31 C
Kolkata
Thursday, September 19, 2024

এ কী “করোনা”, করুণাময়

Must read

এ কী “করোনা”, করুণাময়

সুমন চট্টোপাধ্যায়

করোনা নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। আমি একা কেন, সুরারসের সন্ধান রাখা অনেকেই হয়ত জানেন, ‘করোনা’ একটা জনপ্রিয় মেক্সিকান বিয়ারের নাম। ছোট সুদৃশ্য কাচের বোতলে পাওয়া যায়, রঙ কিঞ্চিৎ হলদেটে, একটু পাতিলেবুর রস মিশিয়ে পান করলে শরীর-মন-আত্মা জুড়িয়ে যায়।

সেই সুন্দরী করোনা একদিন যে এই ধরাধামে প্রাণঘাতী ত্রাস হয়ে ভৈরব নেত্য শুরু করে দেবে কে তা জানত। নশ্বর মানব তো কোন ছাড়, খবরে পড়লাম, নিউইয়র্কের চিড়িয়াখানায় এক নধরকান্তি বাঘমামাও নাকি করোনায় কাবু হয়ে কুঁইকুঁই করতে শুরু করেছে। খবরটি শোনা ইস্তক সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গলদের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে আমার। আহা রে, ওদের মাস্কই বা কে পড়াবে, কেইবা ওদের উপদেশ দেবে হরিণ-ছানার পিছনে না দৌড়ে আপাতত দিন পনেরো যেন ঘন-অরণ্যের কোয়ারিন্টিনে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে চুপটি করে। এতদিন জানতাম আপনি বাঁচলে বাপের নাম, করোনার পরে বাপের জায়গাটা বাঘকে ছেড়ে দিতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

আমি এমনিতে হাইপোকন্ড্রিয়াক, বুকে সামান্য চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেই ডাক্তারবাবুকে জ্বালাতন করি, তেমন হলে মাঝরাতেও। গুচ্ছের ওষুধ খাই, মানে খেতে বাধ্য হই। এক নিঃশ্বাসে আপনি যে কয়টা অসুখের নাম উচ্চারণ করতে পারবেন, হলফ করে বলতে পারি তার একটাকেও আমি অযত্ন করিনি। সারাটা জীবন ধরে অকাতরে হৃদয় দান করতে গিয়ে এমন হাল হয়েছে যে দুটো স্টেন্ট বসাতে হয়েছে, যে কোনও দিন ডাক্তার বুকের হাড় চিড়ে হৃদযন্ত্রে পুলটিশ মারার কথা বলতে পারে। ক্লাস নাইন থেকে এই সেদিন পর্যন্ত যত বিড়ি ফুঁকেছি সেই পয়সাটা জমাতে পারলে অনায়াসে একটা পেন্ট-হাউস কিনে নেওয়া যেত। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম ডাক্তার পার্থ ভট্টাচার্য নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে হিসেব কষে বলে দিয়েছে আমার ফুসফুস জোড়া নাকি ৫৬ শতাংশ অকেজো হয়ে বসে আছে, আর কিস্যু করা যাবে না। সেদিক থেকে দেখলে সি ও পি ডি-র রোগী হিসেবে আমি এখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সামান্যই পিছনে আছি বলতে পারেন। বাকি রইল রক্তচাপ, মধুমেহ আর রিফ্লাক্স ইসোফেজাইটিস। নিজের মেডিকেল বুলেটিন আর দীর্ঘায়িত করব না, শুধু এইটুকু বলব যে ২০১৮-র ২০ ডিসেম্বর সি বি আই আমাকে যখন আচম্বিতে গ্রেপ্তার করে তখন আমার রক্তচাপ ছিল ২২০/১৩০। ওদেরই ডেকে আনা সরকারি ডাক্তার ঘাবড়ে গিয়ে সোজা বলে দিয়েছিল অবিলম্বে আমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। সল্টলেকের সেবা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে শুনে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল, পরের দিন ভোরে দিব্যি ভুবনেশ্বরে চলে এসেছিলাম। প্রভু জগন্নাথের কৃপায় তারপর ১৫ মাস আদরের সব অসুখ নিয়ে দিব্যি চলে-ফিরে বেড়াচ্ছি। রাখলে কেষ্ট মারবে কে? মনের জোর থাকলে শরীরটাকে দেখছি বেশ অনায়াসেই বশে আনা যায়।

দুনিয়ার বাকি সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়ে এখন সুনামি হয়ে আছড়ে পড়েছে কেবল করোনা। কাগজ পড়ে, টিভি দেখে বিলক্ষণ বুঝতে পারছি করোনায় পটল তোলার আদর্শ ক্যান্ডিডেট হতে পারি আমি। মানে আমি আছি হায়েস্ট রিস্ক ক্যাটেগরিতে। অথচ আমার মতো ভিতুর ডিম কিন্তু এক ফোঁটাও ভয় পাচ্ছে না। ফুটে যাওয়া অদৃষ্টে থাকলে ফুটে যাব এমন একখানা ভাবনাই অষ্টপ্রহর আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে। করোনার জন্য করুণা-ভিক্ষা চাইছি না, এটা কোরোনা, ওটা কোরোনা শুনতে শুনতে বোর হয়ে গিয়েছি। মানুষের জীবনে কয়েদখানা কত বড় শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে গ্রেপ্তার না হলে সেই জরুরি উপলব্ধিটা আমার কাছে অধরাই থেকে যেত। বেল পাকলে কাকের যেমন মাথাব্যথা করার প্রয়োজন হয় না, আমার থাকা-না থাকা নিয়েও বহির্বিশ্বের অনাসক্তি অনেকটা তেমনি। এটা আমার অভিমান নয়, আগ-মার্কা বাঙালি ন্যাকামোও নয়। এটাই হকিকৎ যা আমি সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছি অনেক দিন আগেই। আজ একটু আগেই তাই গলা ছেড়ে গান ধরেছিলাম, ছুটির বাঁশি বাজল, বাজল ওই নীল গগণে/ আমি কেন একলা বসে এই বিজনে। একলা আসা, একলা থাকা, একলা যাওয়া এই তিনের যোগফল হল জীবন! সেই জীবন এখন যদি ‘করোনা ধারায় শুকিয়ে যায় তো যাক। করুণা-ধারার আর কোনও ধারই ধারি না আমি।

তাই বলে কি আমার মনে কোনও উদ্বেগ নেই? আলবাত আছে। আমার ছেলে-মেয়ে দু’টি দুনিয়ার দু’প্রান্তে স্বজন-পরিজনহীন হয়ে একা একা মোকাবিলা করছে এই দুঃসহ দুঃসময়ের। মেয়ে সবে ডাবলিনে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে গিয়ে পড়ে গিয়েছে লক-ডাউনের মধ্যে। সভ্য দেশ আয়ারল্যান্ড, লকডাউনের চরিত্রটাও সেখানে তাই ভদ্র-সভ্য গোছের। রাস্তায় বের হলে পুলিশ লাঠি হাতে ক্যালায়না, খুবই সহানুভূতির সঙ্গে বাইরে বেরোনোর যথার্থ কারণ কিছু আছে কিনা সেটা জিজ্ঞাসা করে। রাস্তায় বাস-ট্রাম যেমন চলার চলছে, জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত লোকজন ছাড়া কেউ তাতে চড়ে না। প্রতিটি মহল্লায় খোলা বলতে কেবল মুদির আর ওষুধের দোকান, দিনযাপনের প্রয়োজনীয় সব কিছু সেখানে পাওয়া যায় নীরবে লাইনে দাঁড়িয়ে। যে যেখানেই থাকুক না কেন তার দু’কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সে অবাধে ঘোরাঘুরি করতে পারে, পার্কে গিয়ে হাঁটাহাঁটির ওপরেও কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। আমার কন্যার স্বাস্থ্য সচেতনতাটা আবার একটু বাড়াবাড়ি রকমের, এক্কেবারে হেলথ-ফ্রিক। মেদ জমার ভয়ে ব্রাউন রাইস খায়, রোজ সকাল-বিকেল একা একাই কাছের পার্কে গিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে। শুনে আমার আর গিন্নির বুকটা ভয়ে হু হু করে, ধমক-টমকে কোনও কাজ হয় না। বাপ কা বেটি, বাপের মতোই বিন্দাস।

একরত্তি দেশ আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ কলকাতায় যত লোক থাকে গোটা দেশের জনসংখ্যা তার চেয়েও কম, মাত্র ৫০ লাখ যার মধ্যে আবার লাখ পাঁচেক বিদেশি। করোনার মতো মহামারি না দেখলেও আয়ার্ল্যান্ড ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখেছে ঊনবিংশ শতকের মাঝমাঝি নাগাদ, আলু-চাষে মড়ক লাগার পরে। সেই দুর্ভিক্ষে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অনাহারে, আরও প্রায় ১০ লাখ লোক দেশান্তরী হয়েছিল। ভারত তখনও কোম্পানির শাসনাধীন, মহারানি ভিক্টোরিয়া তখনও এই উপনিবেশের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেননি। আইরিশরা অনেক কাকুতি মিনতি করা সত্ত্বেও পাশের দেশ ইংল্যান্ড তাদের সাহায্য করতে তেমন কোনও উদ্যোগই নেয়নি। এবার করোনার গ্রাসে থরহরিকম্প আয়ার্ল্যান্ডেও, মৃতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ভারতের চেয়েও বেশি। কিন্তু ডি ভ্যালেরা, সিস্টার নিবেদিতা, জেমস জয়েসের দেশের প্রধানমন্ত্রী কী করছেন? পুরো সময়ের রাজনীতি করবেন বলে ডাক্তারির পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেক কাল আগেই। এবার স্বদেশ গভীর সঙ্কটের মুখে পড়ায় তিনি ফের ডাক্তারি করবেন বলে মনস্থ করেছেন। প্রতি সপ্তাহে একটা বেলা তিনি হাসপাতালে কাটাবেন আর্তের সেবায়। এমন দেশে মেযে আছে বলে কিছুটা বাড়তি নিশ্চিন্ত লাগছে নিশ্চয়ই।

ছেলেটাও নতুন চাকরি নিয়ে মুম্বইতে থিতু হয়েছে মাস কয়েক হল। যে বন্ধুর সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে সে অফিসের কাজে অন্যত্র চলে গিয়েছে বেশ কিছুদিন হল, এখন সেখানে তার একারই রাজত্ব। অফিস বন্ধ, তবু ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। রান্না করার মাসি, ঘরদোর পরিষ্কার করার লোক লকডাউনের বাজারে কামাই করতে বাধ্য হয়েছে, কুটোটি ভেঙে দু’খান করতে না জানা সেই আদুরে ছেলের রীতিমতো নাকানি-চোবানি অবস্থা। হোম ডেলিভারি গোড়ায় একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল,

এখন অনিয়মিত ভাবে হলেও মিলছে। দিন-রাত বন্ধুদের সঙ্গে টো টো করে বেড়ানো সেই চড়ুই পাখি এখন গৃহবন্দি, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে প্রতি দিন দু’বেলা মাকে ফোন করে রান্নার অ আ ক খ শিখতে। আমার শুনতে কখনও বেশ মজা লাগে, কখনও আবার দারুণ কষ্ট হয়। আমার পায়ে শেকল, এমন দুর্যোগে একমাত্র ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়াই সেই স্বাধীনতাটুকুও তো নেই। ভিক্টর হুগো লিখেছিলেন “অ্যাডভার্সিটি মেকস মেন”। ছেলেটাও এই প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ‘মানুষ’ হয়ে উঠবে সেটাই একমাত্র সান্ত্বনা।

আর আছে তীব্র মনোবেদনা যা আমি হাজার চেষ্টা করেও কাউকে বোঝাতে পারব না। গত ৪০ বছর যাবৎ আমার একমাত্র ভালবাসা আমার সাংবাদিকতা। এমন একটা সময়ে বিরস দিন, বিরল কাজ মনে প্রবল দ্রোহের জন্ম দেয়, নিজেকে বড্ড বিপন্ন, বড্ড অসহায় মনে হয়। একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে পায়ের তলায় সর্ষে ছিল আমার, দুনিয়া দাপিয়ে বেরিয়েছি তখন। শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্থানে গৃহযুদ্ধ দেখেছি, চোখের সামনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তেও দেখেছি। বারেবারে ছুটে গিয়েছি কখনও অশান্ত পাঞ্জাব, কখনও শ্রীনগর কখনও বা অযোধ্যায়। বাপ-ঠাকুর্দার মুখে মন্বন্তরের মর্মন্তুদ কাহিনি শুনেছি, কলেরা, কালাজ্বর, ভেদ-বমিতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হওয়ার গপ্পোও পড়েছি। পড়েছি সত্যেন দত্তের কবিতায়— মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি। কিন্তু গোটা গোলার্ধ গিলতে বসা এমন প্রাণঘাতী মহা-মহামারির ছবি দুঃস্বপ্নেও ভেসে ওঠেনি কোনও দিন। ইতিহাসের বইতে বিউবোনিক প্লেগ কিংবা মারণ রোগে ইউরোপের একটার পর একটা দেশের ছারখার হয়ে যাওয়ার কথাও পড়েছি। তবু সে সবই তো সুদূর অতীতের ঘটনা, মনকে সামান্য নাড়া দিয়ে চাপা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। অথচ আজ তেমনই একটা আ্যাপোকেলিপ্সের মতো ভয়ঙ্কর বাস্তব এসে কড়া নাড়ছে দুনিয়া ঘুরে ঘুরে সক্কলের বাড়ির দরজায়, এ এমন ভাইরাস যা শ্রেণি-বৈষম্য বোঝে না, সাদায়-কালোয় তফাত করেনা, মানে না মানুষের তৈরি কোনও ভৌগোলিক সীমানা। এমন মহাপ্রলয় তো সাংবাদিকের জীবনে বারবার কভার করার সুযোগ আসে না, আসে না শতাব্দীর পর শতাব্দীতেও। এটাই ছিল আমার সাংবাদিকতা করার সেরা সুযোগ, বে-আক্কেলে সি বি আইয়ের হাতে পড়ে যে সুযোগ থেকে আজ আমি বঞ্চিত হয়ে গরাদের ভিতরে বসে কড়িকাঠ গুণছি। এ ব্যথা কী যে ব্যথা, আনজনে তা বুঝবে না, সজনী আমি বুঝি, মরেছি মনে মনে।

বন্দি হওয়ার কারণে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটও আমি চাক্ষুষ করতে পারিনি, ১৯৮২ থেকে আগাগোড়া সব কয়টি নির্বাচন কভার করার পরে। তবু সত্যি বলছি, তখন আমার এতটা মনস্তাপ হয়নি যেটা এখন হচ্ছে। এই বঞ্চনা-বোধের ব্যথার সামনে কয়েদবাস কোনও শাস্তিই নয়, বড়জোর একটু কান-মলা যেন।

আবার এমনটাও হতে পারে ভগবান বৃদ্ধ হয়েছেন, আমি পুরোনো ঘরাণার সাংবাদিক, ঘটনা যেখানে রিপোর্টার সেখানে থাকবে সারাটা জীবন এটাকেই স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে এসেছি, এখনও সেটাই মানি। সেদিন তাজ্জব হয়ে শুনলাম কলকাতার একটা বড় বাংলা দৈনিকের রিপোর্টারদের কাছে ওপরওয়ালার আদেশ এসেছে তারা সবাই যেন বাড়িতে বিছানার ওপরে বসে রিপোর্ট লেখে, বাইরে পা ফেলার কোনও প্রয়োজনই নেই। কথাটা শোনা মাত্র জগন্নাথের মূর্তিটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তখন মনে হল বাড়ি থেকে কাজ করার স্বাধীনতার চেয়ে কয়েদখানার পরাধীনতা অনেক ভাল। এক্কেবারে ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় প্রভু পাঠিয়েছেন আমাকে। করোনায় মৃত্যু যদিবা সহ্য হয় সাংবাদিকতার মৃত্যু চাক্ষুষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না কিছুতেই।

(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article