সুমন চট্টোপাধ্যায়
‘ঠাকুর তোমায় কে চিনত, না চেনালে অচিন্ত্য?’
পরিহাসছলে শিবরাম চক্রবর্তী এ কথা বলেছিলেন। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন রামকৃষ্ণ ভক্ত। তাঁর পরমপুরুষ শ্রী রামকৃষ্ণ একটি অতিমূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। এটাও বড় কথা নয় যে ঠাকুরের ভুবনজোড়া মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ার জন্য একজন ভক্ত অচিন্ত্যের প্রয়োজন ছিল। শিবরাম আপাদমস্তক রসিক মানুষ। এই উক্তি সেই রসে সিঞ্চিত।
রামকৃষ্ণের প্রয়োজন না হলেও অনেকেরই একজন ‘অচিন্ত্যর’ প্রয়োজন হয়। নির্মম মহাকালের রথের চাকার তলায় প্রতি মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে মানুষের অনেক মহান, পথপ্রদর্শক, প্রতিভাধর, গুণী মানুষকেও আর সদাব্যস্ত, অকৃতজ্ঞ ভাবীকাল আর মনে রাখছে না। তাঁদের অনেকের জন্ম-শতবার্ষিকী কেটে যাচ্ছে এক্কেবারে অগোচরে, নীরবে, নিভৃতে, শ্মশানের নিঃস্তবদ্ধতায়।
সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসা যাবে। দু-একটি জীবৎকালেই অন্ধকারে পড়ে থাকার উদাহরণ দেওয়া যাক।
এই দুনিয়ায় এমন অনেক যশস্বী মানুষ আছেন, বেঁচে থাকতে যাঁরা কার্যত কোনও স্বীকৃতিই পাননি। একজিসটেনশিয়ালিজমের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিধর প্রবক্তা হিসেবে দুনিয়া যাঁকে জানে সেই ফ্রানৎজ কাফকার বই তাঁর জীবদ্দশায় কোনও প্রকাশক ছাপতে চাইতেন না। এক সময় কাফকার টিবি হল, তিনি খাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললেন। অন্তিম শয্যায় শুয়ে পরম সুহৃদ ম্যাক্স ব্রডকে কাফকা বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁর সব পাণ্ডুলিপি যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। বন্ধুটি সেই অনুরোধ শিরোধার্য করেননি বলে কাফকা আজও বেঁচে আছেন, যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে তিনি বেঁচেই থাকবেন। গল্পের সারমর্মটি তাহলে দাঁড়াল এই রকম। ওই বন্ধু হলেন কাফকার ‘অচিন্ত্য’।
কিংবা ধরুন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৮৯০ সালে, জীবদ্দশায় তাঁর মাত্র একটি ছবি অল্পদামে বিক্রি হয়েছিল। ছবির দুনিয়া তাঁকে চিনল আরও ২০ বছর পরে, ১৯১০ সাল নাগাদ। কেমন করে? না এখানেও সেই অচিন্ত্যর একই গল্প। ভিনসন্টের ফ্রেন্ড, গাইড, ফিলোজফার ছিলেন তাঁর সহোদর থিও, একমাত্র তাঁর কাছেই ভিনসেন্ট নিজের সব কথা উজার করে দিতেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর আঁকা কয়েক হাজার ছবি চলে আসে থিওর হাতে। অচিরে থিওরও মৃত্যু হয়, ছবিগুলির নতুন মালকিন হন তাঁর স্ত্রী জো। তিনি যে রাতারাতি সোনার খনির মালিক হয়ে গিয়েছেন এই উপলব্ধি জাগ্রত হতেই তিনি কোমর বেঁধে নেমে পড়েন শিল্পীর অমর চিত্রকলাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে উপস্থাপিত করতে। তাঁরই উদ্যোগে হতে শুরু করে একের পর এক প্রদর্শনী, সুপ্ত প্রতিভার জাগ্রত বিস্ফোরণে শিল্পরসিক সমাজ মুগ্ধ হয়ে যায়। অনেক ছবি বিক্রি করলেও থিও তাঁর নিজের ও পুত্রের পছন্দের বেশ কয়েকটি ছবি নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল সূর্যমুখী ফুলের তিনটি ছবির একটি সিরিজ। বুক ফেটে গেলেও এই সিরিজের একটি ছবি লন্ডনের এক সংগ্রহশালাকে দিতে থিও সম্মত হয়েছিলেন অনেক টানাপোড়েনের পর। কেন? আই স্যাক্রিফাইসড মাই প্রেফারেন্স ফর ভিনসেন্টস গ্লোরি।
মৃত্যুর পরে প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছে দুনিয়ায় এমন যশস্বী মানুষের তালিকা দীর্ঘ। আমার প্রতিপাদ্য সেটা নয়। ইচ্ছে নয় ইউরোপে সীমাবদ্ধ থাকারও। অতএব কাট টু কলকাতা, ২০২১-২২। আমি যে তিন জনের কথা বলব, প্রতিভা, খ্যাতি কোনও মানদণ্ডেই তাঁরা কাফকা বা ভিনসেন্টের সমগোত্রীয় নন, নেহাতই আটপৌঢ়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। আমার উৎসাহের কারণ এঁরা তিন জনেই আমার স্বনামধন্য পূর্বসূরি, দু’জন তো গুরু-স্থানীয়। দু’জনের জন্ম শতবর্ষ কেটে যাচ্ছে এই বছরেই, তৃতীয় জনের আগামী বছরে। কাকতালীয় ভাবে এঁদের তিন জনেরই পদবী ‘ঘোষ’, সন্তোষ কুমার, শংকর এবং গৌরকিশোর। এমনই হতভাগ্য এঁরা যে শতবর্ষে ছবিতে একটি মালা পড়ানোর মতো কোনও ‘অচিন্ত্য’-কে এ শহরে খুঁজে পাওয়া যায় না।
শতবর্ষ উপলক্ষ্যে সন্তোষ কুমার ঘোষের কথা এই সেদিন লিখেছি, ভবিষ্যতে সুযোগ হলে আবার লিখব, তাই তাঁর সম্পর্কে আর কিছু বলছি না। আমি আলো ফেলতে চাই শংকর জায়া আল্পনা আর গৌরকিশোরের তিন পুত্র-কন্যা সাহানা, সোহিনী আর ভাস্করের ওপর। অবিবেচক সমাজকে থোড়াই কেয়ার করে আল্পনাদি একা কুম্ভ হয়ে লড়ে যাচ্ছেন প্রয়াত স্বামী শংকর ঘোষের স্মৃতিকে তাঁর শতবর্ষে যতটা পারা যায় পুনরুজ্জীবিত করার। একটি স্মারক গ্রন্থের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ, জুতো সেলাই টু চণ্ডিপাঠ সবেতেই একা আল্পনাদি। পাশাপাশি স্বামীর দীর্ঘ, ঘটনাবহুল কর্মজীবন নিয়ে তিনি ধারবাহিক ভাবে লিখে চলেছেন banglalive.com পোর্টালে। পড়লে কেবল শংকর ঘোষকে জানা হয় না, ঐতিহাসিক সব ঘটনার ছবি ভেসে ওঠে। ৪৬-এর প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় মহাত্মা গান্ধী যখন নোয়াখালিতে তাঁর পাশে নোটবুক হাতে দাঁড়িয়ে শংকর ঘোষ। জওহরলাল নেহরু যাচ্ছেন বিদেশ সফরে সঙ্গী শংকর। শংকরবাবুর রিপোর্টারি জীবনের সঙ্গে কোথায় যেন আমি নিজের মিল খুঁজে পাই। যদিও দুর্ভাগ্য আমার তাঁর জীবদশ্শায় শংকরবাবুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়ে ওঠেনি। বরাবর আমি তাঁর নিমগ্ন পাঠক, নিজস্ব চারিত্রিক ঋজুতা প্রতিফলিত হয় তাঁর ভাষায়। দেশভাগ নিয়ে তিনি যা লিখে গিয়েছেন, বাংলা কেন, যে কোনও ভারতীয় ভাষায় তার তুলনা মেলা ভার। ‘দ্বিখণ্ডিত’ শীর্ষকে তাঁর এই লেখা দীর্ঘদিন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল, তারপর অজানা কারণে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায়।
শংকরবাবুকে চেনা হয়ে ওঠেনি কিন্তু শংকর-জায়া আল্পনা ঘোষের সঙ্গে আমার গভীর, অচ্ছেদ্য ভালোবাসার সম্পর্ক। আপনার চেয়ে আপন যে জন বলতে যা বোঝায়। মেঘে মেঘে আল্পনাদির বেলাও কম হল না, শরীর-জোড়া অসুখ, কোমরে যন্ত্রণা, ভাঙা পা, কিন্তু মনটি সপ্তদশীর মতো সতেজ আর টগবগে। একদা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মাস্টারনি ছিলেন, একা থাকেন, একাই গাড়ি ড্রাইভ করে চক্কর কাটেন কলকাতা শহরে। আর পরিচিত মানুষের কাছ হাত পাতেন শংকরকে নিয়ে একটি লেখার জন্য। এক্কেবারে যেন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই। জীবন-সায়াহ্ণে স্বামীর স্মরণে তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন সেই ‘অচিন্ত্যর’ দায়িত্ব।
গৌরকিশোর ঘোষের জন্ম-শতবর্ষ আগামী বছরে। আমার গুরুর পুত্র-কন্যাদল গোড়া থেকেই স্বাবলম্বী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাঁরা জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করেন একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, অন্য ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আগামী বছরের জন্য তাঁদের নানাবিধ পরিকল্পনা আছে, সুচারু ভাবে সেগুলি রূপায়িত করতে অনেক দিন যাবৎ তাঁরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি সেই সব পরিকল্পনার কিছু কিছু জানি, কিন্তু ওঁদের সম্মতি না নিয়ে সে কথা বলা হয়তো উচিত হবে না। ওঁদের দেখে, পিতার স্মৃতি ও অক্ষয় কীর্তির প্রতি ওঁদের দায়বদ্ধতার পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ। মাঝে মাঝে মনে হয় আল্পনাদি, সাহানা, সোহিনী, ভাস্কর, পত্রালীর মতো ‘অচিন্ত্য’রা যদি ঘরে ঘরে জন্মাতেন!