Wednesday, November 6, 2024

মহামারী, বাহিরে, অন্তরে

Must read

শুভেন্দু দেবনাথ

“প্রতিবেশী মাঠে গেল বর্ষায় দেখেছি সবুজ

এই বর্ষায় সে মাঠে উঠেছে বাড়ি-গম্বুজ

প্রমোটার শোনে টাকার বদল বর্ষার গান

রবীন্দ্রনাথ বৃথাই ভেজেন বৃথাই ভেজান”।

গতকাল সকাল থেকেই মেঘ, বৃষ্টি আর রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা। এই তো হালকা রোদের ছায়া, তো মিনিট তিনেক পরে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি, আবার খানিক্ষণ পরে না রোদ না বৃষ্টি, শুধু শিশুর মতো আকাশটি যেন কোনও অভিমানে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। যেন করোনা ক্লিষ্ট এই সময় ফ্ল্যাটে বন্দি থাকা শিশুটির খেলতে না পারার অভিমান হয়। আমাদের এই সময়ের জীবনও যেন তেমনই, এই ভালোর দেখা তো পরক্ষণেই স্বার্থ সর্বস্বতা।

চুঁচুড়া-চন্দননগরে মানুষ হওয়া আমি দেখেছি পাড়া কালচার। যত রাগ, ঝগড়াই থাকুক না কেন, প্রতিবেশীর বিপদ দেখা দিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা পাড়া। আবার একই দৃশ্য দেখা যায় আনন্দ অনুষ্ঠানেও। পাড়ায় যার সঙ্গে যার মুখ দেখাদেখি বন্ধ, তেমনই দুই পরিবারের কারও মেয়ের বিয়ে হলে দেখেছি অপরপক্ষ বরযাত্রীদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে তাদের খাইয়ে দাইয়ে বাড়ি না পাঠানো পর্যন্ত বিয়ে বাড়ি ছেড়ে নড়ছেন না। শহর কলকাতায় এ দৃশ্য বিরল। এক সময় দেখা যেত উত্তর কলকাতা জুড়ে, সে কথা উপন্যাসে পড়েছি বা সিনেমায় দেখেছি। এখন উত্তর কলকাতায় থাকার সূত্রে পাড়া কালচার দেখলেও এখানে সবই কেমন আত্মকেন্দ্রিক, ওই পুজো বা পাড়ার খেলা উপলক্ষে সকলের একত্র হওয়া, ব্যস এইটুকুই।

মে মাসের শেষ দিকটায় কলকাতার আকাশে মেঘ, বৃষ্টি আর রোদের লুকোচুরি খেলা। এর মধ্যেই একদিন রোদ-বৃষ্টির মধ্যে কাজ সেরে রাত ১২টা নাগাদ সবে খেতে বসেছি। তার মধ্যেই সাংবাদিক বন্ধু চৈতালির ফোন। ফোনের অপরপ্রান্তে চৈতালির উদ্বিগ্ন গলা, ‘শোন না আমার এক সাংবাদিক বান্ধবীর বাবা হঠাৎই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, স্যাচুরেশন লেভেল ৮০ ঘরে নেমে গিয়েছে। মেয়েটি একা, টেনশনে কোনও ডিসিশন নিতে পারছে না। তুই একটু যাবি, সিঁথির মোড়েই বাড়ি। বালি থেকে যেতে যেতে আমার ভোর হয়ে যাবে।’ ওকে আশ্বস্ত করি, ঠিকানা ও নম্বর নিই। দ্রুত উবেরে করে পৌঁছে যাই একটার মধ্যে। গিয়ে দেখি একেবারে বেহাল অবস্থা।

ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে একজন রেড ভলান্টিয়ার অক্সিজেন নিয়ে এসেছে। অক্সিজেন চলছে মাত্র মিনিট ১৫ হয়েছে। মেয়েটির বাবা প্রায় অজ্ঞান, শুধু গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে, প্রচণ্ড বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট। ইতিমধ্যে চৈতালিই ব্যবস্থা করে ব্যারাকপুর বিএন বোস হাসপাতালে কথা বলেছে, বেড কনফার্ম করেছে। প্রথমে মেয়েটি ভেবেছিল উবেরে করেই নিয়ে যাবে। তার বাবার যা অবস্থা তাতে উবের তো দূর অস্ত কী ভাবে নিয়ে যাওয়া যাবে সেটাই বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে অক্সিজেন চলতে চলতেই পেশেন্ট বমি করে ফেলে, এমনকী পটিও। না পারছেন কাত হয়ে শুতে, না নড়তে। অক্সিজেনের ছেলেটি ঠায় দাঁড়িয়ে, মেয়েটি আর মেয়েটির মাও টেনশনে, দু’জনে কী যে করবেন বুঝতে পারছেন না।

র মধ্যেই দ্রুত বন্ধু অমিতকে ফোন করে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে ফেলি। অ্যাম্বুল্যান্সে একজন অ্যাটেনডেন্টও লাগবে, নইলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ পর অ্যাম্বুল্যান্স আসে, একটি চাদরে মুড়ে আমরা মানুষটিকে একতলায় নামিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের স্ট্রেচারে করে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাই। কী অদ্ভুত আমাদের এত জনের জোরে জোরে কথাবার্তা, অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ, ঘনঘন সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা, কিছুই যেন পাশের ফ্ল্যাট, দোতলার ফ্ল্যাট একমকী দু’ ফুট রাস্তার উল্টো দিকের ফ্ল্যাটেরও কারও ঘুম ভাঙায় না। প্রতিবেশী একজন হাসপাতালে যাচ্ছেন, একা মা ও মেয়ে, সঙ্গে যাবে কে, উপায় কী, টাকা পয়সা লাগবে কি না, মাঝ রাতে দু’টি মেয়ে কী করব, কিছুই যেন কারও সুখ নিদ্রার মধ্যে দিয়ে মরমে প্রবেশ করে না। তারা গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখে সুখের সংসারের, আগামীকাল টিভিতে কী হবে, রাজ্যে পালাবদলে কে কতটা এগিয়ে বা পেছিয়ে। পাশের বাড়ির কেউ বাঁচল বা মরল তাতে আমার কী!

অ্যাম্বুল্যান্সে অ্যাটেনড্যান্ট থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে একা ছেড়ে যেতে পারি না। মেয়েটির মাকে ফ্ল্যাটে একা রেখেই আমরা হাসপাতালে রওনা দিই। প্রবল ঝড় আর বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এতটাই খারাপ অবস্থায় যে চালকের পাশে বসে ভিতর থেকে গাড়ির কাচ মুছতে মুছতে যেতে হয় অ্যাটেনড্যান্টকে। রাস্তার বাম্পার দেখতে না পারায় চালকের গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে। প্রবল ঝাঁকুনি, দুলুনিতে পেশেন্টের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ি পর্যন্ত নেই। এদিকে আমরা ঘুরে মরছি। কিছুতেই হাসপাতাল খুঁজে পাচ্ছি না। মেয়েটির বাড়ি থেকে ফোন আসছে। আসলে মেয়েটির মায়েরও যে অক্সিজেন লেভেল ৯০-এ নেমে গিয়েছিল, একা মেয়ে টেনশন করবে বলে মা সে কথা জানাননি। ওদিকে রেড ভলান্টিয়ার ছেলেটি অক্সিজেন ফেরত নিয়ে চলে গিয়েছে। এখন মায়ের অক্সিজেন লেভেল ৮০-তে নেমে গিয়েছে। আমি ফোনে কথা বলি, ওদিকে মেয়েটিও ফোনে অক্সিজেনের খোঁজ চালায়। চৈতালিকে ফোন করি। মেয়েটির কান্না চাপতে গিয়ে প্রায় ফোঁপাতে শুরু করে।

“এসো শর্তহীনতা মেনে

এসো ফেলে দিয়ে রীতিনীতি

এসো যে পথে হৃদয় চিনে

এসো নামহীন পরিচিতি”।।

একদিকে এই ঝড়-জলে হাসপাতাল খুঁজে না পাওয়ার আতান্তর ওদিকে বাড়িতে একলা মায়ের অক্সিজেন নামতে শুরু করেছে । শেষমেশ সৌমিত দেব আর স্বর্ণাভ দে-র সহযোগিতায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়। চৈতালিকেও বলা হয় কাকিমার সঙ্গে কথা বলতে। এদিকে আমি উপায়ন্তর না থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি বি এন বসু হাসপাতাল গোল্লায় যাক, রাস্তায় যে হাসপাতাল চোখে পড়বে তার ইমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে ফেলতে হবে পেশেন্টকে, নইলে বড়সড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। ব্যারাকপুর বিএমআরসি হাসপাতালের কথা মনে পড়তেই সোজা অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে সেখানে ঢুকিয়ে দিই, ভিতর ঢুকে কথা বলে বেডের ব্যবস্থা হয়।

এর মধ্যে চৈতালিও মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানায় ভয়ের কিছু নেই টেনশন থেকে হচ্ছে। বলতে ভুলেছি, মেয়েটি দু’বার কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, এবং তার বাবা মাও একবার করে আক্রান্ত। ইতিমধ্যেই ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার নার্স মিলে লেগে পড়েন কাজে। ফর্ম ফিলআপ, চেকআপ সব করে, সিসিইউতে ভর্তি করা হয় ভদ্রলোককে। সিসিইউ বেডে দেওয়ার পর অপেক্ষা। সম্পূর্ণ চেকআপের পর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি, ক্রিটিক্যাল অবস্থা। সকালে সবকিছু পরীক্ষা করে তবে অবস্থা বোঝা যাবে। ভদ্রলোকের গ্যাসের সমস্যা, লাংস এফেক্টেড, আরও কত কী। কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে ফেরার পথ ধরি। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল পৌনে ছ’টা। এরপর কোনওমতে মেয়েটিকে টেনেটুনে নিয়ে বাড়ি পৌঁছই। ক্লান্ত বিধ্বস্ত। ফ্ল্যাট বাড়ির সিঁড়িতে যখন পা রাখি, পাশের ফ্ল্যাটে তখন টেপ রেকর্ডারে রবি ঠাকুরের গানে গলা ছেড়েছেন হেমন্ত মুখুজ্জে। ‘আমার হৃদয়, তোমার আপন হাতের দোলে, দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়’। ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলি, পাশের ফ্ল্যাটের অসহায়তা যার হৃদয়ে দোলা লাগাতে পারে না, সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে কোন লজ্জায়! বলি না।

বাঁচানো যায়নি ভদ্রলোককে। পরদিন রাতে চৈতালিই খবর দেয় মারা গিয়েছেন ভদ্রলোক। থম মেরে যাই। সেই ঝড়-জলের রাতের কথা হয়ত মেয়েটি কোনওদিন ভুলতে পারবে না। আমিও কী পারব। রাত তিনটের সময় অ্যাম্বুল্যান্স থামিয়ে লোকের বাড়ির দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে হাসপাতালের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করা, কী অবর্ণনীয় সে অবস্থা, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

দিন কয়েক পরে মেয়েটির ফোন, এ বার বাবার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন। নীতিগত কারণে আমি শ্রাদ্ধবাড়িতে যাই না। কিন্তু মেয়েটিকে ফেরাতে পারি না। তাকে বলি যাব, শুধু তার সঙ্গে দেখা করে চলে আসব, খাব না। নির্ধারিত দিনে পৌঁছই মেয়েটির বাড়িতে। মেয়েটি তখন শ্রাদ্ধের কাজে বসেছে। গল্প করি তার মায়ের সঙ্গে। মেয়েটির মা জানায় একদিন অশৌচের নিয়ম অনুযায়ী মেয়েটি ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে যায় কাককে সরা দিতে। ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় আর চাবি নিয়ে যেতে ভুলে যাওয়ায় মেয়েটি একটি ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজায়। কিন্তু দরজা খোলে না। বেল বাজাতে বাজাতে এক সময় ভিতর থেকে আওয়াজ আসে আমরা দরজা খুলতে পারব না। হতভম্ব মেয়েটি একসময় রাগে, হতাশায় চিৎকার করে ওঠে, ‘আমার আর আমার মায়ের করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট টা কী দেখিয়ে যাব?’

এই করোনাকালে কাজ করতে গিয়ে ধনী, গরিব, ভদ্রলোক-ছোটলোক নির্বিশেষে যে অমানবিকতা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বহু মানুষকে শুধু দেখেছি ভয়ে নিজেদের করোনা হওয়ার কথা লুকিয়ে যেতে। কারণ তারা দেখেছে একই ফ্ল্যাটের অন্যজন করোনায় আক্রান্ত হলে কী ভাবে তাদের একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। ফলে অসুস্থতা লুকিয়ে যাওয়া, আর তার ফল হল রোগীর অবস্থা এত খারাপ হয়েছে যে সেখান থেকে বাঁচিয়ে ফেরানো সম্ভব হয়নি। যখন আমাদের কাছে সেই রোগীর খবর এসেছে আমরাও বিপদে পড়েছি তাকে নিয়ে। অনেককেই বাঁচাতে পেরেছি, অনেককেই আবার পারিনি। মাঝে মাঝে শুধু প্রশ্ন জেগেছে করোনাই কী একমাত্র মহামারী যা এই মুহূর্তে আমার শহর আমার দেশকে গ্রাস করেছে? একদিন হয়তো এই মহামারী দূর হবে কিন্তু আমাদের ভিতরে যে মহামারী যুগের পর যুগ ধরে ঘর করে আছে তার কোনো ভ্যাকসিন কী কেউ আবিষ্কার করে উঠতে পারবে?

এসো তাকাবো না আর দূরে

এসো বাঁচি এই লহমায়

এসো ক্ষণিকের এই সুরে

এসো জীবন যে চলে যায়!!

- Advertisement -spot_img

More articles

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article