সুমন চট্টোপাধ্যায়
প্রথম দিন বরকত সাহেব তো আমাকে ওঁর ঘর থেকে বেরই করে দিলেন। বললেন, ‘ওমুকে (আমি ইচ্ছে করেই নামটা নিচ্ছি না) বলেছে আপনের সঙ্গে আমি যেন কোনও কথা না বলি, যা বলব সব প্রিয় জেনে যাবে।’ প্রায় একই অভিজ্ঞতা হল সন্তোষমোহন দেবের অফিসে গিয়ে। যিনি তখন অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রিয়র কাছে গো-হারান হেরেছিলেন। ‘হোয়াই শুড আই টক টু প্রিয়’জ স্পাই’, ঠোঁটের ফাঁকে জ্বলন্ত পাইপটা রেখেই শিলচরি উচ্চারণে সন্তোষমোহন এই মন্তব্য করেছিলেন। আমার কিছুটা ডিমোশন হল, ‘প্রিয়র লোক’ থেকে ‘প্রিয়র চর’ হলাম। দুঁদে রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ই একমাত্র যাঁর মুখের রেখা বা শরীরের ভাষা দেখে বোঝা গেল না, তিনি আমাকে কী চোখে দেখছেন। অবশ্য প্রণববাবুর তখন শিয়রে সংক্রান্তি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন, কমলাপতি ত্রিপাঠিকে সামনে রেখে তৈরি করছেন রাজীব বিরোধী চক্র। আমি কার লোক তা নিয়ে দুর্ভাবনা করার প্রয়োজনই তাঁর ছিল না। সময়ও নয়।
১৯৮৭-র রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে আমাকে দেগে দেওয়ার খেলাটি বেশ জমজমাট হয়ে উঠল। তখন আমি রাজীব গান্ধীর সঙ্গে ঘনঘন পশ্চিমবঙ্গ সফরে যাচ্ছি, আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় সে সব রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে, ভোটের উত্তাপ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। গণশক্তিতে খবর বের হল, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি নাকি কয়েকজন পেটোয়া সাংবাদিককে কালার টি ভি উপহার দিয়েছেন। তার কিছুকাল আগে রঙিন টিভি বাজারে এসেছে, নতুন স্ট্যাটাস সিম্বল। গণশক্তির খবর আমার শত্রু শিবিরকে নতুন করে চাঙ্গা করে তুলল, ফিস ফাস-ফুশ ফাশ প্রধানত আমাকে নিয়েই। আমার বাড়িতে তখনও সোনোডাইনের সাদা-কালো টিভি, বদলি হওয়ার সময় যেটি আমার সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিল রাজধানী এক্সপ্রেসের চেয়ার কারে। তাতে কী, সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে সেটা তো আর কুৎসা হয় না, আর জমিয়ে কুৎসা না করলে যে গায়ের জ্বালাও মেটে না। তারপর থেকে কুৎসা আর আমার পিছু ছাড়েনি। গোড়ার দিকে বেদম রাগ হতো, রক্তচাপ বাড়ত, তারপর অভীক সরকারের কাছ থেকে একটি দুর্মূল্য টোটকা পাওয়ার পরে শিখে গেলাম কী ভাবে কুৎসার মোকাবিলা করতে হয়।
টেক ইট অ্যাজ এন্টারটেইনমেন্ট। অপমানের পথের মাঝে নিত্য বীণা বাজিয়ে যাওয়াই আমার ভবিতব্য।
৮৭-র বিধানসভা ভোট কভার করতে আমাকে দিল্লি থেকে কলকাতায় ডেকে পাঠানো হল। বলা হল, পশ্চিম দিনাজপুরে যেতে হবে। এ জেলা উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়েছে তার অনেক পরে, নাম বদলের ঘটনাও তখনই। বালুরঘাট আমার শ্বশুরবাড়ি, তল্লাটটা কিছুটা চেনা ছিল। তার চেয়েও বড় কথা পশ্চিম দিনাজপুর ছিল প্রিয়বাবুর নিজের জেলা, কালিয়াগঞ্জে দাশমুন্সি পরিবারের বসত ভিটে। কেউ আমাকে মুখ ফুটে বলেনি, আমি অনুমান করলাম প্রিয়বাবুর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা ভেবেই সম্ভবত আমাকে তাঁর জেলায় পাঠানো হচ্ছে। আমি লিখলে সে লেখা নিশ্চয়ই প্রিয় এবং কংগ্রেসের অনকূলে যাবে।
আমি বালুরঘাটে ঘাঁটি গেড়ে তিন দিন ধরে গোটা জেলায় চর্কি কাটলাম গাড়িতে চড়ে। প্রিয়বাবুর সঙ্গে দেখাই করলাম না। যেখানে যাই সেখানেই দেখি কংগ্রেসের তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, প্রিয়বাবু বেছে বেছে এমন সব অনুগামীকে টিকিট দিয়েছেন যাঁরা তাঁর সঙ্গে কংগ্রেস (স) করতেন, অনেকেই অজ্ঞাতকুলশীল, সংগঠনে ব্রাত্য, জনতার মাঝে তেমন পরিচিতিই নেই। তার ১০ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার কায়েম হয়েছে কিন্তু পশ্চিম দিনাজপুর রয়ে গিয়েছে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হয়েই। জেলায় তখন ছিল মোট ১২টি আসন, ৮২-র বিধানসভা ভোটে তার মধ্যে সাতটিই জিতেছিল কংগ্রেস।
কলকাতায় ফিরে আমি রিপোর্ট লিখলাম, এ বার পশ্চিম দিনাজপুরে কংগ্রেস একটি আসনও জিততে পারবে না আর সেই বিপর্যয়ের খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হবেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। তাঁদের প্রত্যাশা বুমেরাং হয়েছে দেখে আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ সেই রিপোর্ট অনেক দিন ধামাচাপা দিয়ে রাখার পরে ঠিক ভোটের দিন ভিতরের পাতায় সেটি ছেপেছিল। সেই কাগজ পশ্চিম দিনাজপুরে পৌঁছেছিল ভোটের পরের দিন।
তার পরেও নানা ঘটনায় প্রিয়বাবুকে আমি রেয়াৎ করতে পারিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের চুক্তি ভেঙে প্রিয়বাবু পরবর্তী একটি লোকসভা ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী সৌগত রায়ের হয়ে প্রচার করতে এসেছিলেন। পরের দিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় আমার রিপোর্টে লিখেছিলাম, ‘সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় রাজনীতিতে কী ভাবে মিথ্যাচার করতে হয় তা শেখার জন্য শিক্ষানবিশদের উচিত প্রিয়বাবুর পাঠশালায় ভর্তি হওয়া।’ উত্তর কলকাতার এক প্রয়াত কংগ্রেস নেতা রসিকতা করে বলতেন, ‘প্রিয়দা যদি বলেন, আজ বিকেলে পাঁচটার বিমানে আমি দিল্লি যাব, আমি তাহলে অপেক্ষা করব রাজধানী এক্সপ্রেসের সামনে।’ কোনও একটি লেখায় আমি এই রসিকতাটিও উদ্ধৃত করেছিলাম।
ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য প্রিয়বাবুর সঙ্গে আমার একবারে ভিন্নমার্গের ছিল, আমরা এক মায়ের পেটের দাদা-ভাইটুকু ছিলাম না এই যা। আমার রিপোর্টারির দিনগুলোয় প্রিয়বাবুর অবদান আমি অস্বীকার করতে পারব না, সেটা চরম কৃতঘ্নতা হবে। প্রিয়বাবুর সৌজন্যে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতে পেরেছি, তিন-তিনটে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে পেয়েছি, দৈনন্দিন ভাবে পেয়েছি আরও অগুন্তি খবর। দিল্লিতে আমার কন্যার হাতেখড়ি হয়েছিল প্রিয়বাবুর বাড়ির সরস্বতী পুজোয়। তেমনি আমি আবার প্রিয়বাবুর বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলাম। তখন প্রতি বছর মহালয়ার দিনে কলামন্দিরে দক্ষিণীবার্তার জমজমাট বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো, সেখানে অসংখ্য গুণীজন সম্মানিত হয়েছেন। একবার প্রিয়বাবু আমাকেও সংবর্ধনা দেবেন বলে মনস্থ করলেন, নাম ছাপা হয়ে গেল, উপহারও মজুত, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত গেলাম না। আমার মনে হয়েছিল, আমি যে পদে চাকরি করি সেখানে থেকে কোনও রাজনৈতিক নেতার হাত থেকে সংবর্ধনা নেওয়াটা উচিত হবে না। আমি মুখ ফুটে এ কথা বলতে পারব না বলে অভীকবাবুর শরণাপন্ন হলাম, তিনিই প্রিয়বাবুকে ফোন করে গোটা বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন।
প্রিয়বাবুর চেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক আমার অন্য কোনও রাজনীতিকের সঙ্গে কদাচ ছিল না, হবেও না। তবু ব্যক্তিগত ভালোবাসার সঙ্গে পেশাগত দায়বদ্ধতার যখনই সংঘাত লেগেছে আমি দ্বিতীয়টিকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছি। মানে না দিয়ে পারিনি। ফলস্বরূপ সম্পর্ক বারেবারে টোল খেয়েছে আবার সময় গেলে পুরোনো জায়গায় ফিরে এসেছে। তখন রাজনীতিকরা আজকের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল ছিলেন, সমালোচনাকে শত্রুতা মনে করতেন না, টেলিফোন ট্যাপিং করা, পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া তো দূরস্থান। খুব অতিষ্ঠবোধ করলে বড়জোর মালিককে ফোন করে সবিনয়ে অনুযোগ করা, এই রিপোর্টারটিকে একটু সংযত হতে বলুন। অভীক সরকারের মতো সম্পাদকের অধীনে কাজ করার মজাটা ছিল ফোনে অনুযোগ শুনেই তিনি তা বেমালুম ভুলে যেতেন। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার পর্যন্ত বিষয়টি পৌঁছতই না।
ভবি তবু ভুলেছিল কী? আড়ালে আবডালে আমাকে প্রিয়র লোক বলাটা কি বন্ধ হয়েছিল? না। কেন? অন্যকে দেগে না দিলে নিজের অপরাধবোধ লাঘব হবে কী করে?