এক জন্ম-বিদ্রোহীর উপাখ্যান
সুমন চট্টোপাধ্যায়
১৭ বছর বয়স থেকে আমি তাঁকে ‘দাদু’ নামে ডাকি। আমি জানি এই নামে চট করে আপনারা তাঁকে চিনবেন না। চেনার কথাও নয়। যদি না আপনি সাতের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হয়ে থাকেন বা ওই সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে আপনার আনাগোনা থেকে থাকে। তাহলে হয়ত আপনি মাথা চুলকোতে শুরু করবেন, মনে হবে নামটা পেটে আসছে, মনে আসছে না।
অথচ আমি যদি তাঁর ভালো নামটা বলি আপনারা ‘চিনি গো চিনি তোমারে’ গাইতে শুরু করে দেবেন। আর হেঁয়ালি করছি না, আপনাদের রক্তচাপও বাড়াচ্ছি না, ঝোলা থেকে বেড়াল এবার বের করে দিচ্ছি।
অরুণাভ ঘোষ। হাইকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, এখনও কংগ্রেস করেন। মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মুখ নিঃসৃত অগ্নিবাণে বিদ্ধ হচ্ছেন প্রতি নিয়ত। কাউকেই তিনি রেয়াত করেন না, যা মনে আসে সেটাই বলে ফেলেন, এমনকি হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতিকেও তিনি আইনের পাঠ দিতে পারেন প্রকাশ্যে। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, ‘দাদু’ ছুঁলে ছত্রিশ।
দাদু কিন্তু অরুণাভর ডাক নাম নয়। কোনও বাবা-মা সজ্ঞানে পুত্রের নাম দাদু রাখতে পারেন না। এই নাম তিনি অর্জন করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্যান্টিনে, নামটি কে দিয়েছিল এতদিন পরে আর সে কথা মনে নেই, কেন দিয়েছিল তা মনে আছে বিলক্ষণ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কলেজের বন্ধুরা তাঁকে দাদু নামেই ডাকতে অভ্যস্ত। আমি যে কত জায়গায় তাঁকে এই নামে সম্বোধন করে লজ্জা পেয়েছি আর তাঁকে লজ্জায় ফেলেছি বলার নয়। ঠিক আছে দাদু নামই সই, তাই বলে কি হাটে হাঁড়ি ভাঙতে আছে? করবটা কী, প্রায় অর্ধ শতকের অভ্যেস কি স্থান-কাল-পাত্র বুঝে ভুলে যাওয়া যায়?
আমার ধারণা তাঁর বুড়োটে স্বভাব আজন্ম। কলেজে আমরা যখন কলাবাগানের চুল্লু ক্যান্টিনের কেটলিতে করে এনে মৌজ-মস্তি করছি, টেবিল চাপড়ে সমবেত বেসুরো গলায় হিট হিন্দি গান গাওয়ার চেষ্টা করছি, দাদুকে সেই মজলিসে পাওয়ার জো নেই। এইসব তরল-গরল সে তো জিভে স্পর্শ করবেই না, স্ট্যাচুর মতো বসে থাকবে মাতালদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে। তবে গান গাওয়ার অনুরোধ জানালে দাদু সচরাচর তা প্রত্যাখ্যান করত না। নিজেই টেবিল বাজিয়ে নির্ভুল সুরে নিচু লয়ে গেয়ে উঠত ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে’। আমরা ছাত্র পরিষদ করতাম বাড়তি মজার জন্য। কিন্তু দাদু অষ্টপ্রহর কংগ্রেসি, আপাদমস্তক জাতীয়তাবাদী, বার্ট্রান্ড রাসেল ভক্ত দেশপ্রেমিক। দাদুকে ভেঙচে আমরা গাইতাম ‘ও ভাই রে ভাই, তোর মতো আর দেশপ্রেমিক নাই।’
মদে ঘোর অরুচি, ধূমপানেও। দাদুর জিগরি দোস্ত সোমক রায় (সৌগত রায়ের ছোট ভাই) ছিল কলেজে নেশুড়ে নাম্বার ওয়ান। চুল্লুর পরে সোমকদা খুব যত্ন করে পকেট থেকে একটা চরসের গুলি বার করত, দেশলাই জেলে সেটা মন দিয়ে পোড়াত, তারপর সিগারেট ডলতে ডলতে পুরো তামাকটা বের করে বাঁ হাতের তালুতে রেখে জ্বলে যাওয়া চরসের গোলাটাকে সেই তামাকের মধ্যে গুঁড়ো করে আবার ডলত কিছুক্ষণ, তারপর তামাকে-চরসে মাখামাখি হয়ে গেলে ফের সেটাকে অতি সন্তর্পনে ধীরে ধীরে ফাঁকা সিগারেটের খোলে চালান করে দিত। সোমকদা এত যত্ন আর মমতার সঙ্গে গোটা পর্বটা সাঙ্গ করত, মনে হতো সালভোদার দালি যেন তুলি হাতে ক্যানভাসে এঁকে চলেছেন এক মনে। তারপর সেই চরস ভর্তি সিগারেট ওষ্ঠ থেকে ওষ্ঠে পাক খেত সূর্যের চারপাশে পৃথিবী হয়ে। প্রায়শই সেই নেশাখোরদের দঙ্গলে দাদুও বসে থাকত। কেউ যদি হিম্মত করে একবার বলে উঠত, ’দাদু একটা টান মারলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে’ তার কপালে কাঁচা খিস্তি একবারে অবধারিত ছিল, ’বাঞ্চোদ ছেলে যা তোর বাপকে টানতে বল।”
গোঁড়াদের চূড়োমণি দাদু তবু তাঁর মধ্যে অদ্ভুত নেতৃগুণ ছিল। আর ছিল দুর্জয় সাহস আর একটা ব্লাস্ট ফার্নেসের আগুনের মতো গনগনে বিদ্রোহী মন। কংগ্রেসে যখন সঞ্জয় গান্ধী বনাম প্রিয়রঞ্জনের দ্বৈরথ শুরু হল, দাদুর নেতৃত্বে কলেজের প্রায় সবাই ইন্দিরা পুত্রের বিপক্ষে। জরুরি অবস্থার সময় সঞ্জয় যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন কলেজ স্ট্রিট দিয়ে চামচাদের বিশাল মিছিল নিয়ে দাদুর নেতৃত্বে আমারা ক’জন কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে তাঁকে কালো পতাকা দেখিয়ে দিলাম। আমি যে একটু আধটু চটকদার বাংলা লিখতে পারি দাদুই সেটা প্রথম আবিষ্কার করে প্রায় সব বিষয়ে আমাকে দিয়ে লেখাত, কখনও দক্ষিণী বার্তায়, কখনও কলেজের লিফলেট কখনও আবার প্রেসিডেন্সিয়ান পত্রিকায়। সে সময় দাদু আর আমিই লেখা জোগাড় করতে অনেকের দরজায় কড়া নেড়েছি, হাসপাতালে গিয়েছি চোরাগোপ্তা গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। কলেজে দাদুর প্রিয় নাতির সংখ্যা খুব কমছিল না, তার মধ্যে কী ভাবে যেন আমিও ঢুকে পড়েছিলাম। অরুণাভ ঘোষ আমার জীবনের একমাত্র নেতা, এখনও।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বিশদে বলছি না। কেবল এইটুকু বলি দাদুর মা অর্চনা সেনগুপ্ত আমায় সন্তান স্নেহ করতেন, যখনই ওঁদের বাড়ি গিয়েছি কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে ছাড়েননি। দাদুরা যখন মানিকতলা হাউসিং এস্টেটে সরকারি ফ্ল্যাটে থাকত কাজে অকাজে আমি প্রায়ই সেখানে ঢুঁ মারতাম। তখন ওদের বাড়ির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল একটি নধরকান্তি পেল্লাই সাইজের গোল্ডেন রিট্রিভার, তার নাম ছিল সম্রাট। তার চলাফেরায় এক ধরনের রাজকীয় আভিজাত্য ছিল, কেউ কলিং বেল বাজালে দৌড়ে চলে আসত দরজার পিছনে। অপরিচিত কেউ হলে সমুদ্র গর্জন, না হলে আদিখ্যেতা করে লেজ নাড়া। সম্রাট আমার ন্যাওটা ছিল, আমি গলকম্বলে সুড়সুড়ি দিলেই সে বেজায় খুশি। তারপর আমি যে চেয়ারে বসতাম তার তলায় বাবু চিত্তির হয়ে শুয়ে পড়ত।তখন সে আর সম্রাট নয় আমার পুরাতন ভৃত্য।
এহেন সম্রাট একদিন দাদুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় আড়াআড়ি ভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিল-চিৎকার শুরু করে দিল। কারও ডাকেই সে আর সাড়া দেয় না, বিস্কুটের লোভ দিয়েও ফল মেলে না। দাদু হঠাৎ আমাকে বলল, ’কিছু মনে করিস না, তুই কি ভুল করে এ বাড়ির কোনও কিছু নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিস?’ পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি দেশলাইয়ের সন্ধান পেলাম যেটা আমি বিড়ি ধরাব বলে দাদুদের রান্নাঘর থেকে চেয়ে এনেছিলাম। সেই দেশলাই দাদুর হাতে তুলে দিতেই সম্রাট পথ ছেড়ে দিল, তারপর এক ছুটে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। সম্ভবত আমার মতো পরিচিত অভ্যাগতকে বেইজ্জত করার লজ্জায়।
কলেজ স্ট্রিটের পালা সাঙ্গ করার পরে অনেক বছর দাদুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। ৮৫-র মে মাসে আমি দিল্লিতে বদলি হওয়ার অব্যবহিত পরে একদিন নেতার ফোন পেলাম, ”শোন আমি ওমুক তারিখে দিল্লিতে আসছি, তোর বাড়িতে উঠব”। বলেই ফোনটা কেটে দিল, আমার সুবিধে-অসুবিধের কথা জানতে চাইল না, কেন আসছে, কতদিন থাকবে তাও বলল না, মানে তোয়াক্কাই করল না। নেতা আসবে চ্যালার বাড়ি, সে এত কৈফিয়ৎ দিতে যাবে কোন দুঃখে?’
আমার দিল্লির গুলমোহর পার্কের বাড়ি তখন গড়ের মাঠ, ন্যূনতম আসবাবপত্রটুকুও নেই। অতিথি এলে তাঁকে শুতে দেওয়ার মতো ভদ্রস্থ একখানা খাটও নেই, আছে সবেধন নীলমনি একটা ফোল্ডিং খাট। আমার খুবই অপ্রস্তুত লাগছিল, দাদু এমন ভাব দেখাল যেন আমি ভাঁট বকছি। যে ক’দিন দাদু ছিল আমি তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসতাম, তারপর মধ্যরাত্রি পার করে দু’জনের নরক গুলজার।
তার বছর দুয়েক আগেই বাংলার সব ইন্দিরা বিরোধীরা মাথা মুড়িয়ে কংগ্রেসে ফিরে গেছেন। দাদু ফেরেনি। সে তখনও শিবরাত্রির সলতের মতো রয়ে গিয়েছে কংগ্রেস (স) তে, কেরলের সাংসদ, সুবক্তা, উন্নিকৃষ্ণণ তখন সেই দলের সভাপতি। দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে যোগ দিতেই দাদু সে যাত্রায় দিল্লি এসেছে। জাঙ্গিয়ার আবার বুক পকেট।
আমি দাদুকে গাল দিলাম, তার গোয়ার্তুমিকে নানা ভাবে কটাক্ষ করলাম, সে গায়েই মাখল না। বললাম চলো আমি তোমাকে প্রিয়দার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, দাদু আমার প্রস্তাবে কর্ণপাতই করল না। উল্টে বলল, ’যে ইন্দিরা গান্ধীকে এত গাল দিয়েছি, দেশের সব ক’টি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে যিনি একা হাতে ধ্বংস করেছেন, আমি তাঁর দলে ফিরতে পারব না। রাজনীতি করব না তাও সই। তুই তো জানিস টাকার জন্য আমার রাজনীতি করার কোনও প্রয়োজন নেই, ওকালতি করে দিব্যি আছি।’
দাদুর সেই ‘স্পিরিট’টা রয়ে গিয়েছে এখনও, ভায়া তৃণমূল কংগ্রেসে ফেরার পরেও। অরুণাভ ঘোষ এই পয়দাখোর, লাজলজ্জাহীন, তোলাবাজ রাজনীতিকদের মধ্যে এমন একজন দুর্লভ পাগলা দাশু যাকে আপনি কোনও প্রলোভনে বশ করতে পারবেন না, চমকে-চামকে পুলিশ-গোয়েন্দার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করাতে পারবেন না। যা বলার তিনি বলবেনই, জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র। দাদু হেরোর দলের হিরো, তাতেই তার পরম পাওয়া। এক জন্ম-বিদ্রোহী যাঁকে ছুঁতে কায়েমী স্বার্থ ভয় পায়, মহামহিম বিচারপতিরাও সমঝে চলেন। এই বাংলায় এই মুহূর্তে ঘরে ঘরে একজন করে দাদু প্রয়োজন।
অরুণাভ ঘোষ আমার দাদা, আমার বন্ধু এ কথা ভাবলেও আমার গর্ব হয়। এই কথাটা মুখ ফুটে দাদুকে কখনও জানানো হয়নি, আজ লেখার অক্ষরে জানিয়ে রাখলাম।