সুমন চট্টোপাধ্যায়
আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী আছে, স্বভাব ত্যাঁদর, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা না করে যা মুখে আসে সেটাই বলে দেয়। তার নামটি ইচ্ছে করেই নিচ্ছি না, শুধু এটুকু বলছি, এমন একরোখা স্বভাবের জন্যই সে আমার বিশেষ স্নেহের পাত্র। গতকাল হোয়াটস অ্যাপ আলাপে সে লিখে বসল, ‘আর যাই বলুন, ওই সব আগেকার বিধবা মার্কা নিস্তরঙ্গ লেখা আপনার থেকে বাঙালি পাঠক চায়না। এটাই সত্যি।’
বাংলাটা একটু বিদঘুটে তবে কী বোঝাতে চায় সেটা স্পষ্ট।
ফেসবুকের কমেন্ট বক্সেও আমি অহরহ একই মনোবাঞ্ছার প্রতিধ্বনি শুনি। ‘এই তো দাদা একটু একটু করে ফর্মে আসছেন।’ কিংবা ‘চৈনিক প্রবাদ আছে ড্রাগন ঘুমিয়ে থাকলেও তার দাঁতের ধার নষ্ট হয় না,’ ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। এর অর্থ নিজের অজান্তেই আমি এক ধরনের স্টিরিওটাইপের শিকার হয়ে গিয়েছি, আমার লেখা পাঠকের মনে এক বিশেষ ধরনের প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে, সেটা মিটলে আমি সিকান্দর না মিটলে ‘বিধবা’।
মানে আমাকে রাজনীতি নিয়ে লিখতে হবে, রাজনীতিকদের নিয়ে লিখতে হবে। ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা এমতো ক্ষুদ্র সুখে ভরবে না, কলমটাকে চাবুকে পরিণত করে লিখতে হবে। আমি নিজেই এমন প্রত্যাশার জনক কেন না একটা সময় নিজের কলামে আমি ঠিক এই কাজটিই করতাম, ব্যাটসম্যানের ঝোড়ো ইনিংস দেখতে সবাই ভালোবাসে, আমিও গালাগাল এবং হাততালি দু’টোই কুড়িয়েছি। অনেক বছর আগে গায়ক ইন্দ্রনীল সেন আমাকে মুখের ওপর হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘তুমি হলে শনি-মহারাজ, যার ওপর তোমার কৃপাদৃষ্টি পড়বে তারই সর্বনাশ।’
তারপর হুগলি দিয়ে কত না জল বয়ে গেল। আমার ব্যক্তিগত জীবনে, রাজ্য-রাজনীতিতে, দেশের রাজনীতিতে। ক্যাটাক্লিসমিক চেঞ্জেস। ভগবান বৃদ্ধ হয়েছেন, হেঁপো রোগী, হৃদযন্ত্রের তন্ত্রী কর্পোরেশনের কলে জলের ধারার মতো, সময় ধার করে তার বেঁচে থাকা। চালিয়ে খেলা দূরে থাকুক ময়দানটাই তার চোখে এখন বিভীষিকা। অতএব সব যেখানে উথাল-পাথাল, আজ এক রকম তো কাল আর এক সেখানে যৌবনের ঘরানা নিয়ে বসে থাকাটাই হবে স্থবিরতা। মাঠের ভিতরের ২১ গজটা এখন বলদ দিয়ে হাল চষা ক্ষেতের মতো, কোন বলটা গড়াবে, কোনটা লাফিয়ে উঠবে, কোনটা আবার সোজা মাথায় এসে আঘাত করবে কে বলতে পারে? এই জমানার মূলমন্ত্র হল হাওয়ার সঙ্গে চলো, স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়েছ কী মরেছ!
এ কথা ঠিক পাঠকের প্রত্যাশায় আমি হালফিলের বাংলা সাংবাদিকতা সম্পর্কে তীব্র হাহুতাশের আওয়াজ শুনতে পাই। খুবই খারাপ লাগে, নিজের অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করে চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের অতুলনীয় স্লোগানটি এ প্রসঙ্গে বারেবারে মনে আসে, ‘ডেমোক্রেসি ডাইজ ইন ডার্কনেস।’ আমরা এখন সেই নিবিড়, ঘন, আঁধারের মধ্যে দিয়ে চলেছি, নিকশ কালো আকাশে একটি তারাও চোখে পড়ে না, ধ্রুবতারা তো দূরস্থান। সহসা তিমির-রাতি পোহাবে তেমন ইঙ্গিতও কোথাও নেই বরং আঁধার আরও ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।তমসো মা জ্যোতির্গময় বলে বাতিস্তম্ভ হাতে বুক চিতিয়ে পথ দেখাবেন তেমন মহামানবই বা কই?
একটু গভীরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় যেন যুগান্তর ঘটে গিয়েছে। আমরা যে সময়টায় সাংবাদিক হব বলে মনস্থ করেছিলাম, অর্থাৎ আশির দশকের গোড়ার দিকে, সেটা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সাংবাদিকতার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচার বন্ধ হয়েছে, তিনি ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন, গণতন্ত্র এবং তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি যে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে মহার্ঘ বস্তু দেশের মানুষের মনে সেই উপলব্ধিগুলি জাগ্রত হয়েছে নতুন করে। চেতনার ক্ষেত্রে এই নব-জাগরণ মানুষকে আগের তুলনায় অনেক বেশি সাহসী করে তুলল, তার বিস্ফোরণ ঘটল মিডিয়ায়। স্বাধীনতার পরে অনেক বছর পর্যন্ত ভারতীয় মিডিয়া সরকারের ভয়ে জবু-থবু হয়ে থাকত, খবর বলতে বুঝত প্রধানত নেতাদের ঢাউস-ঢাউস বক্তৃতা, অনুসন্ধানমূলক খবর ছাপার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এমনকী সংসদে যদি কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হতো, পরের দিন কোনও খবরের কাগজ সেই সংস্থার নামটি পর্যন্ত ছাপত না। ভয়ে। সংবাদপত্র তখন অতি-নীরস, ম্যাড়মেড়ে, প্রাণের স্পন্দন সেখানে অনুপস্থিত, অন্দরে এবং বাইরে।
পরিস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এল জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার ঠিক পর পরই। দেশের প্রতিটি রাজ্যে, প্রতিটি স্থানীয় ভাষায় শুরু হল শয়ে শয়ে নতুন খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন। ইংরেজি সাংবাদিকতায় প্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল ইন্ডিয়া টু ডে-র হাত ধরে। বিষয় নির্বাচন, প্রতিবেদনের ভাষা ও কাঠামো, ছবির ব্যবহার সব কিছুতেই অভিনবত্ব এল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সানডে পত্রিকা একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে শাসককে বে-আব্রু করতে শুরু করে দিল। বিটলস আর মিনি স্কার্ট যখন লন্ডন কাঁপাচ্ছে, ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ নিবন্ধের শিরোণাম হয়েছিল, ‘লন্ডন ইজ সুইঙ্গিং।’ অনেকটা যেন তারই আদলে ইন্ডিয়া টু ডে প্রচ্ছদ নিবন্ধের নাম রেখেছিল, ‘দ্য রাইজ অব দ্য ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাস’, পাঠক নতুন ভাবে ভাবতে শিখল, শেখাল মিডিয়া। উৎকর্ষের মাপকাঠিতে ইন্ডিয়া টু ডে-র পরে ব্যাটনটা চলে এল খবরের জগতে আমরা যাকে ‘পিঙ্ক’ প্রেস বলি তাদের হাতে, প্রথমে ইকনমিক টাইমস, তারপরে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। সবশেষে আন্তর্জাতিক মান স্পর্শ করে বাজারে এল কয়েকটি বিজনেস ম্যাগাজিন। মোটের ওপর মিডিয়ার বাজার বাড়ল, পাঠকের সংখ্যা বাড়ল জ্যামিতিক হারে, সব মিলিয়ে মনে হতে শুরু করল ‘উই টু হ্যাভ অ্যারাইভড।’ হাম ভি কিসিসে কম নেহি!
তারপর এল টেলিভিশন। দূরদর্শনের সাদা-কালো পর্দায় সরকারি-নামচা শুনে কান পচে যাওয়া দর্শকের জীবনে নতুন হাওয়া নিয়ে প্রবেশ করল বেসরকারি টেলিভিশন, ইংরেজিতে প্রণয় রায়ের নিউ দিল্লি টেলিভিশন, হিন্দিতে আজ তক। সাংবাদিকতার তরলীকরণের সেই শুরু। খবর নয়, নাটক হয়ে উঠল টিভি মিডিয়ার প্রাণভোমরা। যে যত চেঁচাতে পারবে, নাটকীয় ভাবে খবরের উপস্থাপনা করতে পারবে তার টিআরপি তত বেশি। শেষ পাতের চাটনির মতো ব্রেকিং নিউজের উৎপাত তো আছেই।
তারপর যেটা ঘটল তার গুরুত্ব ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের চেয়ে কিছু কম নয়। অর্থাৎ ওয়েব টু পয়েন্ট জিরো। এক ধাক্কায় বদলে গেল গণমাধ্যমের সব পরিচিত অঙ্ক, জন্ম হলো পার্সোনাল মিডিয়ার। এই বিষয়টি নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা করতে পারি কিন্তু এখনই তা করছি না। শুধু এইটুকু বলছি এই জমানাটা আমরা সবাই রাজার। আপনার যদি প্রতিভা থাকে, থাকে সৃষ্টিশীল মন, তার স্ফুরণের জন্য কোনও দাদা-দিদি ধরার প্রয়োজন হবে না। অনাদরে, কুণ্ঠিতা হয়ে এতকাল যে ঘরের কোণে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, এ বার সকলে তাকে চিনবে। মান্ধাতার আমলের লোক আমি, নতুন বাসগৃহে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। আবার আমোদও পাচ্ছি ভরপুর। যা হারিয়ে যায় তাকে আগলে বসে থাকার চেয়ে যে হাতছানি দিচ্ছে তার ডাকে সাড়া দেওয়াই তো ভালো! কী বলেন আপনারা!