আনন্দের দিন, বেদনারও
সুমন চট্টোপাধ্যায়
১২৪টা বছর কেটে গেল, ভালো করে খোঁজখবর নিলে আপনি হয়তো এখনও কারও কারও সন্ধান পেতে পারেন যাঁরা মনে করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এঁরা বেশ সংগঠিত ছিলেন, নেতাজির মৃত্যুর কথা শুনলেই রে রে করে তেড়ে আসতেন। বেশ কয়েক বছর আগে নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে তাঁর বাসভবনের অনুষ্ঠানে এসে প্রণব মুখোপাধ্যায় চরম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছিলেন। ভাষণ দিতে দিতে যেই না তাঁর মুখ থেকে ‘মৃত্যু’ শব্দটি নির্গত হয়েছে, পিছনে দাঁড়ানো ভৈরববাহিনী তুমুল হল্লা শুরু করে দিল, সঙ্গে অকথ্য গালাগালি। ভাষণ থামিয়ে প্রণববাবুকে মঞ্চে ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ।
আমার বিড়ম্বনার মঞ্চটি ছিল নেতাজি মৃত্যু রহস্যের কিনারায় তৃতীয়বার নিযুক্ত বিচারপতি মুখোপাধ্যায় কমিশনের কাঠগড়া। আমি বরাবর বিশ্বাস করে এসেছি, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইহোকুর বিমান দুর্ঘনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। টোকিও শহরের অনতিদূরে রেনকোজি মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে এসেছি তাঁর অস্থি-কলসের সামনে, একবার নয়, দু’-দুবার। চোখে ঠুলি পড়ে থাকা ভক্তবৃন্দ এর জন্য আমার বাপ-চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছে, আমি নিজের অবস্থান থেকে এক চুলও সরে আসিনি। আমি মনে করি নেতাজি মৃত এবং ওই বিমান দুর্ঘটনাই এই অসম-সাহসী দেশনায়কের মৃত্যুর একমাত্র কারণ। মর্মান্তিক দুঃসংবাদ কিন্তু সত্য।
আমার কাছে একদিন হঠাৎ সমন এল মুখার্জি কমিশন থেকে। প্রথমে স্থির করেছিলাম, যাবো না, অবজ্ঞা করব। কিছুদিন পরেই এল দ্বিতীয় সমন, অমুক তারিখে, অমুক স্থানে অমুক সময়ে আমাকে সাক্ষ্য দিতে হাজির হতে হবে। এ বার আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিলাম, তাঁরা বললেন বিচারবিভাগীয় কমিশন কাউকে ডাকলে সাড়া দেওয়াটা নাকি বাধ্যতামূলক।ঘোর অনিচ্ছায় আমাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হল। যদিও আমি ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না, আমার সাক্ষ্যের কী মহামূল্য থাকতে পারে। আমার জন্মই তো হয়েছে ওই বিমান দুর্ঘটনার বারো বছর পরে। পূর্বজন্মে নেতাজিকে দেখার বা ওই সময়ে টোকিওয় উপস্থিত থাকার কোনও স্মৃতিও নেই। তাহলে?
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে মহাজাতি সদন সংলগ্ন একটি দালানে তখন কমিশন কাজ করছিল। সময়মতো পৌঁছে ঘরের চারপাশটায় এক ঝলক তাকিয়ে দেখতে পেলাম কয়েকটি পরিচিত মুখ যাঁরা বিমান দুর্ঘটনার সত্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নানা রকম আজগুবি গপ্পো শুনিয়ে বাজার গরম করে কাগজে প্রচার পান। আমাকে দেখতে পেয়ে তাঁদের উজ্জ্বল চোখের ভাষায় আমি একটা মতলবের গন্ধ পেলাম। বুঝলাম আমি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মাত্র বঙ্কিম টিকা-টিপ্পনী শুরু হয়ে যাবে, চেষ্টা হবে বাক্যবাণে আমাকে ক্রমাগত বিদ্ধ করা হবে।
হোক, অবোধের গো-বধে আনন্দ হতেই পারে।
একেবারে গোড়াতে বিচারপতি আমাকে সুযোগ দিলেন আত্মপক্ষ সমর্থন করার। কেন, কীসের ভিত্তিতে আমি তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল বলে বিশ্বাস করি। কারণ ব্যাখ্যা শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাওয়া হলো, আমার কাছে বিমান দুর্ঘটনা বা মৃত্যু সংক্রান্ত কোনও প্রাইমারি এভিডেন্স আছে কি না। সঙ্গে সঙ্গে হল্লা-ব্রিগেডের দিক থেকে ভেসে আসতে থাকল বিষ-মাখানো তীর। হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আমি বললাম প্রাইমারি এভিডন্স নিয়ে কাজ করেন গবেষক-ইতিহাসবিদ, কাগজের সাংবাদিক নন। তাছাড়া মৃত্যুর তত্ত্ব তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এভিডেন্সের ভিত্তিতেই, কিছুটা প্রাইমারি, কিছুটা পারিপার্শ্বিক। বিচারপতির হস্তক্ষেপে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মুরগি করার পরিকল্পিত প্রয়াস আর বেশিক্ষণ চলতে পারল না, কাঠগড়ায় ডাক পড়ল পরের সাক্ষীর।
সেদিনই মালুম হয়েছিল এই কমিশন অশ্বডিম্ব ছাড়া আর কিছু প্রসব করতে পারবে না। কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পরে দেখলাম আমার অনুমান কতটা অভ্রান্ত ছিল। রিপোর্টে নেতাজির মৃতুর কথা স্বীকার করা হলেও বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্ব খারিজ করা হল। অথচ কোথায়, কখন, কী ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল কমিশন সে ব্যাপারে একেবারে নিরুচ্চার রইল। অথচ কমিশন গঠিতই হয়েছিল এই প্রশ্নগুলির কিনারা করতে।
একটা দীর্ঘ সময় ধরে আজগুবি-বাহিনী সুভাষচন্দ্রের বিবাহের ঘটনাকেও অস্বীকার করত। এমেলি শেঙ্কেল যে কোনও দিন ভারতবর্ষে পা রাখেননি তার একটা বড় কারণ ছিল এই বিতর্ক-জনিত অভিমান। ধীরে ধীরে অবশ্য বিয়ের সত্য সন্দেহাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, বিরুদ্ধ চিৎকার ক্ষীণ হতে হতে এক সময় বাতাসে মিলিয়ে যায়। তবু সত্যের উর্ধ্বে সংশয়কে গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত যারা তারা কি পুরোটা বদলায়? বদলানো সম্ভব?
আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। বহু বছর আগে আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে কৃষ্ণা বসু একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ লিখেছিলেন। তার বিষয়বস্তু ছিল এমিলি শেঙ্কলকে লেখা প্রেমিক সুভাষচন্দ্রের একগুচ্ছ চিঠি যা তখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত ছিল। এই জার্মান প্রণয়িনীকে সুভাষ কতটা গভীর ভাবে ভলোবাসতেন তার পরিচয় ছিল চিঠিগুলির ছত্রে ছত্রে।সেই লেখাটির মুখবন্ধে আমি লিখেছিলাম সুভাষচন্দ্র যে এমিলির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন, চিঠিগুলি পড়লেই তা বোঝা যায়। ভোর রাতে অফিসে খবর এল চারদিকে আনন্দবাজারের কপি পোড়ানো হচ্ছে। আমি অফিসেই ছিলাম, গাড়ি নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে গেলাম সরেজমিনে ব্যাপারটা বুঝে আসতে। গিয়ে দেখি স্তুপীকৃত কালো ছাইয়ের ভিতরে ধিক ধিক করে তখনও আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া বের হচ্ছে, জনা কয়েক হকার গোল হয়ে বসে আছে জটলায়। তারাই জানাল, ‘নেতাজিকে নিয়ে নাকি অসভ্য কথা লেখা হয়েছে, এটা তারই প্রতিবাদ।’ আরও জানতে পারলাম কাগজের ভ্যান স্টেশন চত্বরে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ পরেই একদল লোক চড়াও হয়ে হকারদের কাছ থেকে কাগজের বান্ডিলগুলো কেড়ে নেয়, তাদের হাতে ছিল কেরোসিনের জ্যারিকেন, বহ্নুৎসব শুরু হয়ে যায়।
অসভ্য কথাটি বেলা গড়ালে জানতে পারা গেল। প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া। এটা নেতাজির অপমান যা কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। গপ্পের সার কথা সুভাষচন্দ্র প্রেমে পড়ে থাকতে পারেন, তাই বলে হাবুডুবু খাবেন? এটা কখনও তাঁর সম্পর্কে লেখা যায়?
আজ ২৩ জানুয়ারি, নেতাজির জন্মোৎসব। এ নিয়ে আমার অসংখ্য সুখস্মৃতি আছে যার কথা লিখব পরে। আজ শুধু এইটুকুই বলার যে এই দিনটি এলে আমার মনটা পুরোনো ব্যথায় বিবশ হয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পঁচাত্তর বছর দরজায় কড়া নাড়ছে অথচ আজ পর্যন্ত এই আত্মত্যাগী, দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিকের একটা স্মৃতিসৌধ দিল্লিতে তৈরি করা গেল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইংরেজ তাঁকে গ্রেপ্তার করার, পারলে নিকেশ করার অনেক পরিকল্পনা করেছিল, সফল হয়নি। সেই দেশনায়ক মৃত্যুর পরে পণবন্দি হয়ে রইলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন উন্মার্গগামীর হাতে। পরাক্রমশালী ভারত রাষ্ট্রের ক্ষমতা হল না এই সামান্য প্রতিবন্ধককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সুভাষচন্দ্রের চিতভস্ম স-গৌরবে দেশে ফেরত আনার। কে ঘোচাবে বলো জননীর এই লাজ?