের যৌবনে খবরের কাগজের নিউজরুম ছিল শুঁড়িখানার এক্সটেনশন, এক সে এক মাতালের অবাধ গতিবিধি ছিল সেখানে। আমার কর্মজীবনে আমি এমন সব যশস্বী মদ্যপকুলশ্রেষ্ঠদের দেখেছি, তাঁদের সঙ্গ লাভ করেছি, সুরাসক্তির মানদণ্ডে যাঁরা প্রত্যেকে ভারতরত্ন পাওয়ার যোগ্য। আমার যোগ্যতা বড় জোর পদ্মভূষণ পাওয়ার মতো ছিল।

খবরের কাগজের নিউজ রুমের চেহারা-চরিত্র ইদানীং বিলকুল বদলে গিয়েছে। স্বভাব-মাতালেরা অদৃশ্য, নিউজরুমের চেহারাও অনেকটা হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডের মতো। আজকাল যে সব ছেলেপিলেরা সাংবাদিকতা করতে আসে তারা অনেক হিসেবি, অঙ্কে পারদর্শী, সাবধানী ও ক্ষেত্র বিশেষে সন্ত্রস্ত। বাঁধনহীন উদ্দামতা, বেহিসেবী স্বেচ্ছাচার, নিউজরুমে মাতালে-মাতালে ঠোকাঠুকি এখন মৃত অতীত। প্রেস ক্লাব অথবা অন্য কোনও শুঁড়িখানায় গিয়ে দু’পাত্র রাম না খেলে আমরা জাতে উঠতে পারতাম না, সাংবাদিককুলে টিটোটেলররা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এখন মিডিয়ার ছেলেপুলেরা গোপালের মতো সুবোধ বালক হয়ে গিয়েছে, সুরাসক্তির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা সমাজে। সুরাপানের এমন অবিশ্বাস্য গণতন্ত্রীকরণই প্রতিফলিত হচ্ছে মদের দোকানের সামনের লম্বা লাইনে।

মন দিয়ে দেখছিলাম এই রকমই একটি লাইনের ভিডিও। কে নেই সেই লাইনে? কাঁধে ব্যাগপ্যাক ঝোলানো যুবক আছে, কেতাদুরস্ত মধ্যবিত্ত আছে, মলিন পোশাকের মানুষজন তুলনায় কম। বোকা রিপোর্টার জনে জনে জিজ্ঞেস করছে, আপনারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কীসের জন্য (যেন মদের দোকানের সামনে লোকে দুধ কেনার লাইন দিয়েছে)? একটাই জবাব শোনা যাচ্ছে সকলের মুখে, কেন আবার মদ কিনতে। কোনও জড়তা নেই, আড়ষ্টতা নেই, নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা তো নেই-ই। সকলেরই ভাবখানা এমন যেন মদের দোকানের লাইনে দাঁড়ানোটা মেট্রোর টিকিট কাটার মতোই স্বাভাবিক, দৈনন্দিন ব্যাপার, সব্বাই এক-একজন বোতল ওয়ারিয়ার।

মদ্যপান সম্পর্কে বাঙালির মনোভাবে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সমাজ-বদলের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক। এই পরিবর্তন ভালো না মন্দ সেই বিতর্কে যাচ্ছি না, যে যাঁর নিজস্ব অবস্থান থেকে সেটা বিচার করবেন। বৃহত্তর, অনপনেয় বাস্তব সত্যটি হল চাই বা না চাই, এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করার গা-জোয়ারি দেখানো অর্থহীন। বাঙালি যা ছিল সেটা যেমন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাইনি তেমনি বাঙালি যা হয়েছে তার গুরুত্বও এক ছটাক কম নয়।

আমাদের ছেলেবেলায় মধ্যবিত্ত বাঙালি তিন শ্রেণির লোককে সন্দেহের চোখে দেখত, বলা চলে অপছন্দই করত। যারা শেয়ার বাজারে টাকা খাটায় (চালু কথাটা ছিল ফাটকা বাজার), যারা রেসের মাঠে যায় (ঘোড়া-রোগ) আর যারা মদ্যপান করে। মধ্যবিত্ত গেরস্থ বাড়িতে ‘মদ’ শব্দটি উচ্চারিতই হত না, পাড়ায় দু’একজন মাতাল থাকলে তাদের এড়িয়ে চলাটাই ছিল নিয়ম। যাঁরা মদ্যপান করতেন তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকত, তাঁরা অনেকে অপরাধীর মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াতেন। মদ্যপানের পরে গন্ধ চাপা দেওয়ার চেষ্টাও হত হরেক রকম। কেউ এক খিলি জর্দা পান মুখে পুড়তেন, কেউ পকেট থেকে সেন্টের শিশি বের করে বাড়ি ঢোকার আগে একটু জামায় লাগিয়ে নিতেন। পরিবার এবং সমাজে অভ্যেসের স্বীকৃতি ছিল না বলেই মদ্যপায়ীরা কুন্ঠিত, প্রায়-নির্বাসিত জীবন যাপন করতেন।

এখন সেই স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত সত্য, মদ্যপান তাই আর ‘ট্যাবু’ নেই। অনেক মধ্যবিত্ত-নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়িতে দেখেছি আজকাল বাচ্চার জন্মদিনের আয়োজন মদ্যপান ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, মেয়েরাও তাতে স্বেচ্ছায় শরিক হন। বাঙালি এখন দু’দিন মদ খায়, যেদিন বৃষ্টি পড়ে আর যেদিন পড়ে না। মদ্যপানে বাঙালির চিত্ত এখন সম্পূর্ণ ভয়-শূন্য, বিন্দাস।

চিয়ার্স!

(ছবি ঋণ- ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত)

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article