সুমন চট্টোপাধ্যায়
অপর্ণা সেন জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশটা কি তাহলে পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে? বিদ্রোহিনী তসলিমা নাসরিন ভাববাচ্যে কথাবার্তা বলা পছন্দ করেননা, তাই তিনি সোজা-সাপটা ঘোষণা করে দিয়েছেন তাঁর মাতৃভূমির নতুন নাম।’ জিহাদিস্থান।’
সংখ্যালঘু মানুষের ওপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতেই অপর্ণা দেবীর মনে প্রশ্নটি জেগেছে, যার উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। ধর্মীয় পরিচয়ে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম হওয়া ইস্তক পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বলে মনে করা হয়, সামান্য ছুতোয় তাদের হেনস্থা করা হয় ঠিকই। কিন্তু পাকিস্তানে এখন হিন্দুর সংখ্যা নামমাত্র, বড়জোর বারো-তেরো লাখ, বাংলাদেশে তার দশগুণ বেশি, পরতে পরতে কমতে থাকার পরেও। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রক্রিয়া তুলনায় গণতান্ত্রিক, কেবল হিন্দুরা নয়, খ্রিস্টান, আহমেদিয়া, ইসমাইলি, এরা সবাই আক্রমণের লক্ষ্য। বাংলাদেশেও বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানরা আছেন যৎকিঞ্চিৎ সংখ্যায়, ইতি-উতি তাদের ওপরও। ইসলামি জেহাদিদের মূল শত্রু হিন্দুরা।
এই সেদিন পর্যন্ত চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রায় সকলেই ছিলেন প্রধানত বৌদ্ধ, বারো-তেরোটি উপজাতির সমাহার এই জনসমষ্টির স্থানীয় নাম ‘জুম্মা’। মায়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে তাদের অনেককে জবরদস্তি উৎখাত করা হয়েছে, ফলে নিজভূমে বৌদ্ধরা আজ সংখ্যালঘু। চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকায় রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে যা হয়েছে বাংলাদেশের অন্যত্র হিন্দুদের নির্যাতন করার লক্ষ্যও তাই। হানাহানির মধ্যে দিয়ে তাদের বাস্তুচ্যুত করে বিষয়-সম্পত্তি, জমি-জমা কব্জা করা। ধর্মটা আসলে ছদ্মবেশ, ক্ষমাহীন অমানবিকতাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বৈধতা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ধর্মগ্রন্থের অপব্যাখ্যা করা।
তাহলে কি তসলিমা নাসরিনের মূল্যায়নই ঠিক, বাংলাদেশ সত্যিই কি ‘জিহাদিস্থানে’ পরিণত হল? তসলিমার অবস্থানে থাকলে নিজের দেশের এই জাতীয় চরিত্রায়ণ খুবই স্বাভাবিক। কয়েক দশক হতে চলল তসলিমা দেশান্তরী, এ জীবনে আর কোনও দিন স্বদেশে ফিরতে পারবেন কি না সন্দেহ। উপায় থাকলে তিনি কলকাতায় থাকতেন কিন্তু আমাদের বিশুদ্ধ সেকুলারিজম তা সহ্য করবে না। তসলিমার অবস্থাটা অনেকটা এই রকম- ‘কী যাত না বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে?”
যে অর্থে আফগানিস্থান জিহাদিস্থান বা পাকিস্তানও আংশিক জিহাদিস্থান, বাংলাদেশ হয়তো এখনও সর্বনাশের সেই শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছয়নি। তা যদি হোত, দুর্গাপুজোর সময় জিহাদিদের বীভৎস তাণ্ডবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জায়গায় জায়গায় এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মিছিল রাজপথে নামত না,
ধর্ম-নির্বিশেষে এত মানুষ তাতে সামিলও হতেন না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সংখ্যালঘুই কেবল নয়, উদার-মুক্ত চিন্তার যে কোনও মানুষ আজ জিহাদিদের হিট-লিস্টে। তার জন্য প্রাণ গিয়েছে কারও কারও, তবু ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধ স্বর স্তব্ধ করা যায়নি। জিহাদিরা বাড়ছে, তাদের বিরুদ্ধতা কিন্তু কমছে না।
সবার অলক্ষ্যে বাংলাদেশে আরও একটি বৈপ্লবিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, অশিক্ষা কিংবা দারিদ্র-জনিত জিহাদি কারবারের বিরুদ্ধে যা অ্যান্টিডোটের কাজ করতে পারে অনেকখানি। আফগানিস্থান কিংবা পাকিস্তানে আমরা দেখছি শেষ বিচারে দারিদ্র্যই হল জেহাদের বীজতলা। বিদেশি মদতপুষ্ট জিহাদি মাতব্বরেরা এই অবস্থারই ফায়দা লোটে, ছেলেপিলেদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে প্রথমে তাদের মগজ ধোলাই করে, তারপর বেহস্তে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে আর সংসারে কিছু আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই যুবার হাতে বন্দুক তুলে দেয়, তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, সবশেষে তাকে চালান করে দেয় যুদ্ধের জবাইখানায়। ইদানীং বাংলাদেশেও আমরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করছি, তসলিমার বিবিধ লেখাতেও বারেবারে ফিরে আসে এই জেহাদি গড়ার প্রসঙ্গ, আগাছার মতো মাদ্রাসা গড়ে ওঠার কথা যেখানে বাংলা নিষিদ্ধ আর আরবি সমাদৃত।
জিহাদের বীজতলা উপড়ে ফেলার একটা বড় সুযোগ এসেছে ঢাকার সামনে, উন্নয়নের স্টিমরোলার চালিয়ে বিপথগামী যুবাদের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করা। বিষয়টি নিয়ে আমাদের এখানে বিশেষ চর্চা হয়না, তবু সত্যটা হল মাথাপিছু জিডিপি-তে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বর, পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে, এগিয়ে ভারতের চেয়েও। সম্প্রতি বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির হার নয় শতাংশ, অঙ্কের হিসেবে মাথাপিছু ২২২৭ ডলার। পারিস্তানের সেখানে মাত্র ১৫৪৩ ডলার। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার সময় পাকিস্তান বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ধনী ছিল, আজ সে ৪৫ শতাংশ বেশি গরিব। সম্প্রতি কোথায় একটা পড়লাম এক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ সখেদে বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কাছে আমাদের সাহায্যের হাত পাততে হতে পারে। সত্যিই যদি তা হয়, ইতিহাসের বৃত্তটি তাহলে সম্পূর্ণ হবে।
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের মধ্যে থেকে জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। সবজান্তা তৎকালীন মার্রিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঙ্গার বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে ‘বাস্কেট কেস যার নীচে একটি ছিদ্রও থাকবে। ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য দানের জন্য সেই প্রথম একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছিলেন রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন। মাত্র পাঁচটি দশক পরে, সব হিসেব ওলট-পালট করে দিয়ে, সমালোচকদের মুখে নুড়ো ঝাঁটা গুঁজে দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ-জয়ন্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের এমন চমকপ্রদ আর্থিক সাফল্যের কারণানুসন্ধান আপাতত মুলতুবি থাক। বলার যেটা তা হল, এই উন্নয়ন দিয়ে উদভ্রান্ত জিহাদকে প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি শাসকের সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে। ইতিহাস বলে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকলে সেদেশের হিন্দুরা তুলনায় বেশি নিরাপদ বোধ করেন। মুজিবের জীবদ্দশায়্য, ১৯৭১-৭৫, হিন্দুরা ছিল মহা আনন্দে। তারপর দীর্ঘ সামরিক শাসন, বিএনপি-র ক্ষমতাসীন হওয়া হিন্দুর পায়ের তলার জমি নাড়িয়ে দিয়েছে। এই সময়কালে অসংখ্য হিন্দু প্রাণের ভয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অর্থনীতির অধ্যাপক, হিন্দুদের বাংলাদেশ ছাড়ার বাৎসরিক হারকে সামনে রেখে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন, তিরিশ বছর পরে বাংলাদেশে আর একজন হিন্দুও থাকবে না। অতএব প্রশ্ন স্রোতের মুখ ফেরানোর দম আছে কি শেখ হাসিনার? কিংবা সদিচ্ছা? নাকি তাঁর সেকুলারিজমও দিনের বেলায় মুজিবপন্থী আর রাতের বেলায় জামাতি?