খবরদার, আমি সর্দার!
সুমন চট্টোপাধ্যায়
সান্টাঃ মীনার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি চুকে গেছে?
বান্টাঃ হ্যাঁ, আমাকে ওর একেবারেই পছন্দ নয়
সান্টাঃ মীনাকে তুমি বলেছিলে, মুম্বাইতে তোমার একজন বিরাট পয়সাওয়ালা কাকা থাকেন?
সান্টাঃ বলেছি৷ তারপরেই তো মীনা আমার কাকিমা হয়ে গিয়েছে৷
অথবা
সান্টা থানায় ফোন করেছে — ‘শুনুন আমার বন্ধুর খুব চোট লেগেছে, এক্ষুনি সাহায্য চাই৷
অপারেটরঃ আপনি ঠিক কোথা থেকে ফোন করছেন একটু জানাবেন?
সান্টাঃ কনট প্লেস৷
অপারেটরঃ জায়গার নামটা একটু বানান করে বলতে পারেন?
সান্টা পারে না৷ না পেরে সে হাতে টেলিফোন নিয়ে দৌড়তে শুরু করে৷ তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে থানার অপারেটরকে বলে ‘মিন্টো রোড’৷
হরবিন্দর চৌধুরীর আবেদন দেশের সর্বোচ্চ আদালত মেনে নিলে শিখদের নিয়ে এমন অজস্র মজার চুটকি (ইংরেজিতে যাকে বলে ‘জোক’) অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে ইন্টারনেটের বিবিধ সাইট থেকে৷ আদালতের আদেশ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাটা মূর্খামি,কিন্তু এই জনস্বার্থ মামলা যে সুপ্রিম কোর্ট গোড়াতেই খারিজ করে দেয়নি, সেটাই বিস্ময়ের৷ এই আবেদন নিয়ে অচিরে শুরু হবে শুনানি৷
যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে হরবিন্দরের বক্তব্য, ইন্টারনেটে এমন অন্তত পাঁচ হাজার সাইট আছে, যাদের একমাত্র কাজ শিখেরা কতটা বোকা ও মাথামোটা তা প্রতিপন্ন করার জন্য চুটকি তৈরি করা৷ এইভাবে তারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসাও করে চলেছে৷ এটা সাধারণ ভাবে শিখ সমাজের পক্ষে অবমাননাকর এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ৷ অতএব সুপ্রিম কোর্ট এই সব ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিক৷
হরবিন্দর নিজেও শিখ, মানে সর্দারনি৷ দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করছেন৷ আদালতে এবং আদালতের বাইরে তিনি যে সব কথা বলছেন, তা থেকে একটি বিষয় জলের মতো পরিষ্কার৷ তা হল, দৈনন্দিন জীবনে বারেবারে ঠাট্টা-ইয়ার্কির মুখোমুখি হতে হতে তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এ বার তাই তিনি একটা হেস্ত-নেস্ত চান৷ বেশ কয়েকটি শিখ সংগঠন ইতিমধ্যেই তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছে, শুরু হয়েছে স্বাক্ষর সংগ্রহও৷ হরবিন্দর স্থির করেছেন এ বার তিনি গোটা দেশ ঘুরে ঘুরে তাঁর দাবির সমর্থনে শিখ জনমতকে সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন৷ তবে তিনি কলকাতায় আসবেন কি না, এলেও কবে আসবেন, তা এখনও জানা যায়নি৷
হরবিন্দর বলেছেন, ‘আমি যখন সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে এই আবেদনটি পেশ করছি, তখনও শুনি, ঠিক পিছন থেকে একজন প্রবীণ উকিল ফুট কাটছেন, ইয়ে সর্দারওয়ালা পিটিশন সিরফ এক সর্দারনিহি ফাইল কর সকতি হ্যায়৷ একবার আস্পর্ধাটা ভাবুন! তার কিছুদিন আগে ধর্ষণ সংক্রান্ত একটা মামলা নিয়ে আলোচনার সময়ে আমাকে দেখে একজন সহকর্মী বলে উঠলেন, ইনকে তো বারা বাজ গয়ি৷ বাজারে গিয়ে অনেক সময়ই শুনতে হয়, আপনে তো সর্দারওয়ালি বাত কর রহি৷’ তাঁর আক্ষেপ, এই ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জন্য তাঁর মেয়েরা নামের শেষে সিং অথবা কওর পদবি লাগাতে চায় না৷ তার মানে প্রকাশ্য লাঞ্ছনার ভয়ে তারা নিজেদের শিখ পরিচিতিটা গোপন রাখতে চায়৷ কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে এর চেয়ে অবমাননাকর আর কী-ই বা হতে পারে?
আমি কোনও বিষয়েই কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে নই, কিন্তু এই একটি বিষয়ে ভদ্রমহিলার মনোবেদনার শরিক৷ সত্যিই তো, স্রেফ শিখ হয়ে জন্মানোর কারণেই যদি ক্রমাগত এবং সর্বত্র ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ আর উপহাস সহ্য করে যেতে হয়, তা হলে গায়ে জ্বালা ধরবেই৷ এ কথাও ঠিক, এই দংশনটা কী রকম,কতটা বিষাক্ত, সেটা যিনি শিখ হয়ে জন্মাননি, তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব৷ কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কীসে, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে?
দিল্লিতে থাকাকালীন কর্মসূত্রে আমাকে পাঞ্জাব যেতে হয়েছে অসংখ্যবার৷ ফলে নানা ভাবে শিখেদের খুব কাছ থেকে দেখেছি৷ অনেক শিখ বন্ধু-বান্ধবও রয়েছে আমার৷ সত্যি কথা বলতে কী, এত দিল-দরিয়া, প্রাণ খোলা, উদার, অতিথি-বৎসল, পরিশ্রমী, দেশভক্ত সম্প্রদায় ভূ-ভারতে আর কোথাও দেখিনি৷ জনপ্রিয় চুটকিগুলোয় রুটিনমাফিক শিখেদের যে র্দুবলতাগুলো দেখানো হয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় কখনও তা প্রতিফলিত হয়নি৷ ফলে বারেবারে আমারও মনে হয়েছে, এমন একটি অসাধারণ সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এত অসংখ্য রকম চুটকি চালু হয়েছে কেন? আর এ ব্যাপারেও সত্যিই কোনও সন্দেহ নেই যে চুটকির অনেকগুলিই অশালীন, রসবোধহীন এবং সম্পূর্ণ বিকৃত তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত৷
যেমন ধরা যাক এই চুটকিটি৷ একজন সর্দার একটি হেলিকপ্টার চালাচ্ছিল৷ কিছুক্ষণ পরে সেটি ভেঙে পড়ল মাটিতে (পড়বেই। কেননা সর্দারজি যখন চালাচ্ছে!)। অথচ দেখা গেল, সর্দারের কিছুই হয়নি, সে দিব্যি মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে৷ কী করে এমন দুর্ঘটনা ঘটল জানতে চাওয়া হলে নির্বিকার সর্দারজির জবাব, ‘আরে উপরে উঠে আমার বড্ড ঠান্ডা লাগছিল৷ তাই আমি পাখাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম৷’ যাদের নিয়ে করা হচ্ছে এ ধরনের বোকা-বোকা রসিকতা, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতের তুলনায় অনেক বেশি৷ ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এ পর্যন্ত যে একজনই ফাইভ স্টার র্যাঙ্ক এয়ার চিফ মার্শাল হয়েছেন, তিনিও শিখ৷ অর্জন সিং৷ ক্র্যানওয়েলের রয়াল এয়ারফোর্স কলেজের দেওয়ালে যে একজন মাত্র ভারতীয় ফৌজির প্রতিকৃতি সসম্মানে প্রদর্শিত আছে, তিনিও অর্জন৷ ১৯৭১-এর যুদ্ধে একা কুম্ভ হয়ে শ্রীনগর বিমানঘাঁটি রক্ষা করেছিলেন ফ্লাইং অফিসার নির্মলজিৎ সিং সেখোঁ৷ এমন অবিশ্বাস্য সাহসিকতার জন্য তাঁকে পরমবীরচক্রও দেওয়া হয়েছিল৷ এবং হ্যাঁ, এই নির্মলজিৎ-ও শিখ৷ অতএব একজন বোকা সর্দারজিই যে আকাশে হেলিকপ্টার তুলে ঠান্ডা লাগার ভয়ে পাখা বন্ধ করে দেবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!
এতেই কি শেষ? সর্দারজিরা এতই বোকা যে তাঁরা ফ্যাক্সের কাগজে পোস্টেজ স্ট্যাম্প সাঁটেন, ‘সোশ্যালিজম’ শব্দটার মানে করেন পার্টিতে মস্তি করা, স্টাইল, ফ্যাশন,সিনেমা, চিত্রকলা কিছুই বোঝেন না৷ আর ইংরেজি ভাষা? এক্কেবারে ক অক্ষর গো-মাংস৷ মোদ্দা কথায় সর্দারজি মানে পাগড়ি বাঁধা ট্রাক অথবা ট্যাক্সি ড্রাইভার, মগজে তাদের শুধুই গোবর, চলতি বাংলায় বিশুদ্ধ গান্ডু৷ ‘ওয়াহে গুরু জি কা খালসা’, তুই বাবা এমন মূর্খ হতে গেলি কেন বল দিখিনি?
কিংবা ‘বারোটা বাজার’ রসিকতা, যা কি না শিখদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত৷ রসিকতার মর্মার্থটি হল, ঘড়ির দু’টো কাঁটা যখন এক বিন্দুতে আসে, তখন আসলে শিখেদের বুদ্ধিটা স্থবির হয়ে যায়৷ অথচ এই রসিকতার যেটা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত তা এক্কেবারে বিপরীত, শিখেদের পক্ষে দারুণ গৌরবের৷ সংক্ষেপে সেই কাহিনিটি এই রকম৷ মোগল আমলে প্রায়শই হিন্দু রমণীদের গায়ের জোরে তুলে নিয়ে যাওয়া হত৷ তার বদলা নিতে শিখ সৈন্যেরা মুসলিম ছাউনিগুলিতে পাল্টা আঘাত হানত মধ্য-রাতে, অতর্কিতে৷ সে জন্য মোগল শিবিরের মহিলারা রাত বাড়লেই বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করত শিখেদের ভয় দেখিয়ে৷ বলত, শীগগিরই ঘুমিয়ে পড়, রাত বারোটা বাজে, নয়তো শিখ সেনা এসে তুলে নিয়ে যাবে৷ একদা যা ছিল শিখ বীরগাথার গপ্পো, কালে কালে সেটাই বিকৃত হয়ে রসিকতার মাধ্যমে দাঁড়িয়ে গিয়েছে শিখ-নির্বুদ্ধিতায়৷ এরপরেও যদি রাগ না হয়, তাহলে আর হবেটা কীসে? সর্দারজি বলে কি তাঁরা রক্ত-মাংসের মানুষ নন!
এ কথা ঠিক ‘কমিউনিটি জোক’ শোনা যায় প্রতিটি দেশেই৷ ইউরোপে যেমন আইরিশ আর পোলদের নিয়ে কত রকম রসিকতা আছে তার ইয়ত্তা নেই৷ আইরিশদের নিয়ে রসিকতা বোধহয় সর্দারজিদের নিয়ে রসিকতার চেয়েও অনেক বেশি নিমর্ম৷ যেমন, একটা আইরিশ বিবাহ অনুষ্ঠান আর একটি আইরিশ কবরদান অনুষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? উত্তরঃ একজন মাতালের সংখ্যা কম৷ কিংবা, আয়ারল্যান্ড আর একটি টি ব্যাগের মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তরঃ টি ব্যাগটি অনেক বেশিক্ষণ থাকে কাপের ভিতর৷ কিংবা, একজন আইরিশ মহিলাকে অন্ধ করে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় কী? উত্তরঃ একটা স্কচের বোতল তাঁর সামনে বসিয়ে দেওয়া৷ কিংবা ভগবান হুইস্কি আবিষ্কার করেছিলেন কেন? উত্তরঃ আইরিশরা যাতে কোনও দিন বিশ্বজয় করতে না পারে৷ শুধু মদ্যপান নিয়ে নয়, পার্থিব যে কোনও বিষয়েই আইরিশরা ক্রুঢ় রসিকতার শিকার৷ যেমন খেলার প্রসঙ্গে৷ প্রশ্নঃ বিশ্বকাপের নক আউট স্টেজে একজন আইরিশম্যানকে কী বলা হয়? উত্তরঃ রেফারি৷ প্রশ্নঃ যীশু খ্রীষ্ট আয়ারল্যান্ডে জন্মাননি কেন? উত্তরঃ সেখানে তিনি তিনজন প্রাজ্ঞ মানুষ কিংবা একজন কুমারীকেও খুঁজে পাননি৷
ভারতেও যে কেবল শিখেদের নিয়ে চুটকি কাটা হয় তা নয়, আরও অনেক সম্প্রদায়কে নিয়েও হয়৷ যেমন পার্সি, গুজরাতি প্যাটেল, মাড়োয়াড়ি, মালয়ালি কিংবা বঙ্গসন্তানদের নিয়েও৷ বাঙালিদের নিয়ে চুটকির বেশিরভাগই তাদের উচ্চারণ দোষ নিয়ে৷ একটি নমুনা৷
শায়রি শিখতে এক বাঙালি বাবু গিয়েছেন গালিবের কাছে৷ গালিব সাহেব বললেন, ‘আমি যা যা বলছি, যে ভাবে বলছি, আপনিও তা বলে যান৷’
‘না গিলা করতে হ্যায়/ না শিকওয়া করতে হ্যায়/ তুম সালামাত রহো ইস দুনিয়া মে/ ইয়েহি দুয়া করতে হ্যায়৷’
বাঙালি- না গিলা করতা হ্যায়/ না শুখা করতা হ্যায়/ তুম শালা, মত রহো ইস দুনিয়া মে/ ইয়েহি দুয়া করতা হ্যায়৷
তবে সর্দারজির চেয়ে বাঙালির ঘটে যে অনেক বেশি বুদ্ধি, অন্য কিছুতে তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে আমরা সেটাও চুটকি সাজিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রাণপণে৷ উদাহরণঃ
বেহেড মাতাল হয়ে এক বাঙালি বাবু একটি বারে ঢুকে একটা পেগ অর্ডার করেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘তোমরা কেউ সর্দার-জোক শুনতে চাও?’
কথাটা শুনেই একজন দোহারা চেহারার ভদ্রলোক বাঙালির পাশে এসে দাঁড়ালেন৷ তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ‘দেখুন মশাই, আপনি এখন মাতাল অবস্থায় রয়েছেন৷ তাই আমার মনে হল, আপনি জোক বলার আগে আপনাকে এই বার সম্পর্কে পাঁচটি তথ্য জানিয়ে রাখা খুব জরুরি৷ এখানকার বার টেন্ডার সর্দার,বাউন্সার সর্দার,আমি নিজে ছ’ফুট, ব্ল্যাক-বেল্ট,আমার পাশেই যিনি বসে আছেন তিনিও সর্দার এবং একজন ওয়েটলিফটার, আর আপনার বাঁ পাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন কুস্তিগির এবং সর্দার৷ এবার ভেবে দেখুন আপনি সর্দারদের নিয়ে চুটকি শোনাবেন কি না৷’
বাঙালি বাবু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন৷ তারপর স্বগতোক্তির ঢঙে বলে উঠলেন, ‘ না বাবা না, একটাই জোক পাঁচবার করে কে বলতে যাবে!’
তাঁদের নিয়ে রঙ্গ-রসিকতা হোক, তা নিয়ে শিখেদের বড় একটা আপত্তি আছে বলে মনে হয় না৷ শিখেরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে অনেক সময়ে রসিকতা করে থাকেন৷ যেমন প্রয়াত খুশবন্ত সিং তো সারাটা জীবন ধরেই করেছেন৷ শিখেদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় সংগঠন গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির পক্ষ থেকে খুশবন্তকে একাধিকবার অনুরোধ করা হয়েছিল, এভাবে সেম-সাইড না করার জন্য৷ রঙ্গ-রসিকতার রাজা খুশবন্ত এই সব আপত্তিকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে জবাবে এমন দু’টো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, তা ছাপার যোগ্য নয়৷
কিন্ত্ত সবাই খুশবন্ত হবেন, এমনটা আশা করা যায় না৷ সেটা হওয়ার কথাও নয়৷ রসিকতা বোঝা শিখ সমাজের একটা বড় অংশের মূল অভিযোগটি হল, বাকি সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তাদের যে চরিত্র বৈশিষ্ট্য তা নিয়ে রসিকতা করা হয়৷ যেমন পার্সি বা ইহুদিদের কিপটেমি নিয়ে কিংবা বাঙালিদের উচ্চারণ দোষ নিয়ে৷ একমাত্র শিখেদের সম্পর্কেই এই নিয়মে ব্যত্যয় ঘটানো হয়ে থাকে৷ যা তাঁরা নন, কিংবা যেটা তাঁদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নয়, কদাপি ছিল না, তা নিয়েই তৈরি হয় যাবতীয় চুটকি৷ সব কিছু জেনে শুনেও একটা গোটা সম্প্রদায়কে কেবলই বুদ্ধির ঢেঁকি হিসেবে প্রতিপন্ন করা হবে কেন? এটা কি রসিকতা, না সচেতন অবমাননা?
হক কথা৷ কিন্ত্ত এটা হল কেন? উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে মোটামুটি দু’টি ব্যাখ্যা পেলাম৷ শিখেদের মধ্যে চরমপন্থী যাঁরা, বলা চলে খালিস্তানপন্থী, তাঁরা মনে করেন এটা ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্র। যা শুরু হয়েছে আশির দশক থেকে, ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ মদতে৷ অর্থাৎ এঁদের মতে অপারেশন ব্লু স্টারের জমি তৈরি করার জন্য শিখেদের পরিকল্পিত ভাবে খাটো করার একটা প্রয়োজন ছিল এবং সেই উদ্দেশ্যেই শুরু হয়েছে তাঁদের নিয়ে রসিকতার বন্যা৷ আর তাতে দোসর হয়েছে দেশের মিডিয়া৷
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি খুশবন্ত সিং কিংবা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা জওহরলাল হান্ডুদের মতো বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকদের৷ তাঁদের মতে, আসলে শিখেদের সর্বাঙ্গীন সাফল্যই তাঁদের করে তুলেছে বাকিদের কাছে উপহাসের পাত্র৷ অর্থাৎ এমনতরো মনোভাবের শিকড়টা আসলে লুকিয়ে আছে শিখেদের সম্পর্কে সংখ্যাগুরুদের একধরনের ঈর্ষা-কাতরতায়৷ হান্ডুর মতে, কেবল ঈর্ষা নয়, শিখেদের সাফল্যের কাহিনি অন্যদের মধ্যে গভীর বিপন্নতাবোধেরও জন্ম দিয়েছে৷ সেটাই ভাষা পায় শিখ-বিরোধী নানাবিধ মস্করায়৷ খুশবন্তও মোটামুটি হান্ডুর মতের শরিক। যদিও প্রতিবাদ প্রতিরোধের তিনি ঘোষিত ভাবে বিরোধী৷ তাঁর আক্ষেপ, আর পাঁচটি সম্প্রদায়ের মতো শিখ সমাজও ধীরে ধীরে আত্ম-প্রত্যয় হারিয়ে ফেলছে, তাদের গাত্র-চর্মও ঢিলে হয়ে গিয়েছে অনেকখানি৷ সে জন্যই তাদের অনেকে আর শিখেদের নিয়ে রসিকতা সে ভাবে মানতে পারছেন না৷
খুশবন্ত সিং বেঁচে থাকলে বোধহয় কপালে দুর্ভোগ ছিল সুবিচার-প্রার্থী সর্দারনির৷ কে জানে হয়তো তিনি গুরুগ্রন্থে লেখা কবীরের সেই দোহাটি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেন — ‘কহো কবীর ছুছা ঘাট বোলে/ ভারিয়ে হোয়ে সো কবাহু না ডোলে৷’
কবীর বলেন, আওয়াজ করে তো কেবল শূন্য-কুম্ভ৷ ভরা-কুম্ভ করে কি?