কাগজহীন আমার জীবন
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ঋতবান মুখোপাধ্যায়, আমার দীর্ঘদিনের অনুজ সহকর্মী, বিশেষ স্নেহভাজন। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম সে একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পাঠিয়েছে, ‘খবরের সঙ্গে সাড়ে তিন দশক ধরে লেপ্টে ছিলে। সেই তুমি নাকি এখন কাগজই পড়ো না। নিশ্চয়ই টিভি-ও দেখো না। যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশিদিন ঘর করলে তাকে ছাড়া কাটানোর অনুভূতিটা জানতে ইচ্ছে করে। যদি এটা নিয়ে লেখো…’।
প্রথমেই একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ শুনিয়ে রাখা প্রয়োজন।আমি বাংলা কাগজ পড়ি না আর বাংলা টেলিভিশন দেখি না, তা সে খবর বা বিনোদন যাই হোক না কেন।তার মানে এই নয় খবর থেকে আমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বা খবরে আমার আর কোনও রুচি নেই। হাতের মোবাইল যন্ত্রটি শহর, রাজ্য, দেশ, বিদেশ বলতে গেলে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আমার সেতুবন্ধনের কাজ করে, যখন যেটা জানতে ইচ্ছে করে বা না চাইলেও স্ক্রিনের ওপর এসে লুটিয়ে পড়ে, আমি সেটা জেনে নিই, অনেক সময় জেনে সমৃদ্ধও হই।
এর পরে আরও একটি স্বীকারোক্তি জুড়ে দেওয়া প্রয়োজন। নিজের কাছে পণ করেছি, আমার লম্বা শত্রুর তালিকায় আমি সচেতন ভাবে আর একটি নতুন নামও সংযোজিত হতে দেব না। বরং আমি আপাতত শত্রুদের মিত্রে পরিণত করার মন্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি যত্রতত্র, জীবনের বাকি কয়েকটি দিনে সেটাই আমার অন্যতম লক্ষ্য। আপনাদের কারও যদি এই কৃৎ-কৌশল জানা থাকে, দয়া করে আমাকে জানাবেন, আমি চির-কৃতজ্ঞ থাকব।বসুমতী কী কুক্ষণে এই ধরাধামে আমাকে ডেকে এনেছিল যাওয়ার আগে তার উত্তর আমার জানা হবে না, সে কথা মানি। কিন্তু যাবতীয় বিরোধ, ঈর্ষা, শত্রুতা আর সঙ্ঘাতগুলিতে চূড়ান্ত যতি-চিহ্ন টেনে না যেতে পারলে আমি পরপারে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াব, সেটা মোটেই কোনও কাজের কথা হবে না।
সেই লক্ষ্যে অবিচল থাকতে আমি স্বেচ্ছায় অনেক কিছু প্রিয় জিনিস ত্যাগ করে নিজের বাড়ির এক কোণে স্বেচ্ছা-নির্বাসিতের মতো দিনযাপন করছি। বোবার শত্রু থাকে না সবাই জানি, আমার বিশ্বাস, ক্ষমতা কিংবা প্রচারের বলয় থেকে আমার মতো কোনও বেয়াড়া বুড়ো যদি নিজেকে সরিয়ে রাখে, তারও মনোস্কামনা পূর্ণ হতে বাধ্য। আমি আর শত্রুতা যেমন চাই না, তেমনি অনুকম্পাও নয়। নতুন পরীক্ষায় বাকি জীবনটাকে অর্থবহ করে তোলাই এখন আমার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অতএব ঋতবানের অনুরোধ আমি রক্ষা করছি প্ররোচনাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে। অকপটে জানিয়ে দিচ্ছি ন্যাড়া আর বেলতলায় যাবে না কিছুতেই।
আমার এক বন্ধু একদা বলেছিল, কোনও কাজ বিরতিহীন ভাবে টানা ২১ দিন করে যেতে পারলে সেটা ‘অভ্যাসে’ পরিণত হয়ে যায়। মানে ধরুন, আপনি যদি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন, ২১ দিন পরে দেখবেন আর ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না, যত রাত্তিরেই শুতে যান না কেন, ভোর পাঁচটায় ঠিক নিদ্রাভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। বছর ঘুরতে চলল, আমি কোনও বাংলা খবরের কাগজ পড়িনি, কোনও বাংলা টেলিভিশনও দেখিনি। তার মানে আমার ক্ষেত্রে এটা কেবলমাত্র মামুলি অভ্যেস নয়, বলতে গেলে আমার অস্থি-মজ্জায় মিশে গিয়ে প্রায় ডিএনএ-তে প্রবেশ করে গিয়েছে।
এই অভ্যেস বেদনার না আনন্দের সেই বিতর্কে প্রবেশ না করাই ভালো কেননা পার্থিব সব বিচ্ছেদের অন্তরালেই কয়েক ফোঁটা অশ্রুবারি থাকে। বাংলা খবর, খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনের সঙ্গে আমার বিবাহ-বন্ধনের সময়কাল অনেকটাই, প্রায় চারটি দশক।আমার ক্ষেত্রে এই বিচ্ছেদের পরিণতি কী হয়ে থাকতে পারে তার বিশদ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। সমঝদারোকে কে লিয়ে ইশারাহি কাফি হোতা হ্যায়। হ্যায় না?
সকালের তাজা খবরেরর কাগজের মন মাতানো সুঘ্রাণ আছে। প্রথম যৌবনে নাইট ডিউটি শেষ করে ভোরে বাড়ি ফেরার সময় অনেক দিনই আমি ছাপাখানার সামনে হকারদের কলকাকলির মাঝে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই ঘ্রাণ নিতাম, বড্ড ভালো লাগত তখন, সেই গন্ধে কেমন একটা মাদকতাও ছিল। নিউজপ্রিন্টের সেই গন্ধ আমার এখনও নাকে লেগে আছে, থাকবেও বোধহয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই সেদিন পর্যন্ত আমার বাড়িতে ছয়-সাতটা খবরের কাগজ আসত, এখন একটিও আসে না। ফলে কাগজের ঘ্রাণ নেওয়ার প্রাত্যহিক অভ্যাসটি আর নেই। এই করোনা-কবলিত কালে মারাত্মক ভাইরাসের ছোবলে যখন অসংখ্য মানুষের ঘ্রাণ কিংবা স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতটাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, মাসের পর মাস কেটে গেলেও আর ফিরে আসছে না তখন আমার এই স্বেচ্ছা-বঞ্চনার গুরুত্ব একেবারেই অকিঞ্চিৎকর।
কথাটা শুনে আপনারা হয়তো হাসবেন, ভাববেন আমি মস্করা করছি, কিন্তু বিষয়টি আদপেই তা নয়। খবরের কাগজ পড়া মানেই খরচ, অনেকগুলি কাগজ একসঙ্গে রাখার খরচ আরও অনেক। আমি এখন কর্মহীন, নিয়মিত আয় নেই, হয়তো আর কোনও দিনই থাকবে না। ফলে আমাকে আমার মতো করে মিতব্যয়িতার প্রয়োজনটিও মাথায় রাখতে হচ্ছে।যা কিছু না থাকলেও চলে, একে একে তার অনেক কিছুই আমি বর্জন করছি সাশ্রয়ের তাগিদে। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি, বাড়িতেই থাকি বলে গাড়ির তেলের খরচও কমেছে ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। নিয়তি আজ আমাকে এমন অবস্থার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেখানে শ্যাম এবং কূল দুটো রক্ষা করা আর সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ওষুধ কিনব না খবরের কাগজ এই দ্বিধার মধ্যে অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে প্রথমটি। এমনও দিন আসতে পারে আমি কখনও দুঃস্বপ্নেও তা ভাবিনি। এসেছে যখন, তাকে সহজ ভাবে মেনে নিতেও আমার কোনও ক্লেশবোধ হচ্ছে না। আমি মাস্টারমশায়ের পুত্র, সোনা-রুপো-ব্রোঞ্জ-প্ল্যাটিনাম কোনও ধাতুরই চামচ মুখে জন্মাইনি, ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবনের অনেকটা সময় কেটেছে হিসেবি জীবনযাপনের মধ্যেই। সেই জীবনটা ফিরে পেয়ে খারাপ লাগছে না, অতীত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে আমার রক্ষায়।
আরও একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দেয় মাঝেমাঝে। ঋতবানের ভাষায় আমি যদি এত দীর্ঘকাল খবরের সঙ্গে ‘লেপ্টে’ না থাকতাম তাহলে বোধহয় আজকের এই বৈরাগ্য হত না। একই কাজ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর করে গেলে একঘেয়েমি তো লাগেই, খবরের ক্ষেত্রেও লাগে। তাছাড়া আমি তো জানি কোন বাংলা কাগজ বা খবরের চ্যানেল কেন, কীসের তাগিদে কোন খবরটাকে গুরুত্ব দেয় আর কোনটাকে সচেতন ভাবে অবজ্ঞা করে। এই ‘পোস্ট-ট্রুথ’-এর জমানায়, খবর এখন একেবারে ‘প্রেডিকটেবল’, তথ্য হয়তো আছে, প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে সত্যের অণ্বেষণ। আমি নিজেও এই দোষের সমান ভাগিদার, গতকাল পর্যন্ত রত্নাকর থেকে আজ নিজেকে বাল্মীকি বলে জাহির করতে চাই না। বরং খবরের কাগজ চালাতে গিয়ে দৈনন্দিন ভাবে আমাকে যে গ্লানি, অপমান আর অপরাধবোধের শিকার হতে হয়েছে, জীবনের অন্তিম চরণে এসে আমি তা ভুলে যেতে চাই। কাগজ মানেই আমার কাছে আতঙ্কের স্মৃতি, আত্ম-অবমানার গভীর অতলে ফের অবগাহন। আমার ক্ষেত্রে বাংলা কাগজ না পড়াটা অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্টের কাজ করে, স্নায়ু আর কত বাড়তি চাপ নিতে পারে বলুন তো!
লঘু ছন্দে শেষ করা যাক এই বৃত্তান্ত। আমরা সবাই জানি, বিলক্ষণ বুঝি, আজকের ডিজিটাল বিশ্বে, ওয়েব শাসিত দুনিয়ায় সাবেক খবরের কাগজ বা চ্যানেলের আয়ু আর খুব বেশিদিন নয়। খবরের কাগজ এখন সূর্যাস্তের শিল্প, অস্তে যাওয়ার প্রাক-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। আমি সেই অমোঘ ভবিতব্যকে না হয় একটু আগেই মেনে নিয়েছি, কাগজহীন দৈনন্দিন জীবনে নিজেকে রপ্ত করে নিচ্ছি একটু একটু করে।