31 C
Kolkata
Thursday, October 3, 2024

হরি নেই, ভাবতে পারছি না

Must read

হরি নেই, ভাবতে পারছি না

সুমন চট্টোপাধ্যায়

গতকালই শুনেছিলাম প্রগনোসিস ভালো নয়। কতটা খারাপ? শুনলাম আশি-কুড়ি। ফুসফুসের লড়াই করার ক্ষমতা কেবলই কমছে, অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতহারে কমছে। জানতে চাইলাম, তাহলে কি ধরে নেব————।

ওয়াকিবহাল একজন তবুও ভরসার কথা শোনালেন। ‘‘শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি, আমাদের এই হাসপাতালেই একজন টানা ৩৮ দিন ভেনটিলেশনে থাকার পরে দিব্যি সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছেন। যমে-মানুষে টানাটানির লড়াইয়ে যম হেরে গেছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে বেশ কিছু। অতএব যতক্ষণ শ্বাস, আশও ততক্ষণ ধরে নিন।”

মতি নন্দীর সেই অমর সংলাপটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল- ফাইট, কোনি ফাইট। স্বগতোক্তি করতে শুরু করলাম, ফাইট, হরি ফাইট। কেন জানি না, আমার স্থির়- বিশ্বাস ছিল, লড়াইটা অসম্ভব কঠিন হলেও হরি ঠিক কোনির মতোই জিতে হাসপাতাল থেকে বের হবে। অমন পেটানো ছাতি যার, শরীর এমনিতে রোগ-শূন্য, ডায়াবেটিস, সি ও পি ডি, ব্লাড প্রেশার কিচ্ছু নেই, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই যে পাক্কা দু’ঘণ্টা গাড়িতে সটান বসে থাকতে পারল, সামান্য কোভিড-১৯ ভাইরাস তাকে কাবু করতে পারবে না কিছুতেই। সারাটা রাত অশান্তি নিয়ে ছটফট করলাম, কত প্রার্থনা জানালাম কত রকমের ভগবানের কাছে।

সকালে উঠে শুনলাম, হরি বাসুদেবনও হার মানতে বাধ্য হয়েছে। একবার মনে হল, ওঁর স্ত্রী আমার ৪০ বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাপু’কে (ভাল নাম তপতী গুহঠাকুরতা) একবার ফোন করি। পেরে উঠলাম না। গুনগুন করে গাইতে শুরু করলাম, সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব……..।

আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে আধুনিক ইতিহাস নিয়ে এম এ পড়তে শুরু করেছি, বিভাগে একজন নতুন অধ্যাপক যোগ দিলেন। নাম হরি বাসুদেবন। প্রথম দিন চাক্ষুষ করেই বুঝতে বাকি রইল না, ইনি অন্য গোত্রের অধ্যাপক, একটুকরো হীরে। মাথায় ঘন ঝাঁকড়া কুচকুচে কালো চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত, পুরুষ্টু ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, চশমার পিছনে চোখ দু’টো অসম্ভব উজ্জ্বল, ইংরেজি উচ্চারণে পুরোদস্তুর সাহেব। স্বভাবে বিনয়ী, ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি লেগেই আছে, কপট গাম্ভীর্যের ছিটেফোঁটা নেই, ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে পারেন, স্বল্পবাক হলেও রসবোধে টই-টম্বুর। প্রথম দিন থেকেই হরি আমাদের যত না মাস্টারমশাই তার চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু। হরি পড়াতেন ইউরোপের ইতিহাস, আমার স্পেশাল পেপার ছিল আধুনিক ভারত। ফলে হরির ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি। তবে বন্ধুদের সৌজন্যে প্রত্যক্ষ ছাত্র না হয়েও আমি হরি-ভক্ত হয়ে গেলাম। আজ পর্যন্ত তাই আছি।

রূপে-গুণে আমাদের ক্লাসের সেরা ছিল তাপু, এ নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশই ছিল না। তবে ক্লাস করতে করতে তাপু যে হরিতে মজেছে, লেখাপড়া সাঙ্গ হলে বরমাল্যটি তার গলাতেই পড়াবে বলে স্থির করে ফেলেছে ছাত্রাবস্থায় আমি তা টেরই পাইনি। প্রথম যেদিন অন্যের মুখে ওদের প্রণয়ের খবর পেয়েছিলাম অবাক হওয়ার চেয়ে আনন্দ হয়েছিল বেশি। হরি আর তাপু ছিল সিগারেটের বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে গেলে মেড ফর ইচ আদার। এক্কেবারে মানিক-জোড়।

তারপর জীবন আমাদের বন্ধুদের এক একজনকে একেক বাঁকে নিয়ে গিয়েছে, বছরের পর বছর দেখা হয়নি, কথা হয়নি, থাকেনি কোনও যোগাযোগ। তবু প্রথম যৌবনের নির্মল, নিষ্পাপ বন্ধুতা তার ফলে প্রভাবিত হয়নি এতটুকুও। বরং এই তো সেদিনই আমাদের কলেজ-বন্ধুদের ছোট্ট দলটা আবার মিলিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি, ফের আমরা জমাট বেঁধে বাঁচব, কলেজের দিনগুলো ফিরবে না জানি, তবু হৈ হুল্লোড় করতে বাধাটা কোথায়। আমাদের একটা হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপও আছে, যোগাযোগ এখন তাই চার দশক আগের মতোই দৈনন্দিন। বন্ধুদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আমাদের আড্ডা বসে, বন্দি হওয়ার আগে শেষ আড্ডাটা দিয়েছি তাপুর বাড়িতেই। সেখানেই শেষ দেখা হরির সঙ্গে, চুল-দাড়িতে সামান্য পাক ধরেছে, পরিবর্তন বলতে এইটুকুই। বলে না দলে বোঝার উপায় নেই, হরি বাসুদেবনের বয়স আটষট্টি।

আমাকে অন্যায় ভাবে কয়েদে পোরার জন্য হরিও যে মনে মনে তীব্র বেদনা অনুভব করেছিল সে কথা আমি তাপুর মুখেই শুনেছি। ভুবনেশ্বরে ওর এক উকিল বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করার কথাও ভেবেছিল। তারপর নীল আকাশ থেকে নেমে এল এই অপ্রত্যাশিত বজ্রাঘাত। কন্যাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে বন্দি হয়ে আছে তাপু, আমার বুক এ বার কাঁপতে শুরু করেছে ওদের জন্য। এ এমনই মর্মন্তুদ মৃত্যু যে ইচ্ছে করলেও কেউ মরদেহের কাছে যেতে পারবে না। হরির মতো মানুষের এই পরিণতি প্রাপ্য ছিল না। ঈশ্বর তুমি বড্ড নিষ্ঠুর, বড্ড অবিবেচক।

(ছবি: তপতী গুহঠাকুরতার ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article